রাজা মিয়া ওরফে রাজা ও শিল্পী আক্তার ওরফে শিল্পী দু‘জনেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহর ২নং গেইট রেলক্রসিংয়ের গেইটকীপার। সরকারি চাকুরি বিধিমালা লঙ্ঘন করে রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে এই রেলক্রসিংয়ে কর্মরত আছেন তারা। এ জন্য তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পান রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আর এই টাকা আসে ষোলষহর দুই নম্বও গেইট রেলক্রসিংয়ে অবৈধ দোকান বাণিজ্য থেকে। এই টাকায় চলে রাজা-শিল্পীর সংসার। শুধু তাই নয়, চালায় ভাই-বোনের সংসারও। দীর্ঘ দুই বছর ধরে বেতন না পেলেও শিল্পীকে ছুতে পারেনি কোন অভাব। ফলে বেতন নিয়ে তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই শিল্পীর।
আবার রাজা-শিল্পীর মধ্যে রয়েছে বেশ সখ্যতাও। কারণ দুই নম্বর গেইট রেলক্রসিংয়ের দোকান বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পীর শখের রাজা মিয়া। আর রাজা মিয়ার রাজ্যের রানী যেন শিল্পী। সরেজমিনে কথা বলার সময় দু‘জনের মধ্যে দেখা গেছে সেই মনোভাব। রাজার জন্য মরিয়া যেন শিল্পী, আবার শিল্পীর জন্য মরিয়া রাজাও। যার ভিডিও রেকর্ড রয়েছে এই প্রতিবেদকের হাতে।
মঙ্গলবার (১৫ এপৃল) দুপুরে শিল্পীর কাছে দোকান বাণিজ্যের বিষয়ে কথা বলতেই ছ্যাঁৎ করে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন গেইটকীপার রাজা মিয়া। তিনি বলেন, আমরা দোকান বসাই বা টাকা নিই, আপনারা কে বলার। সাংবাদিক হোন আর যাই হোন এ নিয়ে চার্জ করার আপনারা কে?। চলেন, যা বলবেন আমার স্টেশন মাস্টারকে বলবেন-এ কথা বলে জোর করে নিয়ে যান তারা।
পরে ষোলশহর স্টেশন মাস্টার আরিফুল ইসলামের কাছে গেলে পরিচয় জানার পর তিনি গেইটকীপার রাজা ও শিল্পীকে ভর্ৎসনা করে বলেন, আপনারা সাংবাদিকদের সাথে এভাবে খারাপ আচরণ করছেন কেন? ওনারা যা জানতে চাইছেন তা সুন্দর করে বলেন। এরপরও ঔদ্বত্যপূর্ণ আচরণ করেন রাজা ও শিল্পী। তবে স্টেশন মাস্টার আরিফুল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে আশ্বস্ত করে বলেন, আপনারা মনে কষ্ট নিবেন না, ওদের বিষয়ে আমি ব্যবস্থা নেব, কথা দিচ্ছি আমি।
স্টেশন মাস্টারের ধমক খেয়ে শিল্পী আক্তার হতবিহ্বল হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রাজার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকেন। এমনকি রাজাকে রক্ষা করতে এই প্রতিবেদকের হাত ধরে ক্ষমা চাওয়া শুরু করেন। তার কাকুতি-মিনতি দেখে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে উপস্থিত অনেকেই হতবাক। যাদের কেউ কেউ মুচকি হেসে বলেন, এরা একজনকে ছাড়া আরেকজন বাচবে না।
এর নেপথ্যে কারণ মিলেছে-রাজা-শিল্পীর পরকীয়া-মধুলীলা। কর্মচারীদের ভাষ্য, বরিশালের মেয়ে শিল্পী স্বামী পরিত্যক্তা। রাজা মিয়ার সাথে অবৈধ রঙ্গলীলার কারণে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। স্বামী শিল্পীকে ছাড়লেও রাজাকে ছাড়েনি। শিল্পী রেলওয়ের গেইটকীপার হিসেবে চাকরি করলেও বেতন পায় না দুই বছর ধরে। তারপরও তার টাকার অভাব নেই। ষোলশহর দুই নম্বর গেইট রেলক্রসিংই তার টাকার খনি।
অপরদিকে রাজা মিয়া নোয়াখালী সেনবাগের ছেলে। পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের ঝাউতলা এলাকায় থাকে। সরকারি বরাদ্দ পাওয়া ঘরের পাশে অবৈধ ভাড়াঘর তুলে প্রতিমাসে ৬০-৭০ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করে রাজা মিয়া। একদিকে ভাড়া ঘর বাণিজ্য, অন্যদিকে ষোলশহর দুই গেইট রেলক্রসিংয়ে দোকান ভাড়া বাণিজ্য। যেখান থেকে প্রতিমাসে আয় দুই লাখ টাকার উপরে।
মোল্লা নামে একজন দোকানদার বলেন, এই রেলক্রসিংয়ে অন্তত দুই শতাধিক অবৈধ দোকান বসিয়েছে রাজা ও শিল্পী। যেগুলোর প্রতিটি থেকে দৈনিক ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, আবার কোন কোন দোকান থেকে এক হাজার টাকা ভাড়া তুলে। আর এই ভাড়া বাণিজ্য করতে গিয়ে গত ১৫ বছর নিজেকে ছাত্রলীগের ক্যাডার হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন রাজা মিয়া।
আর এসব টাকার ভাগ ষোলশহর স্টেশন মাস্টার, আরএনবি, জিআরপি ও বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কাছেও যায়। এদের প্রত্যেকে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ভাগ পায়। ফলে রাজা-শিল্পীর সকল অপকর্ম জেনেও তারা নিরবতা পালন করে আসছে।
দোকানদাররা জানান, রাজা ও শিল্পী এই রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে কর্মরত। তাদের অসামাজিক কর্মকান্ডের কথা এখানকার সবাই জানে। রেলওয়ের ষোলশহর স্টেশন মাস্টার ও আরএনবির লোকেরাও এসব জানে। তবে তারা এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ রাজা ও শিল্পী স্টেশন মাস্টার আরএনবি ও জিআরপির লোকদের প্রতিদিন টাকা দেয়। যা আমাদের দোকানদারদের কাছ থেকে আদায় করে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজা ও শিল্পী দু‘জনেই রাতের ডিউটিতে গেইট ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে মধুলীলায় মত্ত থাকে। ফলে ট্রেনের হুইসেল পড়লেও অনেক সময় এদের হুশ থাকে না। দরজা-জানালায় কানপাতলে শুনা যেত হা-হু শব্দ। এই সময় গেইটের ব্যারিয়ার ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে ট্রেন।
এ নিয়ে কথা বলায় অন্য গেইটকীপারের ওপর নেমে আসে রাজা-শিল্পীর নির্যাতন। ফলে এই রেলক্রসিংয়ে বেশি দিন ঠিকতে পারে না অন্য গেইটকীপাররা। সম্প্রতি এমন একজন গেইটকীপার বদলি হয়েছেন এই রেলক্রসিং থেকে। আর এসেছেন আজাদ নামে একজন গেইটকীপার।
জানতে চাইলে আজাদ বলেন, বদলি হয়ে আমি এসেছি মাত্র ১৮ দিন হল (১৫ এপৃল পর্যন্ত)। এদের বিষয়ে আমি তেমন কিছুই জানি না। তবে রেলক্রসিংয়ের চারপাশ ঘিরে যেভাবে দোকানপাট বসেছে তাতে ক্রসিং ব্যারিয়ার পর্যন্ত ফেলা মুশকিল হয়ে পড়ে। দোকানদারগুলোকে নিরাপত্তার জন্য মাল সরিয়ে নিতে বলায়, তারা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। তারা বলেছে, এখানে তোর কাম কি? রাজা-শিল্পী আছে। তুই সর এখান থেকে-এমন ধমক দিয়েছে।
প্রশ্নের জবাবে আজাদ আরও বলেন, এখানে রেল লাইন ঘেষে বসেছে দোকান। এমনকি প্রায়ই সময় দোকানের মাল রেখে গেইট ঘরের দরজার মূখ পর্যন্ত বন্ধ করে ফেলে এরা। বিকেল ৫টার পর রেললাইনের উপর মাছের বাজার বসে। এদেরকে কিছুই বলা যায় না। কারণ আমাদের লোক এসবের সাথে জড়িত। এদের সাথে রাজনৈতিক কিছু নেতাকর্মীও জড়িত। যারা নিজেদের সুবিধার জন্য আমাদের লোকজনকেও সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আজাদ বলেন, এখানে আমরা ৫ জন গেইটকীপার কর্মরত আছি। আমি ছাড়া অন্যরা হচ্ছে, রাজা মিয়া, শিল্পী, সালাউদ্দিন ও সুমন। এদের মধ্যে রাজা ও শিল্পী সবচেয়ে পুরণো। এরা নাকি একই ব্যাচেরও। পোস্টিং নিয়েছে এই রেলক্রসিংয়ে একই সাথে। বাকি দু‘জন আছে তিন বছরেরও কম সময় ধরে। এদের মধ্যে একজন বর্তমানে বৈশাখীর ছুটিতে আছেন।
এ অবস্থায় আমি নতুন এসেও সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একা ডিউটিতে আছি। আরেকজন রাত ১টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটিতে থাকেন। আর বিকেল ৪টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ডিউটি নেন শুধুমাত্র রাজা ও শিল্পী। শুনেছি তারা নাকি এক সাথে ডিউটি করে। একজনকে ছাড়া আরেকজন ডিউটি করে না। তাদের বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপের কথা শুনলেও আমি এমন কিছু এখনো দেখিনি। কারণ তাদের ডিউটির সময়ে আমি থাকি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জান আলী হাট স্টেশনের মাস্টার নেজাম উদ্দিন বলেন, আমার বাসা তো ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায়। ওই রেলক্রসিংয়ে গেইটকীপার যারা আছেন, তাদের একজন বা দু‘জন না, সবাই দোকান বসিয়ে টাকা নেন। এতে পুরো রেলক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই দোকান সরানোর জন্য আমিও এদের কয়েকবার বলেছি। কিন্তু এরা কাউকে পরোয়া করে না। ষোলশহর দুই নম্বর গেইট রেলক্রসিং তাদের জন্য টাকার খনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ষোলশহর স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, গেইটকীপার শিল্পী তো, দুই-আড়াই বছর ধরে বেতন পান না। তার এনআইডির সমস্যা আছে। বেতন ছাড়া তার সংসার চলে কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দোকান আর ভাড়াঘর বাণিজ্য তো আছেই। আর বাকিটা মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, অবৈধ দোকান বাণিজ্যের কারণে রেলওয়ের ষোলশহর স্টেশন মাস্টার জয়নাল বদলি হয়েছেন। এর পেছনে রাজা ও শিল্পীরাও দায়ী ছিল। তবে বর্তমানে যিনি এসেছেন ওনাকে ভাল মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কারণ ওনি স্টেশনে যোগ দেয়ার পর প্রায় প্রতিদিন এই রেলক্রসিং পরিদর্শন করেছেন। ক্রসিং থেকে সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কথা বলেছেন।
এ বিষয়ে জানতে ষোলশহর দুই নম্বর গেইট রেলক্রসিংয়ে গিয়ে যোগাযোগ করা হয় শিল্পীর সাথে। তিনি বলেন, আমি কোন দোকান বসায়নি। কোন দোকান থেকে আমি টাকাও নিই না। সরকার আমাকে বেতন দেই, কেন আমি দোকান বসিয়ে টাকা নেব। আপনাদেরকে যে বলেছে সব মিথ্যা বলেছে।
আর এ কথা বলতে না বলতেই চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন রাজা মিয়া। তিনি বলেন, আমরা দোকান বসাই বা টাকা নিই, আপনারা কে বলার। সাংবাদিক হোন আর যাই হোন এ নিয়ে চার্জ করার আপনারা কে?। চলেন, যা বলবেন আমার স্টেশন মাস্টারকে বলবেন-এ কথা বলে জোর করে নিয়ে যান তারা।
পরে ষোলশহর স্টেশন মাস্টার আরিফুল ইসলামের কাছে গেলে পরিচয় জানার পর তিনি গেইটকীপার রাজা ও শিল্পীকে ভর্ৎসনা করে বলেন, আপনারা সাংবাদিকদের সাথে এভাবে খারাপ আচরণ করছেন কেন? ওনারা যা জানতে চাইছেন তা সুন্দর করে বলেন। এরপরও ঔদ্বত্যপূর্ণ আচরণ করেন রাজা ও শিল্পী। তবে স্টেশন মাস্টার আরিফুল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে আশ্বস্ত করে বলেন, আপনারা মনে কষ্ট নিবেন না, ওদের বিষয়ে আমি ব্যবস্থা নেব, কথা দিচ্ছি আমি।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিটিও আনিসুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও কল রিসিভ করেননি তিনি। হোয়্যাটসঅ্যাপ অপশনে মেসেজ পাঠালেও কোনরকম সাড়া দেননি।
You cannot copy content of this page