# সংঘবদ্ধ চক্রে জড়িত স্থানীয় সাংবাদিকও
# খাটিয়েছেন হাছান মাহমুদের প্রভাব, অভ্যাস বদলায়নি এখনো
# গড়েছেন পাহাড় সম সম্পদ
দূর্নীতির উর্বর ভুমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া। এর মধ্যে অন্যতম ভুমি জালিয়াতি। যা ঘিরে রয়েছে সংঘবদ্ধ একাধিক দালাল চক্র। উপজেলা ভুমি অফিস থেকে রেজিষ্টার অফিস সবখানে তৎপর সংঘবদ্ধ এই চক্র। যাদের সাথে জড়িত রাঙ্গুনিয়া প্রেস ক্লাবের পেশাদার নামধারী সাংবাদিকরাও।
যারা রাঙ্গুনিয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের প্রভাব খাটাতেন সবসময়। সংঘবদ্ধ এই চক্রের মূল হোতা পোমরা গোচরা এলাকায় চিপাগলির মধ্যে অবস্থিত ভুমি রেজিষ্টার অফিসের দলিল লেখক জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম মুনসি।
জালিয়াতির কাজ নির্বিঘ্ন করতে হাছান মাহমুদের আশির্বাদ নিয়ে বিগত ১৫ বছর আঁকড়ে রেখেছেন দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদ। এখনো বহাল আছেন সে পদে। ভাগিয়েছেন রাঙ্গুনিয়া পোমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদও। আছেন রাঙ্গুনিয়া থানা আওয়ামী লীগের সদস্য পদেও। আবার মোটর চালক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সহ-সম্পাদক পদেও আছেন তিনি।
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাছান মাহমুদ দেশ ছেড়ে পালালেও রয়ে গেছেন ভুমি জালিয়াতির হোতা জসিম মুনসি। বুক চেতিয়ে চলছেন জালিয়াত চক্রের এই হোতা।
স্থানীয়রা জানান, জসিম মুনসি আগের মতোই ভুমি রেজিষ্টার অফিসে এসে দলিল রেজিষ্টারের কাজ করছেন। আগের মতোই করছেন নানারকম জালিয়াতি। বিগত ১৫ বছরের অভ্যাস তিনি একটুও বদলাননি। অভিযোগের সত্যতা মিলেছে একাধিক ভুমি রেজিষ্টার কাজের দলিলেও।
এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ৬৭৭ নং খতিয়ানের ২০৮৯ নং দানপত্র দলিলে উঠে আসে জালিয়াতির বিষয়টি। দলিল বিশ্লেষণে দেখা যায়, আরএস ৬১২নং খতিয়ানের ৬০৪৭/৬০৬৭/৬০৭৩/৬০৮৩ দাগাদি ও বিএস ৫৯৪ নং খতিয়ানের ৬৩৪৯/৬৩৪৫/৬৩৭৪/৬৩৯০ মোট ৪০ শতক হাই শ্রেণির জমিকে নাল দেখিয়ে রেজিষ্টার কাজ সম্পন্ন করেছেন। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে জমির মূল্য কম দেখিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া।
আবার সরকারি উৎসে কর ফাঁকি দিতে তিনি এই জমির দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সরকারি রাজস্ব ১% হিসেবে ৪৮,৯০০ টাকা। ৩% হিসেবে ১,৪৫,৯২০ টাকা, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এবং অবশিষ্ট হিসেবে ৭২,৮৬০ টাকা সোনালী ব্যাংক ও এন আর বি সি ব্যাংক রাঙ্গুনিয়া শাখায় জমা করেছেন। কিন্তু জমির শ্রেণি অনুসারে সরকারি নিয়মানুযায়ী মোট মূল্যের ১১.৫০% রাজস্ব খাতে জমা করার শর্ত রয়েছে। ফলে এই জালিয়াতির মাধ্যমে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
পোমরা হাজীপাড়া এলাকার মরহুম আবু মোহাম্মদ চৌধুরীর ছেলে ছৈয়দুল আলমকে দানপত্র দলিল দাতা দেখানো হয়েছে। দলিল গ্রহিতা দেখানো হয়েছে একই এলাকার মরহুম খলিলুর রহমানের ছেলে সৌদি প্রবাসী নজরুল ইসলাম ওরফে লেদুকে। অভিযোগ উঠেছে, এই জালিয়াতি কাজে ছৈয়দুল আলমকে দলিলে প্রদর্শিত ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও তার কানাকড়িও পরিশোধ করা হয়নি। বরং এই অর্থ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন দলিল লেখক জসিম মুনসি।
শুধু এই জালিয়াতি নয়, শ্রেণি পরিবর্তনসহ নানা জালিয়াতির মাধ্যমে জসিম মুনসির লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এমন একাধিক দলিল সংরক্ষিত রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জালিয়াত চক্র এসব টাকার ১০% সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের জন্য পাঠাতেন। হাছান মাহমুদ পালিয়ে যাওয়ায় জালিয়াতির পুরো টাকা এখন জসিম মুনসির পকেটে ঢুকছে। তার এসব অপকর্ম ফাঁস না করতে দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত সংবাদকর্মীদেরও পৃষ্টপোষকতা করেন তিনি। এভাবে বিগত সময়ে তিনি গড়েছেন পাহাড় সম সম্পদ।
বিশ্বস্ত সূত্রগুলোর তথ্যমতে, রাঙ্গুনিয়ার পোমরায় জসিম মুনসির রয়েছে দ্বিতল বিশিষ্ট বিশাল বাড়ি। যার মূল্য বর্তমান বাজারে কোটি টাকার উপরে। চট্টগ্রাম শহরেও রয়েছে কোটি টাকার ফ্ল্যাট বাড়ি। কিনেছেন বিপুল জমিও। হাতে আছে লাখ টাকা দামের একাধিক মোবাইল ও ল্যাপটপ। রাঙ্গুনিয়া ও নগরীর বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে নিজ ও স্ত্রীর নামে ছাড়াও বিভিন্ন নামে-বেনামে আছে একাধিক হিসাব। যেখানে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
সম্প্রতি এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জসিম মুনসি মুঠোফোনে বলেন, ভুমি রেজিষ্টার না করলে তো সরকার রাজস্ব পাবে না। যেভাবেই করি সরকারকে রাজস্ব দিয়েই তো করছি। জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, কোনটা, কোন এলাকার, খতিয়ান নং কত? দাগ নং কত? এভাবে প্রশ্ন রেখে বিভ্রান্তির চেষ্টা করেন তিনি।
এক পর্যায়ে আরেক সহকর্মী ফোন দিয়ে জানতে চাইলে তিনি তাকে বসে কথা বলার অপার করেন। পরে তিনি নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় এসে বসেন। এ সময় নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি জালিয়াতি ও রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি ভিন্নভাবে বুঝানোর চেস্টা করেন। প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পেরে তিনি বলেন, আসলে এ কাজে আমি তেমন টাকা নিইনি। তবে দলিল গ্রহীতা সৌদি প্রবাসী নজরুল ইসলাম একসময় আমার বড় উপকার করেছেন তাই কাজটা করে দিয়েছি।
কি রকম জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে আমি হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা খাওয়া নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিলাম। এ সময় তিনি আমরা ৪৬জন হাজীকে খাওয়াইছিলেন। সেটার গুণ শোধ করেছি। আরেক প্রশ্নের জবাবে জসিম মুনসি বলেন, হাছান মাহমুদ আমার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চেয়েছিল। না দেওয়ায় তিনি আমাকে অনেকভাবে নির্যাতন করেছে।
সাংবাদিকদের চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, দুই গ্রুপ এসে বিভিন্ন সময় চাঁদা নিত। এর মধ্যে একটি গ্রুপ হচ্ছে প্রথম আলো, যুগান্তর ও চট্টগ্রাম মঞ্চ প্রতিনিধি আব্বাস হোসাইন আফতাব, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী, দৈনিক কালবেলা ও সি-প্লাস টিভির প্রতিনিধি জগলুল হুদা, দৈনিক সমকাল ও দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিনিধি মাসুদ নাসির। যারা বাসস, চট্টগ্রামের ষ্টাফ রিপোর্টার ও পূর্বকোণের রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জিগারুল ইসলাম জিগারের নেতৃত্বে এসব অপকর্ম করত। এ কারণে ৫ আগস্টের পর ক্ষিপ্ত জনতা এদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেছে।
আরেক গ্রুপ চাঁদা নেয় দৈনিক নয়াদিগন্ত ও সুপ্রভাত বাংলাদেশের প্রতিনিধি শান্তিরঞ্জন চাকমার নেতৃত্বে। যারা বর্তমানে পেশাদার নামধারী রাঙ্গুনিয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি-সেক্রেটারি পদে আছেন। ওরা ড. হাছান মাহমুদের একনিষ্ট লোক। এদের চাঁদা না দিলে তো বুঝেন, আমরা কাজই করতে পারব না।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে পেশাদার রাঙ্গুনিয়া প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, এসবের সাথে আমি নাই। এসব করে ফ্যাসিস্ট জিগার, মাসুদ নাসির, আব্বাস। এসব কারণে এরা এখন আস্তুাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এদের নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
সংঘবদ্ধ চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম মুনসি বলেন, এখানে যত খারাপ কাজ করত আকতারের ছেলে আহাদ, শফিক, কাঞ্চন, সোলায়মান, কাউছার এরাই। এরা হাছান মাহমুদের লোক। এদের নির্দেশে আমাদের সব করতে হয়েছে। আমরা নিরুপায়।
আরও এক প্রশ্নের জবাবে জসিম মুনসি বলেন, অনিয়ম-কারসাজি যা হয়েছে ভুমি রেজিষ্টার ও কর্মকর্তাদের সাথে কন্ট্রাক্ট চুক্তিতে হয়েছে। যা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে জেনে-শুনে ভুমি রেজিষ্টার করে দিতেন রেজিষ্টাররা ও সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ের সত্যতা জানতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ভুমি রেজিষ্টার মিরাজ সৌরভের মুঠোফোনে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। রেজিষ্টার অফিসের সহকারি দিদারের সাথে যোগাযাগ করা হলে তিনি বলেন, এ রকম জালিয়াতি সম্পর্কে আমি অবগত নই। কারণ আমি পোমরা রেজিষ্টার অফিসে যোগ দিয়েছি মাত্র তিন মাস আগে। ভুক্তভোগী কেউ জালিয়াতির অভিযোগ করলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
You cannot copy content of this page