ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার রঙে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকতসহ সবগুলো বিনোদনকেন্দ্রে ঢল নেমেছে দর্শনার্থীদের। নানা বয়সিদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ডিসি পার্কও। চলছে ফুল বেচাকেনার ধুমও।
ভালোবাসা দিবসের সাথে পহেলা ফালগুন ঘিরে চট্টগ্রামে কোটি টাকার ফুলবাণিজ্যের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রধান আকর্ষণই হলো ফুল। তরুণ-তরুণী থেকে সব বয়সের মানুষ এদিন ফুল উপহার দেন প্রিয়জনকে। দিবসটি এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই ফুল ব্যবসায়ীরা সারাবছরই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন দিনটির জন্য।
চট্টগ্রাম ফুল ব্যবসায়ী দোকান মালিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. নাছের গনি চৌধুরী বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ফুল বিক্রি বেশি হচ্ছে। ৫ আগষ্টের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হওয়ায় ভালোবাসা দিবসে ফুলের বিক্রি বেড়েছে।
এই ব্যবসায়ী নেতা জানান, ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে চট্টগ্রাম ফুল ব্যবসায়ী দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির অধীন ২৭০টি দোকানে দেশ-বিদেশে ৪-৫ কোটি টাকার ফুল মজুদ রয়েছে। নগরীর ফুলের রাজ্য খ্যাত জামাল খান এলাকার মোমিন রোডে অবস্থিত ফুলের দোকানগুলোতে গতবারের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি ফুল তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি জানান, চট্টগ্রামে ফুলগুলো আসে যশোর, ঢাকা, চকরিয়া, দোহাজারী, চন্দনাইশ, হাটহাজারী ও নাজিরহাট এলাকায় চাষ করা বাগান থেকে। এ ছাড়া বিদেশ থেকেও এবার ৫০ লাখ টাকার ফুল আনা হয়েছে। যার বেশির ভাগ এসেছে চীন থেকে। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও ভারত থেকেও ফুল আনা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ফুল হলো- চীনা গোলাপ, মাম, কার্নেশন, জারবেরা, সাদা গোলাপ, হলুদ গোলাপসহ আরও কয়েক ধরনের ফুল।
ফুলচাষি ও বিক্রেতা গফুর হালি বলেন, এবার দেশি ফুলের কদর বেড়েছে, সে কারণে দামও বেড়েছে। এবার পাইকারিভাবে গেদা ১০০০টি ২৫০ টাকা, জিপসি প্রতি আঁটি ১৫-২০ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা প্রতিটি তিন-চার টাকা বিক্রি হচ্ছে। অন্য দিকে চায়না গেদা প্রতি ১০০টি চার থেকে ৫০০ টাকা এবং চায়না বেলি বিক্রি হচ্ছে প্রতি ১০০টি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। এবার শুধু চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা করছেন ফুল ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ভালোবাসা দিবস ঘিরে চট্টগ্রাম ডিসি পার্কেও নানা আয়োজন চলছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহমান জাদিদ। তিনি বলেন, মাসব্যাপী ফুল উৎসবের সাথে পার্কের বিশালাকার পুকুরে চলছে কায়াকিং। পুকুরের দুই পাশে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনোলিয়া, শিউলি, হাসনাহেনা, কামিনী, বেলি, চেরীসহ দেশি-বিদেশি ফুলের সমারোহ। লাখো ফুলের সমাহারে প্রাকৃতিক রূপে মুগ্ধ দর্শনার্থী ও অতিথি সবাই। ফুলউৎসবের এই মেলায় উচ্ছ্বাসিত অনুপ্রাণিত ফুলপ্রেমী দর্শনার্থী সবাই। উৎসবে আগত সাধারণ জনতা আনন্দে যেন মাতোয়ারা।
শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) হাঁটতে হাঁটতে ফুলের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁও এলাকা থেকে আসা সোহানা মুনির। তিনি বলেন, এ নিয়ে দু‘বার আসলাম। অন্যরকম সুন্দর লাগছে। এ যেন এক ফুলের রাজ্য। এই রাজ্যে ফুটতে শুরু করেছে টিউলিপ ফুল। ফুলের সমারোহের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এখন টিউলিপ।
সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার কেএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ডিসি পার্কে এখন প্রতিদিন ২৫ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী আসছে। ভালোবাসা দিবসে এই সংখ্যা ৫০ হাজার ছুঁই ছুঁই। সে হিসেবে আমরা প্রস্তুতিও নিয়েছি। ডিসি পার্কে আসা দর্শনার্থীদের আমরা অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, দর্শনার্থীদের বিশেষ আকর্ষণের জন্য ২ মাস আগে নেদারল্যান্ডস থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টিউলিপ ফুলের বীজ আনা হয়েছে। গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেনকে দিয়ে এখানে টিউলিপের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এখন ছাউনির ভেতর টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে লাল, হলুদ, গোলাপি ও সাদা রঙের টিউলিপ।
এই আয়োজনকে আরও আকর্ষণীয় করতে ফুলের প্রদর্শনীর পাশাপাশি কয়েকটি সেলফি জোন ও পর্যটকদের জন্য থাকছে সা¤পান বাইচের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, দোলনা, স্প্রিং টয়, মেরিগো রাউন্ড, দোলনা, প্লেপেন, ফুট ট্রা¤পোলাইনসহ রয়েছে নানা আয়োজন। আয়োজন ঝাঁকজমকপূর্ণ করতে মাল্টি কালচারাল বিশেষ আয়োজন ঘুড়িউৎসব, ফায়ার ওয়ার্কস, ভায়োলিন শো, পুতুল নাচ, জাদু প্রদর্শনীও রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার শিল্পীদের পরিবেশনায় থাকছে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।
চট্টগ্রামের বিনোদনকেন্দ্রগুলোর অন্যতম হচ্ছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। এই সৈকতে প্রবেশে নেই কোনো ফি। নেই কোনো বাধা। তাই এই ¯পটে এমনিতেই দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার দর্শনার্থীর ভিড় জমে। তবে দর্শনার্থী ঘিরে এই সৈকতে জমে ওঠে নানারকম আসবাব-তৈজসপত্র ও খেলনার বেচাকেনা। এসব বেচাকেনার বড় বাজার রয়েছে এখানে।
বাজার কমিটির সভাপতি মো. ওয়াহিদুল আলম বলেন, চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাকৃতিক স্পট পতেঙ্গা সি-বিচ। এখানে সাগরের ঢেউ আর দক্ষিণা হাওয়ায় মাতাল হয়ে উঠেন প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীরা। তাই এবারও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রতিবারের মতো প্রচুর দর্শনার্থী জমেছে। এ লক্ষ্যে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতকে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের আকর্ষণ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কারণ, এই সৈকতে গড়ে উঠছে বন্দরের বে-টার্মিনাল ও বঙ্গবন্ধু টানেল। এতে সৈকতের পরিধিও বেড়েছে। ফলে এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে এই সৈকতে এক লাখেরও বেশি দর্শনার্থী হতে পারে।
চট্টগ্রামে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানার অন্যতম আরেক কেন্দ্র হচ্ছে ফয়েস লেক। এই লেকের উপব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নতুন করে সাজানো হয়েছে ফয়েস লেককে। লেকে লাখো দর্শনার্থীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে এমিউজমেন্ট পার্ক এবং সি-ওয়ার্ল্ড। এই লেকে তিন শতাধিক রাইড রয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ঘেরা এই লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। ইতোমধ্যে লেকে উপচেপড়া ভিড় জমেছে।
এদিকে লেকের পাশেই রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পরিচালিত চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানায় এখন দর্শকদের কাঙ্খিত প্রাণীর অভাব নেই। রয়েল-বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, বিভিন্ন প্রজাতির বানর, হনুমান, উল্লুক, ভাল্লুক, সাপ, হরিণ, ধনেশ পাখি, হাতিসহ ৭৩ প্রজাতির ৬২০টি পশুপাখি রয়েছে। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কিছু পশুপাখি। ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে চিড়িয়াখানাকে আকর্ষণীয় করে সাজানো হয়েছে।
চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, ভালোবাসা দিবসে দর্শনার্থীদের নজর কাড়তে চিড়িয়াখানাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। স্বাভাবিক সময় চিড়িয়াখানায় ৪-৭ হাজার, সরকারি ছুটির দিন ১০ হাজার পর্যন্ত মানুষের ভিড় জমে। ঈদে বা ভালোবাসা দিবসের মতো বিভিন্ন দিবসে সেটা দিগুণ পর্যন্ত দাঁড়ায়। তিনি জানান, চিড়িয়াখানায় প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। শিশুদের কোনো ফি নেই। এবার ভালোবাসা দিবসে দর্শনার্থীদের ভিড় রেকর্ড অতিক্রম করবে। আমি চাই, এবারের ভালোবাসা হোক পোষা প্রাণীর প্রতি।
চট্টগ্রামের আরও একটি বিনোদনেরকেন্দ্র হচ্ছে বহদ্দারহাট স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। যার জন্ম হয়েছিল মিনি বাংলাদেশ হিসেবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় জাদুঘরসহ ঐতিহ্যবাহী সব জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শনে গড়ে তোলা হয়েছে এই কমপ্লেক্সে। ফলে মিনি বাংলাদেশ রাখা হয় এই কমপ্লেক্সের নাম। রয়েছে ঘূর্ণায়মান টাওয়ারও। যেখানে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে অবলোকন করা যায় পুরো চট্টগ্রাম শহর।
বিনোদনের আরেক জগত হচ্ছে জাম্বুরী পার্ক। যেখানে প্রতিদিন বিকালে ৮-১০ হাজার মানুষের মেলা বসে। এই পার্কেও রয়েছে বিশাল লেক। যেখানে ছোট ছোট বোটে ঘুরে বেড়ানো যায় অনায়াসে। তবে ভালোবাসা দিবসে এ পার্কে ঢল নেমেছে দর্শনার্থীদের।
এ ছাড়াও নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত প্রজাপতি পার্ক, আগ্রাবাদ কর্ণফুলী শিশুপার্ক, আগ্রাবাদ জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘর, গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত, পারকি সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র ও উন্মুক্ত স্থানে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট তদারককারীরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভালোবাসা দিবসে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকতসহ সবগুলো বিনোদনকেন্দ্রে দর্শনার্থীদের চাপ বেড়েছে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও নির্বিঘ্ন বিনোদনের ব্যবস্থা করতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সব বিনোদনকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা রয়েছেন। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।
You cannot copy content of this page