
# সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে বিক্ষোভ
# কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উস্কানির অভিযোগ
# ১৫ বছর একতরফা তৎপর ছিল ছাত্রলীগ
# ৫ আগস্টের পর রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা কর্তৃপক্ষের
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) কমিটি দিয়েছে ছাত্রদল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে এই বিক্ষোভ করছেন তারা।
বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১১টায় মাইক হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীরা চুয়েট ক্যা¤পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন। যা শুক্রবার (১১ জুলাই) দুপুরেও অব্যাহত ছিল। আজ শনিবার (১২ জুলাই) সকালেও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে এখন উত্তাল চুয়েট।
শিক্ষার্থীদের দাবি, বিভিন্ন সময়ে ছাত্র রাজনীতির কারণে ক্যা¤পাসে অনেক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। চুয়েটে এখন ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় ক্যা¤পাসে কোনোভাবেই ছাত্রদলের কমিটি মেনে নেয়া হবে না।
শিক্ষার্থীরা বলেন, শুধু ছাত্রদল নয়, ছাত্র শিবির কিংবা ছাত্র ইউনিয়নের কমিটিও মেনে নেয়া হবে না। কমিটিতে যাদের নাম আসবে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তারা। যদি উপর্যুক্ত ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তবে তারা পরবর্তীতে আরো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার ঘোষণা দিবেন বলেও জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিক্ষোভে নামা শিক্ষার্থীরা মোটেও সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, গত ১৫ বছর পর্যায়ক্রমে তারা ছাত্রলীগের ব্যানারে চুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতিতে তৎপর ছিল। এ সময় অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের দাপট দেখিয়ে নানা অনিয়ম ও অপকর্ম করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে এসব শিক্ষার্থীদের দহরম-মহরম ছিল। আবার অপকর্মের কারণে এসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারের মতো পদক্ষেপও নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার পরিস্থিতি বুঝে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারও করেছেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাঙ্গুনিয়া আসনের বিতর্কিত সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ ও রাউজান আসনের সংসদ সদস্য ফজলে করিমের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ গত ১৫ বছর চুয়েট ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট বাণিজ্য ও নিয়োগবাণিজ্যসহ এমন কোন অপকর্ম নেই করেনি। এক কথায় রামরাজত্ব কায়েম করেছিল। এ সময় বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য কোন রাজনেতিক দল চুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেনি।
এমনকি ২০২৪ সালের ২৬ জুন চুয়েট ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ৩৬ সদস্যের এই কমিটিতে সভাপতি করা হয় সাগরময় আচার্যকে, সাধারণ স¤পাদক ছিলেন বিজয় হোসেন। তারা দু‘জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সভাপতি সাগরময় পুরকৌশল বিভাগ থেকে ২০২৩ সালে স্নাতক শেষ করলেও স্নাতকোত্তরে ভর্তি হননি তিনি।
আর সাধারণ সম্পাদক বিজয় মেকাট্রনিকস ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। তিনি ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী অনুসারী। আর সাগরময় ছিলেন ড. হাছান মাহমুদ ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক, সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এছাড়া এই কমিটিতে সহসভাপতি পদে ১৮ জন, যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক পদে ৮ জন ও সাংগঠনিক স¤পাদক পদে ৮ জনকে রাখা হয়েছে।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়েছিল ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১৬১ সদস্যের ওই কমিটিতে সভাপতি হিসেবে সৈয়দ ইমাম বাকের ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব পান। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাছান মাহমুদ ও ফজলে করিমের সাথে ছাত্রলীগের এসব নেতা গা ঢাকা দিলেও ক্যাম্পাসে সক্রিয় রয়েছেন তাদের অনুসারীরা।
তাদের প্রভাবে চুয়েটে কর্তৃপক্ষ গত বছর ০৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩৬তম জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে সুকৌশলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক স¤পৃক্ততাও। আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় বিধান অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপরই চুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে। এ সুযোগে ছাত্রলীগের সেই নেতাকর্মীরা এখন সাধারণ শিক্ষার্থী সেজে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে। এর মধ্যে বৃহ¯পতিবার দিনগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল শাখা কমিটি প্রকাশের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তালিকা অনুযায়ী, ছাত্রদলের ঘোষিত কমিটিতে সভাপতি হিসেবে রয়েছেন তড়িৎকৌশল বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিফ রাশেদ এবং সাধারণ স¤পাদক জৈব চিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তৌফিক হাসান চৌধুরী।
কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন, সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন, সহসভাপতি চন্দন কুমার দাশ, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক মোহাম্মদ তৌসিফ, যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক আবু সুফিয়ান আল সাবিত ও সাখাওয়াত হোসেন, সাংগঠনিক স¤পাদক বিপ্লব হোসাইন এবং প্রচার স¤পাদক আহমেদ ইনতিসার।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার ধোঁয়া তুলে ক্যা¤পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে নামেন শিক্ষার্থীরা। সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীদের এই সংখ্যা মাত্র অর্ধশতাধিক। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বরে জড়ো হয়ে ক্যা¤পাস প্রাঙ্গণে মিছিল শুরু করেন এবং সবগুলো ছাত্র ও ছাত্রী হল প্রদক্ষিণ করে উপাচার্য ভবন পর্যন্ত এগিয়ে যান।
এসময় তারা ‘ছাত্র রাজনীতির ঠিকানা, এই চুয়েটে হবে না’, লাল কার্ড লাল কার্ড-ছাত্র দল লাল কার্ড, ছাত্র শিবির লালকার্ড, ছাত্র ইউনিয়ন লাল কার্ড, ‘চুয়েটের মাটি, চুয়েটিয়ানদের ঘাটি, ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন একাধিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন জৈব চিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বিপ্লব সাহা।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ। ছাত্ররাজনীতির নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সিট বাণিজ্যের মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ড হয়েছে। আমরা চায় না চুয়েটে ফের এই অশান্তি ও অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটুক। তাই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিমুক্ত রাখার জন্য আমরা সোচ্চার। রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য কোনো কার্যক্রম তারা মেনে নেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী।
কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ স¤পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, চুয়েটে ছাত্রদলের যে কমিটি ছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা খসড়া কমিটি ছিল। নতুন কমিটি শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত ক্যা¤পাসে কমিটি দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের রাজনীতি করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই তা নিষিদ্ধ করতে পারে না।
ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষ নয়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে বিতর্কিত। বর্তমান শিক্ষার্থী বিক্ষোভের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাত রয়েছে। উস্কানি না পেলে তারা বিক্ষোভ করার সাহস পেত না।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দ্বিতীয় প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দীন আহাম্মদ এ প্রসঙ্গে বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতির কারনে সিন্ডিকেট সভায় চুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। সিন্ডিকেটের মতে, শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ বজায় রাখতে ক্যাম্পাস রাজনীতি মুক্ত হওয়া সহায়ক। রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণায় চুয়েট কর্তৃপক্ষের কোনরকম পক্ষপাতিত্ব বা সম্পৃক্ততা নেই। বর্তমান শিক্ষার্থী বিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনরকম উস্কানি নেই। এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদীত।