শুক্রবার- ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

২৬ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক লিচুবাগান ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সম্পাদক

ক্ষোভে ফুঁসছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা

২৬ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক লিচুবাগান ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সম্পাদক
  • বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হারুন সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ লোকমান তালুকদার পলাতক থাকলেও তার সিণ্ডিকেট কমিটির অন্য ব্যক্তিরা এলাকায় অবস্থান করছেন যারা সমিতির নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদের কথা বলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বাক্ষর ও চাঁদা উত্তোলন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্নসাৎ করে পলাতক চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লিচুবাগান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হারুন সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ লোকমান তালুকদার। ফলে এই টাকার কোনো হিসাব পাচ্ছেন না সমিতির সদস্য সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক হিসাবেও নেই এই টাকা। নেই সমাজ সেবা অধিপ্তরের কোন অডিট রিপোর্ট। এ নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন সমিতির সদস্যভুক্ত সাধারণ ব্যাবসায়ীরা।

তাদের অভিযোগের তীর হাছান মাহমুদের ঘনিষ্টজন হিসেবে খ্যাত সমিতির সভাপতি ও চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন সওদাগর ও সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ লোকমান তালুকদারসহ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানের দিকে।

ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হারুন সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ লোকমান তালুকদার পলাতক থাকলেও তার সিণ্ডিকেট কমিটির অন্য ব্যক্তিরা এলাকায় অবস্থান করছেন। যারা সমিতির নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদের কথা বলে এখনও সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বাক্ষর ও চাঁদাবাজি করছেন।

অন্যদিকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্ঠায় গত ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয় ২৯ অক্টোবর ২০২৪ এর সমিতির সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবদুল মোতালেব চৌধুরীকে আহবায়ক ও শামসুল আলম কন্ট্রাক্টরকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি গঠণ করা হয়। কমিটিকে ৯০দিনের মধ্যে কার্যকরী কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়।

ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত লিচুবাগান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি ২০০১ সালে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর হতে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। রেজিষ্ট্রেশন নং: চট্ট-২৩৮৭/২০০১। শুরুতে ৩ বছর এ সমিতির কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হলেও ২০০৪ সাল থেকে সমিতি কতিপয় ব্যক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন :  আমানত থেকে কর্মীদের বেতন দিচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক!

এ সমিতির গুণধর সভাপতি ছিলেন হারুন সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন লোকমান তালুকদার। ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অর্থ সম্পাদক ছিলেন রিপন কান্তি গুহ (চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক)। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থ সম্পাদক ছিলেন নেজাম উদ্দিন, ২০১৬ সাল থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থ সম্পাদক ছিলেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ওলামা লীগের সদস্য মৌলানা আবদুল হামীদ।

সাধারণ ব্যবসায়ীদের দৃষ্টির অগোচরে অতি গোপনীয়তায় বিভিন্ন সময়ে কমিটি গঠনের নামে কেবলমাত্র অর্থ সম্পাদক পরিবর্তন করা হয়েছে। এ সিণ্ডিকেট আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তাদের হাতে নির্যাতিত হবার ভয়ে কেউ কোন বিষয়ে মুখ খুলার সাহস করেনি।

ফলে সমিতির পুরো কার্যক্রম এই সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় না পাওয়ায় দৈনিক সঞ্চয় চালিয়ে যেতেও বাধ্য হন। প্রতি ২ বছর অন্তর নির্বাচিত কমিটি গঠন ও আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট প্রকাশের গঠনতান্ত্রীক বাধ্যবাধকতা থাকলেও কাজের কাজ কিছুই করেনি এ সমিতি। ফলে সুযোগ সৃষ্টি হয় সমিতির টাকা লুটপাটের।

২০১২ সালে সাধারণ ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে লোক দেখানো নির্বাচন হলেও সে নির্বাচনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, অর্থ সম্পাদক হন হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ট হিসেবে খ্যাত পূর্বের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু কোনো কমিটির তালিকা পর্যন্ত নেই সমাজসেবা অধিদপ্তরে।

সাধারণ ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে সমিতির কমিটি গঠন ও অডিট রিপোর্ট জমাদানের বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে গেছেন। দীর্ঘ ২১ বছর একটি সিণ্ডিকেটের কারসাজিতে সমিতির বিশাল অংকের টাকা ও সম্পত্তি আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ২০১২ সালের সমিতির তালিকায় সদস্য সংখ্যা ৬০০ জনের দৈনিক সঞ্চয় ৫ টাকা হারে ১২ বছরের মোট ১ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ফুটপাতের ভাসমান ব্যবসায়ীদের দৈনিক সঞ্চয় ৩ হাজার টাকা হারে ১২ বছরে মোট সঞ্চয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সমিতির নিজস্ব ১টি দোকান ও পাবলিক টয়লেট থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা হারে ১২ বছরের মোট আয় ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ১২ বছরে সমিতির মাছ বাজার ও সবজি বাজার থেকে ভাড়া আদায় ৩ কোটি টাকা। সমিতির বিভিন্ন জায়গা ভাড়া ও জামানত বাবদ ২০ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে আয় ৭৬ লাখ টাকাসহ সর্বমোট ২৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা হারুন-লোকমান গং আত্মসাৎ করেছে। আর এ চরম অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি সমাজসেবা কর্মকর্তা। তাঁর সংস্থা থেকে নিবন্ধিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিট রিপোর্ট জমা করার আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ বিষয়ে লিচুবাগান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতিকে কোনোদিন একটি নোটিশ পর্যন্ত দেননি।

আরও পড়ুন :  ভক্তের প্রেমের প্রস্তাবে রাজী পিয়া জান্নাতুল, তবে...

তাদের দাবি, সমিতির দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিগণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী হাছান মাহমুদের ঘনিষ্টজন ছিলেন, তাদের ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান সমিতির অর্থ লুটপাটে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে।

এ ব্যপারে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর হতে নিবন্ধিত সমিতি হচ্ছে বেসরকারি সমিতি। গঠনতন্ত্র মেনে চলার জন্য আমরা তাদের তাগাদা দিয়ে থাকি। সমিতির সদস্যরা সংগঠনের প্রাণ। যথাসময়ে নির্বাচন করা, অনিয়ম হলে তার প্রতিবাদ করা সমিতির সদস্যদের নৈতিক দায়িত্ব। লিচুবাগান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাগণ রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তারা সমিতির কার্যক্রম পরিচালনায় অনেকাংশে উদাসীন ছিলেন। সদস্যরা প্রতিবাদ করলে হয়তো এমনটা হতো না।

নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর পারতপক্ষে করো গায়ে পড়ে নিবন্ধন বাতিল করে না। সমিতির অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে সদস্যদের দাবীর প্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষে নিবন্ধন বাতিল করা হয়। যা কোনদিন অত্র সমিতির কেউ আমাদেরকে জানাননি। অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি নিছক মিথ্যাচার বলে দাবী করেন তিনি।

আরও পড়ুন :  চামড়া যাদের শক্ত সেসব মেয়েদের জন্য এই রঙিন জীবন : বর্ষা

সমিতির সদস্যদের সঞ্চয়কৃত অর্থ আত্মসাৎ ও নানা অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া যায়নি সভাপতি মোহাম্মদ হারুন সওদাগরকে। তবে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করার পর তিনি দাবি করেন, সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে দৈনিক বা মাসিক কোনো চাঁদা নেয়া হয় না। নৈশ প্রহরী ও ঝাড়ুদারদের বেতন দেওয়া হয় বাজার ডাকের অংশ থেকে। যেহেতু কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না, তাই দুর্নীতির প্রশ্ন তোলা অবান্তর। তিনি বর্তমান কথিত আহবায়ক কমিটিকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলেও দাবি করেন। এ আহবায়ক কমিটির কেউ বিগত দিনে এ সমিতির সদস্য ছিল না।

সমিতির সদস্যভুক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, সমিতির বিগত কমিটির কতিপয় নেতা বহিরাগত কিছু সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে চাঁদা প্রদানের জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন অন্যতায় খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দেন। এ নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে আতংক বিরাজ করছে। তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশংকায় আছেন।

এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম বলেন, কেউ কোনো অভিযোগ দেননি। লিখিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিবেন বলে জানান তিনি।

এ নিয়ে আহবায়ক আবদুল মোতালেব চৌধুরী বলেন, লিচুবাগান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির অচলাবস্থা নিরসনকল্পে খুব শীঘ্রই কার্যকরী কমিটি গঠন করা হবে। কার্যকরী কমিটি সমিতির বিগত দিনের দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে আইনী পদক্ষেপ নিবে। যারা ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও নির্বাচনের কথা বলে চাঁদা তুলছেন তারা প্রতারণামূলক অবৈধ কাজ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান তিনি। তিনি আহবায়ক কমিটির বাইরে অন্য কারো সাথে আর্থিক লেনদেন না করার জন্য সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানান।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন