
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার জসিম উদ্দিন ওরফে সিএনজি জসিম সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমানে গড়ে তুলেছেন আবাসন সাম্রাজ্য। তার এই ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে রাউজান আসনের এমপি ফজলে করিম চৌধুরী ও চট্টগ্রাম-৭ রাঙ্গুনিয়া আসনের এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের।
বিষয়টি প্রবাসীদের মুখে মুখে হলেও সঠিক কোন প্রমাণ নেই এর। বিনিয়োগের জন্য জসিম বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর অনুমোদনের কোনো তথ্যও নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে গাড়ির পুরোনো যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন। যেখান থেকে এতে বিপুল অর্থ আসার কথা নয়। ফলে প্রশ্ন রয়েছে আবাসন খাতে এই অর্থের উৎস নিয়ে।
প্রবাসীরা জানান, ২০১৯ সালের পর হঠাৎ আজমানে জমি কেনা শুরু করেন জসিম। ভবন বানিয়ে ফ্ল্যাট হিসেবে বিক্রি করা শুরু করেন অভিজাত ক্রেতাদের কাছে, যাঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি ক্রেতা। আজমানে জসিমের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের নামে শুরু করা হয় এই আবাসন ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানটির নাম পাওয়া গেছে সেখানকার সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়েও।
প্রবাসীদের ভাষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক শহরগুলোতে বাংলাদেশিদের জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়ের প্রবণতা আগে থেকেও ছিল। ২০১৯ সাল থেকে কার্যকর হওয়া নতুন অভিবাসন নীতির পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। নীতি অনুযায়ী সাড়ে ছয় কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ১০ বছরের নবায়নযোগ্য রেসিডেন্স পারমিট (বসবাসের অনুমতি) পাওয়া যায়। বিনিয়োগকারীর তথ্যও সম্পূর্ণ গোপন রাখে আরব আমিরাত। এই সুবাধে প্রভাবশালী এমপি ফজলে করিম ও সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ মধ্যপ্রাচ্যের এই ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।
আজমান থেকে দুবাই
আজমানের শিল্প এলাকার একটি সড়ক ধরে যেতে যেতে চোখে পড়ে সারি সারি সুদৃশ্য ২৬টি বাড়ি। সবগুলো একই নকশার। সেগুলোর সামনে নাম লেখা জেআর রেসিডেন্স। অনেক বাড়ির সামনে ভাড়া বা বিক্রির সাইনবোর্ড ঝোলানো। একটি বাড়ির সামনে চোখ পড়ল ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের সাইনবোর্ড।
ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের কার্যালয়ে গেলে দেখানো হয় জেআর রেসিডেন্সের বিভিন্ন ভবনের ফ্ল্যাটের ‘ক্যাটালগ’। ভবনগুলোতে রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। আশপাশে ভালো স্কুল, বিপণিবিতান থাকার কথাও জানালেন ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের কর্মকর্তারা। তাঁরা বললেন, অনেক বাংলাদেশি সেখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন। দুবাইয়েও এ প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট থাকার কথা জানান তারা।
আজমান ও দুবাইয়ের একাধিক প্রবাসী ব্যবসায়ী বললেন, জসিম উদ্দিন একসময় গাড়ির পুরোনো যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন। পরে তিনি বাংলাদেশে সোনা পাঠানোর অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় চট্টগ্রামের সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এরপর ২০১৯ সালের দিকে হঠাৎ করে তিনি আজমানের আবাসন খাতে বড় বিনিয়োগ করেন। পরে আজমান ও দুবাইয়ের আরও অনেক এলাকায় জমি কিনেছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন ইউনুছ গ্রুপ।
আজমানের একটি সরকারি অফিস থেকে পাওয়া রিয়েল এস্টেট মালিকদের একটি তালিকায় রয়েছে ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের নাম। যার মালিক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ও মোহাম্মদ ইউনুছ। তাদের এজেন্ট নম্বর ২৯৭৮। ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের ওয়েবসাইটে বলা আছে, জেআর কন্ট্রাকটিং নামেও তাদের প্রতিষ্ঠান আছে, যারা ভবন নির্মাণ করে থাকে। তাদের কার্যালয়ও ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের ভবনে।
৫ থেকে ৯ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট
আজমানের ২৬টি ভবনে ঠিক কয়টি ফ্ল্যাট আছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে জেআর রেসিডেন্স-৯ ও ১০ এর ক্যাটালগে প্রতিটি ভবনে ২০টি করে ফ্ল্যাটের নমুনা ছিল। আজমানে সম্পদ কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করে জানা যায়, জেআর রেসিডেন্সের ফ্ল্যাট বিক্রি করা হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ লাখ দিরহামে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ থেকে ৯ কোটি টাকার কাছাকাছি।
আজমানে ইউনুছ রিয়েল এস্টেট কার্যালয়ে কর্মরত ওবায়দুর নামে এক কর্মী বলেন, আজমানে ইউনুছ রিয়েল এস্টেটের আরও কয়েকটি ভবন রয়েছে। চট্টগ্রামের রাউজানের জসিম স্যার এসব বাড়ির মালিক। এখানে যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি ক্রেতা। ওই এলাকায় খাবারের হোম ডেলিভারি (বাসায় পৌঁছে দেন) করার কাজ করা এক বাংলাদেশি বলেন, এতগুলো বাড়ির কারণে এলাকাটি মুখে মুখে জেআর নামে নামকরণ হয়ে গেছে। তম্মধ্যে জে দিয়ে জসিম বললেও আর দিয়ে কি সেটা বলতে পারেননি ওই ডেলিভারি ম্যান।
গোল্ডেন ভিসার হাতছানি
বিত্তবান বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ ব্যবস্থায় দেশটিতে ২০ লাখ দিরহাম (প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা) বিনিয়োগ করলে ‘গোল্ডেন ভিসা’ পাওয়া যায়। গোল্ডেন ভিসা মানে হলো ১০ বছরের নবায়নযোগ্য রেসিডেন্স পারমিট এবং স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান ও পিতা-মাতা নিয়ে সেখানে থাকার সুযোগ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি নামের একটি সংস্থা ২০২৩ সালে জানায়, তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পদ কিনেছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি সম্পদ ক্রয়ের তথ্য পাওয়া যায়, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন পর্যন্ত যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বৈধ পথে বিদেশে অর্থ নেওয়ার অনুমতি নিয়েছে, তার তালিকায় জসিম উদ্দিনের নাম নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ বিষয়ে বলেন, আমরা যাদের বিদেশে অর্থ পাঠানোর অনুমতি দিয়েছি, তার সবই ব্যবসা করার জন্য। কাউকে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
গোল্ড জসিম
প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য বিদেশে থাকায় প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক দিয়ে দেশের শীর্ষ উপজেলার একটি চট্টগ্রামের রাউজান। সেখানকার অনেকে বিদেশে বসে হুন্ডি ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালানের যুক্ত হয়ে পড়েছেন। যার মূল হোতা জসিম উদ্দিন।
জসিম উদ্দিনের শ্যালক আশরাফুল হকের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে সাড়ে ১১ কেজির বেশি সোনা চোরাচালানের ঘটনায় মামলা হয়। মামলার পরই তিনি দেশ ছাড়েন। এটা এলাকার সবার জানা। তবে জসিমের নাম বার বার উঠে আসলেও সরাসরি প্রমাণ না থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনরকম মামলা করা সম্ভব হয়নি বলে জানান দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
দেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। জসিম উদ্দিনকে চেনেন কি না, ব্যাংকটির নোয়াপাড়ার পথেরহাট শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নুরুল আফসারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, চিনব না কেন? এলাকায় তাঁর একাধিক সিএনজি পাম্প আছে। অনেক দান করেন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে রাউজানে যাওয়ার পথে একটি বাসে জসিম উদ্দিন সম্পর্কে জানতে চাইলে সেখানকার আবুল হাসেম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘সিএনজি জসিম তো এখন গোল্ড জসিম। এলাকায় তিনি কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বড় মসজিদ করেছেন। এলাকায় কারও কারও বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন, কাউকে নগদ টাকা সহায়তা করছেন। সবাই তাকে ভালো মানুষ হিসেবে চেনে।
শুরু যেখান থেকে
রাউজানের বাসিন্দারা জানান, চার ভাইয়ের মধ্যে জসিম উদ্দিন তৃতীয়। তার বড় ভাই মো. রফিক ১৯৯০ সালে সংযুক্ত আর আমিরাতে পাড়ি জমান। শারজাহ থেকে গাড়ির পুরোনো মালামাল দেশে এনে বিক্রি শুরু করেন। পরে জসিম উদ্দিন এই ব্যবসায় যুক্ত হন। ২০০৩ সালে তেলের পাম্প দিয়ে দেশে ব্যবসা শুরু করেন। রাউজানের তেলের পাম্পের নাম দেন ইউনুছ ফিলিং স্টেশন।
এরপর কাপ্তাই সড়ক ও রাঙ্গুনিয়াতেও পাম্প করেন তিনি। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে গাউছিয়া মার্কেটে ইউনুছ ট্রেডার্স নামে দোকান রয়েছে। যেখানে গাড়ির মালামাল বিক্রি করা হয়। দোকানটি জসিমের ভাই আবু তাহের দেখভাল করতেন। এখন দেখভাল করেন আরেক ভাই মোক্তার হোসেন। ওই দোকানে কয়েক দফা গেলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
এলাকায় মসজিদ, ফাউন্ডেশন
রাউজানের নোয়াপাড়া থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে সামমাহালদার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই জসিম উদ্দিনের আদি বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির পাশে ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনেই পুরোনো মসজিদ ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আধুনিক মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণ করেছে ইউনুছ-আলমাস ফাউন্ডেশন। আরব দেশের আদলে নির্মিত এই মসজিদ তৈরিতে খরচ হয়েছে ২০ কোটি টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জসিম উদ্দিনের পিতার নাম মোহাম্মদ ইউনুছ ও মাতার নাম আলমাস। তাঁদের নামে গড়ে তোলা হয়েছে ফাউন্ডেশনটি। তাঁরা প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার পরিবারের তিন মাসের খাবার খরচ দেন। শতাধিক পরিবারকে আধা পাকা ঘর নির্মাণ এবং অনেকের মেয়ের বিয়েতে খরচের জোগান দিয়েছেন। করোনাকালে নোয়াপাড়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনে দেয় জসিমের পরিবার।
রাউজানে জসিম উদ্দিনের সামাজিক কার্যক্রম সমন্বয় করেন ইয়াসিন আলী। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, জসিম উদ্দিনের এত টাকার উৎস কী। তিনি বলেন, উনি আগে দেশে সিএনজি পাম্পের ব্যবসা করেছেন। পরে আজমানে গিয়ে আবাসন খাতের ব্যবসা শুরু করেন। এখন বড় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, এলাকায় মসজিদ করেছেন, সবাইকে দানখয়রাত করে যাচ্ছেন। আমি এসব দেখাশোনা করে থাকি। এর বেশি কিছু জানি না।
জসিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পেরে ইয়াসিন আলীকে অনুরোধ করা হয়। তাঁর মাধ্যমে জসিমের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে তিনি রাজী হলেও পরে নাকচ করে দেন।
টিআইবির বক্তব্য:
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমন একজন ব্যক্তির বিদেশে এত সম্পদ বৈধ আয়ে হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের কারণ আছে। হতে পারে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন কেউ তাঁকে সামনে রেখেছেন। হুন্ডির মাধ্যমে এই অর্থ পাচার হতে পারে। স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমেও অর্থ বাইরে নেওয়া হতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চাইলে এসব অর্থের উৎস খতিয়ে দেখতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সেই দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে এটা বের করতে পারে।