
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে অর্থায়নের অভিযোগে চট্টগ্রামের অন্যতম ফড়িয়া শিল্পগোষ্ঠী পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমানসহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ২০১ জন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে একটি মামলা হয়েছে।
পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিনেতা, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, অধ্যাপকসহ মোট ২০১ জনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জখম-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন আদালত।
আদালত সূত্র জানায়, গত ২০ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলার আবেদন করেন এম এ হাশেম রাজু। মামলায় তিনি নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের বাংলাদেশ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ফ্যাসিবাদ উৎখাত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অভিযুক্ত আসামিরা হলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, বাহাউদ্দীন নাসিমসহ দলটির বেশির ভাগ নেতাদের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫ জন সাংবাদিক নেতা ও সম্পাদককে। এর মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সাংবাদিক আবেদ খান, সমকালের সাবেক স¤পাদক আলমগীর হোসেন, কালবেলার স¤পাদক সন্তোষ শর্মা, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাবেক সম্পাদক নঈম নিজাম, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টিভির সাবেক প্রধান মোজাম্মেল হক, সাংবাদিক মুন্নী সাহা, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাংবাদিক মিথিলা ফারজানা, মাসুদা ভাট্টি ও ফারজানা রুপা।
মামলার আসামিদের মধ্যে ১৪ জন অভিনেতা রয়েছেন। তারা হলেন মামুনুর রশীদ, চঞ্চল চৌধুরী, রিয়াজ, ফেরদৌস, আশনা হাবীব ভাবনা, সাজু খাদেম, জায়েদ খান, রোকেয়া প্রাচী, মেহের আফরোজ শাওন, অরুনা বিশ্বাস, জ্যোতিকা জ্যোতি, শামীমা তুষ্টি, শমী কায়সার ও সোহানা সাবা।
এ মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আক্তারুজ্জামান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশীদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মীজানুর রহমান, নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম ওয়াহিদুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগরবিদ নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক আবু জাফর মো. শফিউল আলম, অধ্যাপক মিহির লাল সাহা এবং অধ্যাপক ও লেখক জাফর ইকবালকে আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া মামলায় আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকী আক্তার, গণজাগরণ মঞ্চের সাবেক মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, সাবেক জেলা জজ হেলাল চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অভিনেতা রোকেয়া প্রাচী, মেহের আফরোজ শাওনসহ যাদের নাম মামলায় উল্লেখ রয়েছে, তারা আওয়ামী সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের যোদ্ধা। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ আলো আসবে গ্রুপে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হত্যা ও নির্যাতন গ্লোরিফাই করতে বিষোদ্গার ছড়ায়।
মামলার বিবরণে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ। গত বছরের ৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের লক্ষ্যে সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলনের এক দফা দাবি আদায়ে শহীদ মিনার থেকে মিছিলটি পরীবাগের সামনে আসে। তখন ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্য সন্ত্রাসীরা মিছিল অবরোধ করে। তখন ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার জন্য গুলি বর্ষণ করে। তখন মিছিলে অংশ নেওয়া মাদ্রাসাছাত্র সাইফুদ্দিনের চোখে গুলি লাগে। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মামলার বাদী এম এ হাশেম রাজু।
এ ঘটনায় গত ২০ মার্চ মামলার আবেদনের ভিত্তিতে আদালত শাহবাগ থানাকে নির্দেশ দেন, আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিনের গুরুতর জখমের ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না। শাহবাগ থানা-পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) আদালত মামলাটি তদন্ত করে শাহবাগ থানার ওসিকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জখম-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন আদালত।
মামলার বাদী এম এ হাশেম রাজু জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে সুফি মিজান যে ভূমিকা পালন করেছেন তার বিপুল তথ্য-প্রমাণ তারা গত কয়েক মাস ধরে সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, সুফি মিজান ও তার ছেলেরা ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অতন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেখ হাসিনার পতনের আগের ব্যবসায়ী বৈঠকেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্যতম অর্থ যোগানদাতা হিসেবে তার সংশ্লিষ্টতা আমরা পেয়েছি।
শেখ হাসিনাকে মা ডাকতেন সুফি মিজান
সুফি মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তার পক্ষে আয়োজিত এক ব্যবসায়ী সম্মেলনে পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান শেখ হাসিনাকে মাদার অফ হিউম্যানিটি আখ্যা দিয়ে বলেন, জীবনে আর কতোবার যে প্রধানমন্ত্রী হবেন আল্লাহই জানেন, আমরা জানি না। এইবার, তারপরের বার, আরও বহুত বার ইনশাল্লাহ।
শেখ হাসিনাকে মা জননী ডেকে সুফি মিজান বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন সোনার বাংলা। আমার আমাদের মা আমাদের মা জননী আপনাকে নিয়ে আমরা ইনশাল্লাহ হীরার বাংলা তৈরি করবো।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া আরেক ভিডিওচিত্রে শোনা যায়, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, আমাদের মহান নেত্রী আল্লাহর নেয়ামত আমাদের জন্য। পৃথিবীতে ৫৬০টা মডেল মসজিদ কেউ দিতে পারে নাই, তিন লক্ষ গৃহহীন মানুষকে জমিনসহ তার ঠিকানা- এটা বাংলাদেশের মহীয়সী রমণী আমাদের দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু তনয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এটা পৃথিবীতে কেউ করতে পারে নাই।
সুফি মিজান বলেন, আপনি দেখবেন উনি যখন মিটিংয়ে থাকেন, সচল থাকেন, আনন্দে মুখরিত থাকেন, তখন তার থেকে মানুষের মধ্যে রেডিয়েশন হয়। এসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। বর্তমানে ওইসব বক্তব্যসহ বিভিন্ন উপকরণ মামলার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় ভূমিকা রেখে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো চট্টগ্রামের ছেলে সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ বলেন, শেখ হাসিনার পতনের আগে ব্যবসায়ীদের নিয়ে যে বৈঠক করেছিলেন শেখ হাসিনা, সুফি মিজান সেখানেও শেখ হাসিনার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।