মঙ্গলবার- ১৫ জুলাই, ২০২৫

সবার সামনে চসিকের সাবেক মেয়র এম মনজুরের মুখোশ!

সবার সামনে চসিকের সাবেক মেয়র এম মনজুরের মুখোশ!

# শেখ রাসেল স্টেডিয়ামের আড়ালে দখল সাম্রাজ্য
# গুড়িয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন
# সরকারের খাতায় ফিরল ৩২০ কোটি টাকার জমি

ট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর হালিশহর থেকে উত্তর কাট্টলীর বাংলাবাজার পর্যন্ত সাগর উপকূলে গড়ে তোলা হয়েছিল শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। যা বাইরে থেকে মনে হতো শিশুদের ক্রীড়া বিকাশে একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু ভিতরের চিত্র ছিল স¤পূর্ণ ভিন্ন।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় ৪০ একর সরকারি খাস জমি দখল করে এই অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মোস্তফা হাকিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মনজুর আলম।

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হোসনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে শেখ রাসেল স্টেডিয়ামের আড়ালে গড়ে তোলা হয় এই অবৈধ সাম্রাজ্য।

এর আগে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তখন চট্টগ্রামবাসী মনে করতেন তিনি বিএনপি নেতা। জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন তখন। কিন্তু ২০১৫ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপি ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি।

তখন পল্টি মেরে ঘোষণা দেন বিএনপির রাজনীতি কখনো করেননি তিনি। এমনকি সমর্থকও ছিলেন না। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি তিনবার কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন থেকে চট্টগ্রামের প্রয়াত রাজনীতিবিদ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীর আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন তিনি। এখন আওয়ামী লীগের ঘরের ছেলে ফের ঘরে ফিরছেন।

এভাবে একই অঙ্গে নানা রূপ দেখিয়ে তিনি নানাভাবে ফায়দা লুটলেও প্রকৃতির নির্মম পরিহাস হিসেবে সবার সামনে চলে আসে তাঁর সেই মুখোশ। যিনি শুধু পল্টিবাজ রাজনীতিক নয়, একজন দখলবাজ নেতা হিসেবেও এখন সবার সামনে। যা ছলে-বলে কৌশলে প্রভাব খাটিয়ে এতদিন জনসমক্ষ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন নিজের নানা অপকর্ম।

এসব অপকর্মের অন্যতম একটি ছিল শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামের সঙ্গে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের একটি কাভার্ডভ্যান ও স্কেভেটর ইয়ার্ডও বানিয়েছেন বহুরূপি এম মনজুর আলম। স্টেডিয়ামের অপর পাশে প্রায় পৌনে তিন একর জায়গা ভরাট করে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছিল কোটি কোটি টাকা।

আর এই জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সমন্বিত টিম। অভিযানের প্রথম দিনেই রোববার (১৩ জুলাই) গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় স্টেডিয়ামসহ সংলগ্ন কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, স্কেভেটর ইয়ার্ড ও চীনা কো¤পানিকে ভাড়া দেওয়া স্থাপনাসমূহ।

সোমবার (১৪ জুলাই) বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ। তিনি বলেন, মিনি স্টেডিয়ামের পুরোটাই পাউবোর নিয়ন্ত্রণাধীন ৪০ একর সরকারি খাস জমির উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩২০ কোটি টাকা। অভিযানে আমরা সবগুলো স্থাপনা পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিয়েছি। তবে সেখানে যেসব সরঞ্জামাদি ছিল সেগুলোর কোনো ক্ষতি করিনি আমরা।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হুছাইন মুহাম্মদ, পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিস্তা করিম, জেলা প্রশাসনের মো. মঈনুল হাসান। হুছাইন মুহাম্মদ জানান, অভিযানের প্রথমদিনে রোববার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১৫ একর জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পেরেছি। সোমবার দ্বিতীয় দিনেও ১২ একরের মতো উদ্ধার করেছি। পুরো ৪০ একর জমি উদ্ধারে হয়তো ১৫ জুলাই পর্যন্ত অভিযান চালাতে হবে।

এরপর উদ্ধার করা জমিতে সীমানা চিহ্নিত করে কাঁটাতারের বেড়া ও বনায়নের মাধ্যমে সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে এই উচ্ছেদ কেবল অবৈধ স্থাপনার নয়, এটি এক দীর্ঘদিনের নীরব দখলচক্রের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সরাসরি আঘাত। যে চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল রাজনীতির সর্বোচ্চ করিডোরে।

যেভাবে গড়ে তোলা হয় দখল সাম্রাজ্য
২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর কাট্টলীতে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে যাত্রা শুরু করে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩৩০ ফুট ও প্রস্থ ২০০ ফুট। হোসনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে নির্মিত এই স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, মোস্তফা হাকিম গ্রুপ ও ট্রাস্টের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং মনজুর আলমের নাতি নাবিদ আব্দুল্লাহ মনজুর আলম।

অনুষ্ঠানে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম বলেছিলেন, আমি এবং আমার পরিবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একটি পরিবার। জাতির জনক, বঙ্গমাতা ও শেখ রাসেলের আত্নার মাগফিরাতের জন্য আমাদের নানা কর্মসূচি থাকে। আমরা চাই শেখ রাসেল বেঁচে থাকুক তরুণ প্রজন্মের মাঝে। এজন্য এই স্টেডিয়ামের নাম দিয়েছি শেখ রাসেলের নামে। শুরুতে এমন সব আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও বাস্তবে সেটি হয়ে উঠেছিল মোস্তফা হাকিম পরিবারের দখল সাম্রাজ্যের বৈধতার মুখোশ।

আর এ কাজে সহযোগীতা করেন মনজুরের ভাতিজা সাবেক সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। তিনি চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড, উত্তর কাট্টলী) থেকে দুইবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মিনি স্টেডিয়ামের সঙ্গে প্রায় সাত একর সরকারি খাসজমিতে যেসব বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তুলেছিলেন দিদারুল আলম।

এছাড়াও ৩০ একরের বেশি খাসজমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন সাবেক প্যানেল মেয়র নিছার উদ্দিন আহমেদ, সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসেমসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। এসব জমি ধাপে ধাপে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম।

রাজনীতির মুখোশ খুলে যেভাবে
২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হন মনজুর আলম। তখন থেকে চট্টগ্রামবাসী তাঁকে বিএনপি নেতা হিসেবে জানতেন। জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন তখন। এর আগে তাঁকে তেমন একটা চিনতেন না কেউ। কিন্তু ২০১৫ সালে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপি ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি।

পল্টি মেরে তখন ঘোষণা দেন, তিনি কখনোই বিএনপির রাজনীতি করেননি। এমনকি সমর্থিতও ছিলেন না। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি তিনবার কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন থেকে চট্টগ্রামের প্রয়াত রাজনীতিবিদ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীর আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন তিনি। এখন আওয়ামী লীগের ঘরের ছেলে ফের ঘরে ফিরছেন।

তবে পল্টিবাজির কারণে আওয়ামী লীগের ঘরেও তেমন কদর মেলেনি তাঁর। পরবর্তি মেয়র নির্বাচনে একাধিকবার এবং সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি মনোনয়ন। কিন্তু রাজনীতিক পরিচয়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি নানা ফায়দা লুটেছেন। আর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন এম মনজুর আলম।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের অফিসে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সেখানে উপস্থিত না থাকায় কোনরকম বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি অফিসে আসেন না।

ঈশান/মখ/মসু

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page