বুধবার- ১২ মার্চ, ২০২৫

হাছান মাহমুদের কারিশমা

রাঙ্গুনিয়ায় সাংবাদিক আর নেতার ঘরে হতদরিদ্রের গভীর নলকূপ!

রাঙ্গুনিয়ায় সাংবাদিক আর নেতার ঘরে হতদরিদ্রের গভীর নলকূপ!
print news

ট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পল্লী অঞ্চলে হতদরিদ্র সাধারণ মানুষের পানি সংকট নিরসনের জন্য ২০২০-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৯৫০টি সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকুপ বরাদ্দ পায়। কিন্তু সেই সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকুপের একটিও হতদরিদ্র সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটেনি।

তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ক্ষমতাবলে এসব সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকূপ এখন শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতা, চেয়ারম্যান-মেম্বার ও তথাকথিত গুটিকয়েক সাংবাদিকের ঘরে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত এসব সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকুপ রাজনৈতিক বিবেচনায় পছন্দের লোকজনকে মালিকানা প্রদান করা হয়েছে। এ নিয়ে সর্বমহলে চলছে ব্যাপক কানাঘুষা।

তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইয়াকুব ফরহাদ। তিনি বলেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় গত ২০২০-২০২৪ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত প্রকল্পটির অধীনে ১৯৫০টি সাবমার্সিবল গভীর নলকূপ ৫টি ধাপে ভাগ করে দেয়া হয়। তার প্রেক্ষিতে প্রতি ধাপে ৩৯০টি করে সাবমার্সিবল পা¤প বিতরণের রূপরেখা প্রদান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় জনগণের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিবছর এই প্রকল্প থেকে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিতরনের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এসব সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকূপ এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, চেয়ারম্যান-মেম্বার ও তথাকথিত গুটিকয়েক সাংবাদিকের ঘরে শোভা পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সরকারিভাবে নলকূপ বরাদ্ধ পেতে আগে ইউপি চেয়ারম্যান বরাবরে আবেদন করতে হতো, এক্ষেত্রে তা হয়নি। এক্ষেত্রে আবেদন হয়েছে সরাসরি ইউএনওর কাছে। পরে আবেদনগুলো ওয়ারসন কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে ইউএনও জনস্বাস্থ্য অফিসে পাঠায়। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনওর সমন্বয়ে গঠিত ওয়ারসন কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বন্টন বা বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। নলকূপগুলো বসানো হয় জেলা অফিস কর্তৃক নিয়োগকৃত ঠিকাদারের মাধ্যমে। এতে আমাদের কোন হাত নেই। আমাদের কাজ শুধু অফিস গোছানো, বরাদ্দপ্রাপ্ত মালামাল সংরক্ষণ করা, বরাদ্দ প্রাপ্তিদের মাঝে ঠিকমত বিতরণ করা, নির্ধারিত জায়গায় সঠিকভাবে বসানো হচ্ছে কি না দেখা।

চট্টগ্রাম জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল সুত্র জানায়, ২০২০-২০২৪ অর্থবছর রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় বছরে ৩৯০টি করে মোট ১৯৫০টি সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকুপ বসানোর জন্য ৫ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প বরাদ্দ পায়। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে ডিপিএইচই, প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ১৯৩৩টি সাবমার্সিবল পা¤প বসানো হয়েছে। চলমান প্রকল্পের ৫ম ধাপের শেষ কিস্তির অবশিষ্ট ১৭টি পা¤প বসানোর কাজ বর্তমানে চালু রয়েছে।

সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকূপ বিতরণের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর মাধ্যমে তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সরকারি নীতিমালার অধীনে জেলা অফিসের নিয়োগকৃত ঠিকাদারের মাধ্যমে উপজেলা ওয়ারসন কমিটি আদেশ অনুয়ায়ী বছরে প্রতি ইউনিয়নে ২৬টি করে নলকূপ বসানোর কথা থাকলেও তা কখনো মানা হয়নি।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে উপসচিব মো. আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, ডধঃবৎ য়ঁধষরঃু, অয়ঁরভবৎ ধাধরষধনরষরঃু, উৎরষষরহম ধপপবংংরনরষরঃু (ঢ়ৎবংবহপব ড়ভ যধৎফ ষধুবৎ) বিবেচনায় ংরঃব ংবষবপঃরড়হ করার। এমনকি হাওর জলাভূমি এলাকায় সুবিধাজনক স্থান ও পানির উৎস নির্বাচন করার কথা বলা হলেও এ আদেশের পূর্বেই রাঙ্গুনিয়ায় বরাদ্দ ১৯৩৩টি সাবর্মাসিবল পা¤প পছন্দের লোকদের মধ্যে বিতরণ শেষ করা হয়।

এমনকি সর্বশেষ ১৭টি টিবওয়েল বিতরণেও এ আদেশ মানা হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজেই আবেদনকারীকে প্রাধান্য না দিয়ে কিছু পছন্দের ব্যাক্তির নামে এসব সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকুপ বরাদ্দ প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি আদেশে বলা আছে, প্রকল্প পরিচালক ডিপিএইচই, নীতিমালা অনুযায়ী নিরাপদ পানি সরবরাহের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে এডিপি বাস্তবায়নে লোক সংখ্যার অনুপাত, পানির বিশুদ্ধতা এবং জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন বিবেচনায় নিয়ে শর্ত পালন করার কথা উল্লেখ রয়েছে।

উপজেলা ওয়ারসন কমিটির অনুমোদন অনুযায়ী, প্রতি ইউনিয়নে বছরে ২৬টি সাবমার্সিবল পা¤প বা গভীর নলকুপ দেয়ার কথা থাকলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রীর কোটায় ১৩টি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ১৩টি করে ভাগাভাগি হয়। রাঙ্গুনিয়ার ১৫টি ইউনিয়নে বছরে ৩৯০টি করে টিউবওয়েল বসানোর জন্য ওয়ারসন কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে হিসেব মতে ইউনিয়ন পরিষদ বছরে ১৯৫টি আর মন্ত্রীর কোটায় ১৯৫টি করে ভাগ হলেও কোন ইউনিয়নে ৪টি আবার কোন ইউনিয়নে ৪০টি পর্যন্ত বসানো হয়েছে।

নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নলকূপগুলো বরাদ্দ দেয়া হয় স¤পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে দীর্ঘ ৫টি বছর গরীব অসহায় ও অক্ষম মানুষগুলো আবেদন করেও নলকূপ বরাদ্দ পাননি। পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিক, চেয়ারম্যান-মেম্বার ও তথাকথিত গুটিকয়েক সাংবাদিক। অনিয়ম দুর্নীতির কারণে তাদের একটি বৃহৎ অংশ এসব নলকৃপ না পেয়ে বিশুদ্ধ পানি পান করা থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত রয়েছেন।

এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনস্থ রাঙ্গুনিয়া জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। উপজেলা প্রশাসনের উদ্দ্যোগ ও উপজেলা ওয়ারসন কমিটির স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে যাচাই বাছাইয়ের কাজটি হয়নি। যাচাই বাছাইয়ের বিষয়টি জন প্রতিনিধিদের চাওয়ার উপর নির্ভর করে বলে জানান রাঙ্গুনিয়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, কয়েকশ আবেদন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগে জমা থাকলেও আরো আবেদন ওয়ারসন কমিটি তথা ইউএনও অফিসে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। সঠিকভাবে যাচাই বাছাই না করার কারণে সরকারি নলকূপগুলো প্রভাবশালীরা সহজে অল্প টাকা-পয়সায় ক্রয় করে নিচ্ছে বলে শতশত আবেদনকারীর অভিযোগ।

আবেদনকারীদের ভাষ্য, বর্তমানে যারা নলকূপ পেয়েছে তারা বিশেষ ব্যাক্তির সুপারিশে পেয়েছে। বিগত সরকারের আমলে নিয়োগকৃত বর্তমান ইউএনও একই পথ অনুসরণ করছেন বলে রাজনৈতিক মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। ইউএনওর সাথে যাদের ব্যাক্তিগত স¤পর্ক জমেছে এমন ব্যাক্তির সুপারিশ ছাড়া অন্যকোন আবেদন বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। যদিও বিভিন্ন মাসিক সভায় ইউএনও মাহমুদুল হাসান সাবমার্সিবল পা¤প বিতরণের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি প্রয়োগের কথা বলেন।

সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী এসব গভীর নলকূপ কমপক্ষে ১০ পরিবার বসবাস করছে এমন পাড়ায় কিংবা বাড়ির সামনে বা রাস্তার ধারে বসানোর কথা। কিন্তু অনিয়ম দুর্নীতির কারণে এ নলকূপগুলো প্রভাবশালীদের বাড়ির অভ্যন্তরে চলে গেছে। এমনও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে, একই পরিবারে সাবমার্সিবল পা¤প ১টির অধিক ২টি পর্যন্ত বসানোর বহু হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

তবে চট্টগ্রাম জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, সরকারি সাবমার্সিবল পা¤প শুধু রাঙ্গুনিয়ায় নয়, চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিতরণ হয়েছে। তবে রাঙ্গুনিয়ায় যা বিতরণ হয়েছে তার অর্ধেক বা এক হাজারের মতো সাবমার্সিবল পা¤প চট্টগ্রামের বাকি ১৪ উপজেলায় বিতরণ হয়েছে। পাম্প বিতরণ করার এখতিয়ারও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ছিল না। এটি ছিল মন্ত্রী বা এমপিদের হাতে। ব্যাক্তিগত স¤পদের মতো তারা নিজেদের পছন্দের লোকজনের কাছে পাম্পগুলো বিতরণ করেছেন। যা কার্যকর করেছেন মন্ত্রী-এমপিদের আশীর্বাদপুষ্ট ইউএনওরা। এ নিয়ে আমাদের কিছুই বলার নেই।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page