সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধকর্মে চট্টগ্রামের আলোচিত যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক, চট্টগ্রাম মহানগরীর সবাই জানে এটা। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে খুঁজে পেলেন মাত্র পৌনে ২ কোটি টাকার সম্পদ।
এছাড়া তার স্ত্রীর নামে রাখা সম্পদও খুঁজে পেয়েছে মাত্র আড়াই কোটি টাকার। এরপরও জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে দুদক। এর মধ্যে একটি মামলাঢ তার স্ত্রী জেসমনি আক্তারকেও আসামি করা হয়েছে।
বুধবার (২০ আগস্ট) দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নওশাদ আলী মামলা দুটি করেছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুবেল আহমেদ। তিনি জানান, একটি মামলায় বাবরের বিরুদ্ধে ৮৮ লাখ ৮৭ হাজার ৩৬০ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স¤পদ অর্জন এবং ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ৩৯০ টাকার স¤পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরেক মামলায় তার স্ত্রী জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৯ হাজার ৮৮০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স¤পদ অর্জন ও ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৮০ টাকা স¤পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দির সড়কের বাসিন্দা হেলাল আকবর চৌধুরী দুদকে জমা দেওয়া স¤পদ বিবরণীতে তার ১ কোটি ৭৭ লাখ ৪৪ হাজার ২৪০ টাকার স¤পদের তথ্য উল্লেখ করেছিলেন। এর মধ্যে ৯ লাখ ৯ হাজার ২৫০ টাকার স্থাবর এবং ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯০ টাকার অস্থাবর স¤পদ।
দুদক এর ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে বাবরের ২ কোটি ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬৩০ টাকার স¤পদের তথ্য পায়। এর মধ্যে ৩৯ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪০ টাকার স্থাবর এবং ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯০ টাকার অস্থাবর স¤পদ। এ হিসেবে বাবর তার বিবরণীতে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ৩৯০ টাকার স¤পদের তথ্য গোপন করেন বলে মামলা এজাহারে উল্লেখ আছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর তার আয়কর নথিতে ২০১২-১৩ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ২৭০ টাকা। পারিবারিক ব্যয় দেখিয়েছেন ২১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। তাহলে ব্যয়সহ তার স্থাবর-অস্থাবর মোট স¤পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৩০ লাখ ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা।
এর মধ্যে দুদক যাচাই-বাছাই করে তার গ্রহণযোগ্য আয় পেয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ২৭০ টাকা। কারণ তিনি ৬২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪৮ টাকা আয়ের সপক্ষে কোনো উৎস বা প্রমাণপত্র আয়কর নথিতে দেখাতে পারেননি।
এ হিসেবে বাবরের স্থাবর-অস্থাবর স¤পদের পরিমাণ তার গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে ৮৮ লাখ ৮৭ হাজার ৩৬০ টাকা বেশি, যা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স¤পদ হিসেবে উল্লেখ করে দুদক মামলা করেছে।
অন্যদিকে দুদকের কাছে দেওয়া বিবরণীতে বাবরের স্ত্রী জেসমিন আক্তার ২ কোটি ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪২০ টাকার স¤পদের তথ্য দেন। এর মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৪২০ টাকার স্থাবর এবং ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার অস্থাবর স¤পদ।
তবে দুদক অনুসন্ধান করে জেসমিনের মোট স¤পদ পেয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকার। এর মধ্যে স্থাবর স¤পদের পরিমাণ ২ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৪২০ টাকা এবং অস্থাবর স¤পদের পরিমাণ ৪০ লাখ ১০ হাজার ৫৮০ টাকা।
প্রদর্শিত স¤পদের পরিমাণ দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া স¤পদের চেয়ে ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৮০ টাকার কম, যা জেসমিন গোপন করেছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া জেসমিন আক্তারের আয়কর নথিতে ২০২০ থেকে ২০২২ করবর্ষ পর্যন্ত ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫০০ টাকা আয়ের তথ্য উল্লেখ আছে। কিন্তু ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮০ টাকা আয়ের কোনো উৎস বা প্রমাণ তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। এ হিসেবে দুদক তার বৈধ আয় পেয়েছে ৮৬ লাখ ৪৫ হাজার ১২০ টাকা।
আবার আয়কর নথিতে তিনি পারিবারিক ব্যয় উল্লেখ করেছেন ১৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা। তাহলে ব্যয়সহ স¤পদের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ কোটি ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকার। এর থেকে বৈধ স¤পদের পরিমাণ ৮৬ লাখ ৪৫ হাজার ১২০ টাকা বাদ গেলে তার জ্ঞাত আয়বর্হিভূত স¤পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮৩ লাখ ৯ হাজার ৮৮০ টাকার বলে এজাহারে উল্লেখ আছে।
আর জেসমিন আক্তারকে এ পরিমাণ অবৈধ স¤পদ অর্জনে সহযোগিতা করায় তার স্বামী হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরকেও এ মামলায় আসামি করেছে দুদক
শতকোটির মালিক বাবর
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অলিখিত সম্রাট ছিলেন চট্টগ্রামের যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। দরপত্র, ইজারা, দখল-বাণিজ্য সবই চলতো তার হাতের ইশারায়। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আশীর্বাদের হাত মাথায় সব কাজ ছিল দুধভাত। কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইতে গড়েছেন সাম্রাজ্য। আওয়ামী সরকারের পতনের পর সেইফ এক্সিট নিয়েছেন সেখানেই।
হেলাল আকবর বাবরের সঙ্গে বছর তিনেক আগেও ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক ছিল এমন অন্তত ৩ জনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, বাবর রেলওয়ে থেকেই যে টাকা আয় করেছে অঙ্কে তা শতকোটি ছাড়াবে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার বাড়ি-ফ্ল্যাট ও অভিজাত হোটেল রয়েছে। এক ছেলে পড়ালেখা করে লন্ডনে। এছাড়া নামিদামি ব্র্যান্ডের একাধিক গাড়িও ছিল বাবরের।
বাবরের নাটকীয় উত্থান
চট্টগ্রাম মহানগরের ওমরগণি এমইএস কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেই বাবরের উত্থান। সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আশীর্বাদের হাত মাথায় পড়ে বাবরের। তিনি চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে হেলাল আকবর বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। ওই সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় র্যাবের হাতে গ্রেফতার ও ক্রসফায়ার এড়াতে বাবর পাড়ি জমান থাইল্যান্ড। সেখানে গড়ে তোলেন হোটেল ব্যবসা। সাথে অনুসারিদের দিয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে করতেন চাঁদাবাজি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছর পর আবারও দেশে ফেরেন তিনি। একপর্যায়ে থাইল্যান্ডের ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেশে ব্যবসা শুরু করেন। শুরু করেন বেনামে ঠিকাদারি। ২০১১ সালে জেল থেকে বের হয়ে ব্যাংককের আদালতের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পাস নিয়ে পাড়ি জমান দুবাই। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেশে ফেরেন ২০১২ সালে। এরপর প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ বাগিয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
সিআরবিতে সংঘটিত জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িয়ে গ্রেফতার হলে যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে জামিনে বেরিয়ে ২০১৮ সালে ফের দুবাই পালিয়ে যান। এরপর ২০২১ সালে দেশে ফিরেই ফের রেলওয়েকেন্দ্রিক টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর নগরের কোতোয়ালী থানার নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দির সড়ক এলাকার মৃত জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর ছেলে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপ-অর্থ স¤পাদক তিনি।
জুলাই আন্দোলনে অস্ত্র সরবরাহ
কোটা সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রাম মহানগরের মুরাদপুরে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তিন জন প্রাণ হারান। বাবরের সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়েই চট্টগ্রামের মুরাদপুর ও চান্দগাঁও এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালানো হয় সেদিন।
জুলাই আন্দোলনে অস্ত্রবাজির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় এবং আদালতে এক ডজনেরও বেশি মামলা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।
You cannot copy content of this page