
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার কাজ শুরু করেছে চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেড। এর মধ্য দিয়ে এনসিটি পরিচালনার ১৭ বছরের অধ্যায়ের অবসান ঘটলো সাইফ পাওয়ারটেকের।
সোমবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যায় তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক। তিনি জানান, এনসিটিতে ড্রাইডক তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। আগের অপারেটরের সঙ্গে যেসব শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করত, তারাই এনসিটি পরিচালনার সঙ্গে থাকছে, শুধু ব্যবস্থাপনার বদল হয়েছে।
তিনি জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বোর্ড সভায় এ বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। টেকনিক্যাল কারণে নৌবাহিনী সরাসরি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব নিতে না পারলেও, তারা ড্রাইডকের মাধ্যমে এনসিটির কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি নৌ-বাহিনী পরিচালিত একটি সামরিক জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানার মধ্যেই অবস্থিত।
সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমীন জানান, দায়িত্ব হস্তান্তরের সব প্রস্তুতি তারা স¤পন্ন করেছেন। এনসিটি ছেড়ে দিলেও, চট্টগ্রাম বন্দরের অন্য টার্মিনাল চিটাগং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ও পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) আমাদের কার্যক্রম চুক্তি অনুযায়ী চলমান থাকবে।
তিনি জানান, ২০০৭ সাল থেকে এনসিটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিল সাইফ পাওয়ারটেক। চারটি কন্টেইনার টার্মিনালের মধ্যে এনসিটি একাই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডলিং হওয়া প্রায় ৩২ লাখ টিইইউস কন্টেইনারের ৪৪ শতাংশ পরিচালনা করেছে।
তবে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী রোববার (৬ জুলাই) মধ্যরাত থেকে চিটাগাং ড্রাইডককে এনসিটি টার্মিনাল বুঝিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে সাইফ পাওয়ারটেক। ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম) তথা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ৬ মাসের কার্যাদেশ পেয়েছে ড্রাইডক লিমিটেড।
এর আগে ৬ জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় বিতর্কিত সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে বন্দরের এনসিটি টার্মিনালে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় রাজত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেকের বিদায়ঘণ্টা বেজে যায়।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনসিটি থেকে সাইফ পাওয়ারটেককে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আগে চূড়ান্ত হয়েছিল। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বন্দর কতৃপক্ষ নিজেই টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। পরবর্তীতে সরকার নৌ-বাহিনীকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
তবে আইনি কিছুটা জটিলতা থাকায় সরাসরি নৌ-বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ড্রাইডককে এনসিটির দায়িত্ব দেয় সরকার। আর এই রদবদল বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, নৌবাহিনী ও ড্রাইডকের অভিজ্ঞতায় পরিচালিত এনসিটি কীভাবে নতুন মানদন্ড স্থাপন করে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমানে সবচেয়ে বড় টার্মিনাল এনসিটি। প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা এই টার্মিনালে একসঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচটি জাহাজ ভেড়ানো যায়। এই টার্মিনালে চারটি জেটি রয়েছে এবং বন্দরের মোট কন্টেইনারের প্রায় অর্ধেক হ্যান্ডলিং করা হয় এই টার্মিনাল দিয়ে। এটিতে ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি সম্বলিত ইয়ার্ড। টার্মিনালে বন্দরের মালিকানাধীন জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠা-নামা করার জন্য রয়েছে ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেন। এর পাশাপাশি কন্টেইনার স্থানান্তরের যত যন্ত্র দরকার, সবই আছে টার্মিনালটিতে।
বন্দর সূত্র জানায়, এই টার্মিনালে সব বিনিয়োগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবহার করে কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই টার্মিনালটি থেকে সাইফ পাওয়ারটেক হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। দেশি কিংবা বিদেশি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে তেমন সুযোগ দেওয়া হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এনসিটি থেকে বিতর্কিত সাইফ পাওয়ারটেককে সরিয়ে দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন থেকে বন্দর বিদেশিদের হাতে না দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন পক্ষ সরব হয়। তবে তাদের দাবির আড়ালে সাইফ পাওয়ারটেককে রক্ষা করতেই এই আন্দোলন চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন অনেকেই।
আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যেই নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ফাঁস করেন। এতে টাকা ঢেলে বন্দর অচলের জন্য সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন নির্দেশনা দেন বলে অভিযোগ করেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত।