
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলীর পদ পেতে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি করার অভিযোগ উঠেছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে চট্টগ্রাম জুড়ে।
জানা গেছে, প্রধান প্রকৌশলী হতে কাজী হাসান বিন শামস উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করলেও সেখানে জালিয়াতি ও অসত্য তথ্য উপস্থাপনের অভিযোগ উঠেছে। রিটে জমা দেওয়া আবেদনপত্র, কর্মজীবন, মামলার তথ্যসহ নানা বিষয়ে অসংগতি ও প্রতারণার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিডিএ।
সিডিএ সূত্র জানায়, গত ১০ নভেম্বর তিনি নিয়মিত পদোন্নতির জন্য উচ্চ আদালতের ২৪ নম্বর আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। এতে বিবাদী করা হয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অন্যান্যদের। উচ্চ আদালতে সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবর করা দুটি আবেদনপত্র সংযুক্ত করা হয়— একটি ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর; অন্যটি চলতি বছরের ১৮ মার্চ।
তবে দুই আবেদনে তিনি ২১ বছর ধরে সিডিএতে কর্মরত থাকার দাবি করেছেন। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানেও কর্মজীবনের হিসাব অপরিবর্তিত, যা স্পষ্ট অসত্য তথ্য। রিটে দেওয়া আবেদন দুটিতে উল্লেখ আছে— আবেদন জমা দেওয়ার দিনই সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সিডিএ বলছে, এসব আবেদনপত্র সত্য নয়।
গত ২৭ অক্টোবর সিডিএ চেয়ারম্যান কাজী হাসান বিন শামসকে একটি চিঠি দেন। চিঠি অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৮ মার্চের পদোন্নতি সংক্রান্ত আবেদনটি ২৭ অক্টোবর অপরাহ্নে তার কাছ থেকে সরাসরি পাওয়া যায়। আবেদন পাওয়ার পর অফিসের রেকর্ডপত্র ও ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা করা হয়, যেখানে পূর্বের পদোন্নতি সংক্রান্ত কোনো আবেদন পাওয়া যায়নি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, আবেদনপত্র গ্রহণকারীর স্বাক্ষর সিডিএ চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পত্র গ্রহণকারীর স্বাক্ষরের সঙ্গে মেলে না। চিঠিতে আরও উল্লেখ আছে যে, তার নামে দুদকের দায়ের করা পাঁচটি মামলা চলমান আছে এবং ট্রুথ কমিশনে জবানবন্দি দিয়ে তিনি আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ।
চউকের চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৯০ অনুযায়ী, প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি লাভের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেহেতু কাজী হাসান বিন শামসের মূল পদ নির্বাহী প্রকৌশলী হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না পারায় প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করার সুযোগ নেই বলেও চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন সিডিএ চেয়ারম্যান।
সিডিএ চেয়ারম্যান আরও স্পষ্ট করে জানান, কাজী হাসান বিন শামসের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ এবং প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় তার পদোন্নতি সংক্রান্ত আবেদনটি চউক কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করার আইনগত কোন সুযোগ নেই।শুধুমাত্র আদালতকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
দুদকের পাঁচটি মামলা ‘গোপন’
সিডিএর নথি অনুযায়ী, কাজী হাসান বিন শামসের বিরুদ্ধে দুদক দায়ের করা পাঁচটি মামলা এখনও চলমান। সিডিএ বলছে, এসব মামলার নিষ্পত্তি সম্পর্কে দাপ্তরিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অথচ রিট পিটিশনে এই মামলাগুলোর তথ্য আদালতকে গোপন করা হয়েছে।
২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনের মার্জনাপত্রে দেখা যায়, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) কাজী হাসান বিন শামস অক্সিজেন জংশন-কাপ্তাই রোড সংযোগ সড়ক প্রকল্পে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় নিজের ত্রুটি স্বীকার করেন। তিনি তিন লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। কমিশন তার স্বীকারোক্তিকে বিশ্বাসযোগ্য উল্লেখ করে মার্জনা দেয়।
তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিশন— সাবেক বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান, সাবেক নিয়ন্ত্রক ও অডিটর জেনারেল আসিফ আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মঞ্জুর রশিদ চৌধুরী এই মার্জনাপত্রে স্বাক্ষর করেন। ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর ট্রুথ কমিশন দোষ স্বীকারের পর দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মন্ত্রণালয়কে মামলা দায়েরের জন্য অবহিত করার নির্দেশ দেয়।
তবে ট্রুথ কমিশন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ মার্জনা করলেও তাদের দুদকের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই, যা দুদক ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নিশ্চিত করে। এছাড়া দুর্নীতির মামলায় যেসব সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে চাকুরি বিধি ও সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করার জন্য ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পরে ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মন্ত্রণালয় চার্জশীটভুক্ত আসামী সরকারি কর্মচারীদের চাকুরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার নির্দেশ প্রদান করে এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার নির্দেশ দেয়। তবে, সিডিএর ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এই শাস্তির আওতায় আসেননি। অথচ কাজী হাসান বিন শামস রিট পিটিশন করার সময় তার বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ এড়িয়ে গেছেন এবং বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
১৬ বছরে ৪৪ রিট
সিডিএ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এর আগেও কাজী হাসান বিন শামস তার পদ টিকিয়ে রাখার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে গোপন নথি সংগ্রহ করে ২০২৪ সালের ৩ মার্চ রিট পিটিশন দাখিল করেছিলেন। সূত্রের দাবি সেই রিট পিটিশন দাখিলের সময়ও তিনি অসত্য তথ্য আদালতে উপস্থাপন করেছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, কাজী হাসান বিন শামস গত ১৬ বছরে নিজের পদ ও পদবি রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে মোট ৪৪টি রিট পিটিশন দায়ের করেছেন।
যা বললেন সিডিএ চেয়ারম্যান—
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, মামলাধীন বিষয়ে সিডিএ ব্যবস্থা নিতে পারে না। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের আইন বিভাগ সরাসরি দেখছে। মামলা নিষ্পত্তি হলে সিডিএ ব্যবস্থা নিতে পারবে। তিনি আরও জানান, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে কল ও মেসেজ পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে অভিযুক্ত কাজী হাসান বিন শামসের ব্যক্তিগত ফোনে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।












































