
# ক্ষিপ্ত বন্য হাতির দল নামছে লোকালয়ে
# ভাঙছে ঘরবাড়ি, মারছে মানুষ গিলছে ফসল
# আইইউসিএনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শ
চট্টগ্রামে এখন এমন কোন পাহাড় নেই যেখানে মানুষের পা পড়েনি। কেউ করেছে গাছের বাগান, কেউ করেছে ফলের বাগান, কেউ করেছে মৎস্য খামার। কেউ-কেউ ঘরবাড়িও করেছে। মূলে রয়েছে দখল বাণিজ্য, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ এসব পাহাড়ের শতভাগই সংরক্ষিত বনাঞ্চল। যা নিয়ন্ত্রণ করে বনবিভাগ।
অথচ ৮০‘র দশক পর্যন্ত এসব পাহাড়ে পা পড়েনি মানুষের। ভয়ে ঢুকেনি বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও। তখন বনের গহিনে থাকা বন্যহাতি তো দূরের কথা তেমন কোন বন্যপ্রাণী ছুটে আসেনি লোকালয়ে। এমন মত বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও স্থানীয় লোকজনের।
তাদের মতে, বর্তমানে বন্যপ্রাণীর সেই আবাসস্থল গহিন বনভুমি এখন মানুষের দখলে। যা দেখলে বুঝাই যায় না, এই বনভুমি কোন এক সময় অরণ্যে ঢাকা ছিল। বনবিভাগের খাতায় সংরক্ষিত হলেও এই বনভুমি এখন আর সংরক্ষিত নেই। এই বনভুমি এখন মানুষের আবাস আর চলাচলের করিডোর হয়ে উঠেছে।
হাতির করিডোরে হাসান মাহমুদের বাড়ি
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সংরক্ষিত বনের বিস্তীর্ণ বনভুমি কোন রকম বৈধতা ছাড়াই নিজেদের করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এর মধ্যে মন্ত্রীও রয়েছেন বলে জানান বন বিভাগের খুরুশিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস এলাকায় হাতি চলাচলের রাস্তায় নির্মাণ করা হয়েছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাক্তণ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী এবং সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের বিলাসবহুল বাড়ি।
যেখানে টাঙানো রয়েছে হাতি চলাচলের পথ লেখা বনবিভাগের খুরুশিয়া রেঞ্জের পুঁতা সাইনবোর্ড। আর এই পথ দিয়ে প্রায়ই চলাচল করে বন্যহাতি। বন্যহাতি চলাচল ঠেকাতে বিগত ১৫ বছর ড. হাসান মাহমুদের বাড়ির ভেতর থেকে চালানো হতো গুলি।
এছাড়া খুরুশিয়া রেঞ্জের সুখবিলাস এলাকার প্রায় ১৫০ একর সংরক্ষিত বনভুমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিল গয়াল-গরু ও মৎস্য খামার। যেটির তত্ত্ববধান করেছিলেন ড. হাসান মাহমুদের ছোট ভাই এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত মদ্যপায়ী এরশাদ মাহমুদ। এই এলাকাটি ছিল বন্যহাতির আবাসস্থল। যেখান থেকে বন্যহাতির দল প্রায়শই ছুটে এসে খেয়ে তছনছ করত বিলের ধান-সবজি। শুর দিয়ে আছড়ে ও পায়ের তলায় পিষ্ট করে মারত নিরীহ গ্রামবাসিদের।
গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হাসান মাহমুদ, তার ভাই এরশাদ মাহমুদ ও খালেদ মাহমুদসহ পরিবারের কর্তারা সুখবিলাস তথা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর খামারের ওই বনভুমি উদ্ধার করে বনবিভাগ। এমনকি করিডোর দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে বন্য হাতির দল। ফলে ক্ষিপ্ত বন্যহাতি এখন শান্ত হয়ে চলাফেরা করছে।
শুধু সুখবিলাস নয়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার খুরুশিয়া রেঞ্জ, চিরিঙ্গা রেঞ্জ ও ইছামতি রেঞ্জের প্রায় ১০ হাজার একর বনভুমির পরতে পরতে জবরদখল করে নেয় ড. হাসান মাহমুদের আত্নীয় স্বজন ও অনুসারীরা। যেগুলো উদ্ধারের কোন তৎপরতা নেই বলে জানান স্থানীয়রা।
জরিপে হাতির বিচরণক্ষেত্র
রাঙ্গুনিয়া ছাড়াও চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সীতাকুন্ড, মিরসরাই উপজেলার সংরক্ষিত বনভুমির বিস্তীর্ণ এলাকা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জবরদখল করে নেন। যেখানে কেউ করেছেন গাছ বাগান, কেউ ফল বাগান, কেউ মৎস্য খামার ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছেন। ফলে আবাস হারায় হাতিসহ বনপ্রাণীরা। এতে হাতিসহ বিষধর সাপ, হরিণ, বানর, বাঘ ইত্যাদি বন্যপ্রাণী লোকালয়ে নেমে আসছে। করছে জনবসতি ভাঙচুর, গিলে খাচ্ছে ফসলি জমির ধান-সবজি, শুর ও পায়ের তলায় পিষ্ট করে মারছে মানুষ।
বনবিভাগের তথ্যমতে, এশীয় হাতি বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি, যা বাংলাদেশে মহাবিপন্ন হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ বনবিভাগের নয়টি বনে হাতির বর্তমান জনসংখ্যার অবস্থা নির্ণয়, চলাচলের পথ ও করিডোর চিহ্নিতকরণে যৌথভাবে জরিপ চালিয়েছে আইইউসিএন (আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন) ও বাংলাদেশ বন বিভাগ।
২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছর জরিপ চালানো হয়। জরিপে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৪৪টি বন রেঞ্জে হাতিদের বিচরণ রেকর্ড করা হয়, যার মধ্যে নয়টি বন বিভাগের অধীনে থাকা সংরক্ষিত ও রক্ষিত বন অন্তর্ভুক্ত। দেশে হাতি চলাচলের মোট এলাকা ১,৫১৮ বর্গ কি.মি.।
জরিপে বাংলাদেশে ২৬৮টি স্থায়ী বন্য হাতি, ৯৩টি পরিযায়ী হাতি এবং ৯৬টি পালিত হাতির তথ্য মিলেছে। ১২টি করিডোর ও ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত হাতি পারাপারের স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি করিডোর কক্সবাজার উত্তর, তিনটি কক্সবাজার দক্ষিণ এবং চারটি চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগে। হাতি বছরের পর বছর একই পথ অনুসরণ করে। তাই হাতি টিকে থাকতে করিডোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হাতির ১২ করিডোর:
সুখবিলাস-কোদালা: চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের পদুয়া ইউনিয়নের খুরুশিয়া রেঞ্জের সুখবিলাস এবং চিরিঙ্গা রেঞ্জের কোদালা বনের হাতির আবাসস্থল সংযুক্ত করেছে এ করিডোর। যেখানে ঋতুভিত্তিক হাতি চলাচল করে। শ্রীমাই, কমলাছড়ি, খুরুশিয়া, সুখবিলাস থেকে শিলক, কোদালা ও কাপ্তাই পর্যন্ত বিস্তৃত এই করিডোর।
নারিশ্যা-কোদালা: এ করিডোরটি পদুয়া ইউনয়িনের নারিশ্যা এবং কোদালার বনভূমিকে সংযুক্ত করেছে। রাজারহাট থেকে গোডাউন পর্যন্ত সড়ক করিডোরের পাশ দিয়ে চলে গেছে। যেখানে বন্যহাতি নিয়মিত চলাচল করে।
চুনতি-সাতগড়: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। কক্সবাজার দক্ষিণ, লামা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ এবং বান্দরবান বনবিভাগের হাতি ব্যাপকভাবে এই করিডোর ব্যবহার করে। করিডোরের একপাশে একাশিয়া ও পাইন গাছের বাগান (সাতগড় বিট) এবং অন্য পাশে প্রাকৃতিক বন চুনতি অভয়ারণ্য (চুনতি বিট) রয়েছে।
ফাঁসিয়াখালী-ছৈরাখালী: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক বিভক্ত করেছে এ করিডোর। ফসল কাটার মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল- সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে) হাতি এ করিডোর নিয়মিত ব্যবহার করে। করিডোরটির অবস্থান সংরক্ষিত বনে।
লালুটিয়া-বরদুয়ারা: এ করিডোর দোহাজারী (লালুটিয়া বিট) এবং পদুয়া সংরক্ষিত বনের (বরদুয়ারা বিট) হাতির আবাসস্থলকে সংযুক্ত করেছে। এটি লালুটিয়া, দোহাজারী, দুধপুকুরিয়া, ধোপাছড়ি অভয়ারণ্যকেও সংযুক্ত করেছে।
তুলাতলী-ঈদগড়: কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের সংরক্ষিত বনের তুলাতলী বিট এবং ঈদগড় বিটের হাতির আবাসস্থলকে যুক্ত করেছে এ করিডোর। আরাকান সড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। এটি ঈদগড়, লামা থেকে তুলাতলী, মাছুয়াখালী ও কলিরছড়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
ফাঁসিয়াখালী-মানিকপুর: লামা-কক্সবাজার সড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। করিডোরের উভয় পাশে ঝোপঝাড়, গাছপালা, আগর বাগান রয়েছে। এটি ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, পূর্বে কুমারী, লামা এবং উত্তরে মানিকপুর, কাকারা ও নলবিলা সংরক্ষিত বনে অবস্থিত।
খুটাখালী-মেধাকচ্ছপিয়া: মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্ক ফুলছড়ি রেঞ্জের একটি বিট, এটি এমন একটি ভূখন্ড যেখানে শেষ গর্জন বনভূমি রয়েছে, যা অতীতের বনজ স¤পদের ধারক। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক করিডোরটিকে বিভক্ত করেছে।
তুলাবাগান-পানেরছড়া: করিডোরটি কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের তুলাবাগান এবং পানেরছড়ার হাতির আবাসস্থলের সাথে যুক্ত হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কারণে দুটি আবাসস্থল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই করিডোরের উভয় পাশে সামাজিক বনায়ন রয়েছে। উত্তর দিকের গাছ কাটার কারণে এই আবাসস্থলটি এখন বৃক্ষশূন্য।
নাইক্ষংছড়ি-রাজারকুল: এই করিডোরটি রাজারকুল রেঞ্জের মধ্যে অবস্থিত যা লামা বনবিভাগের নাইক্ষ্যংছড়ির হাতির আবাসস্থল এবং কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তুলাবাগানের সাথে যুক্ত হয়েছে। রামু-মরিচ্যা সড়ক এই দুটি আবাসস্থলকে বিভক্ত করেছে।
ভোমারিয়াঘোনা-রাজঘাট: করিডোরটি ঈদগাঁও রেঞ্জ এবং ফুলছড়ি রেঞ্জের হাতির আবাসস্থলকে যুক্ত করেছে। ঈদগাঁও-বাইশারী সড়ক এই করিডোরের মধ্য দিয়ে গেছে। করিডোরের তুলাতলী, পানেরছড়া, ভোমারিয়া, রাজঘাট থেকে খুটাখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাতি চলাচল করে।
উখিয়া-ঘুমধুম: করিডোরটি লামা বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নাইক্ষংছড়ি এবং উখিয়ার হাতির আবাসস্থলকে যুক্ত করেছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কারণে দুটি আবাসস্থল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। করিডোরটি নাইক্ষ্যংছড়ি, কুতুপালং, ঘুমধুম, তুমব্রু, আঝুহাইয়া, মধুরছড়া, বটতলীগোনা, বালুখালী, পালংখালী থেকে সোয়াংখালী পর্যন্ত বিস্তৃত।
বিচরণ ক্ষেত্র হারিয়ে বিপন্ন হাতিরা
বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতিরা এখন বিপন্ন। মানুষের পেতে রাখা বৈদ্যুতিক ফাঁদ, বিষ, সীমান্তে ল্যান্ডমাইন, পোচার বা শিকারিদের চোরাগোপ্তা হামলায় গভীর অরণ্যের ভেতর বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে বিশালাকৃতির এই নিরীহ প্রাণীটি। গবেষকরা বলছেন, বনাঞ্চল ধ্বংস ও জবরদখলসহ নানা কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতিদের ১২টি অরণ্যপথ বা এলিফ্যান্ট পাস।
এছাড়া নানা কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া হাতিদের চিকিৎসায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের নেই নিজস্ব কোনো চিকিৎসক টিম। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গভীর অরণ্যে শিকারি মানুষ বা পোচারদের আক্রমণ, কৃষকদের বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ, পাহাড়ি খাদে দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে গত ১০ বছরে প্রায় ১৭টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে গত ৯ এপ্রিল শিকারিরা বাঁশখালির জলদি অভয়ারণ্যে একটি হাতি হত্যা করে সেটির দাঁত এবং নখ কেটে নিয়ে পালিয়ে যায়। গত ১১ আগস্ট পার্বত্যজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় একটি হাতি ল্যান্ডমাইনের আঘাতে এক পা হারায়।
লোকালয়ে ক্ষুব্ধ হাতিদের আক্রমণে অনেকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা স্থানে গত ৯-১০ বছরে হাতির পালের আক্রমণে নারী-শিশুসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
হাতির ছুটে আসা নিয়ে ভুল ধারণা
বনবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, হাতিসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে ছুটে আসছে। আসলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল যে এখন মানুষের আবাসস্থল হয়ে গেছে তা প্রকাশ করে না বনবিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সুখবিলাস এলাকার বয়োজেষ্ঠ্য আশরাফ আলীর ভাষ্য, ৮০‘র দশকের আগে কেউ ভয়ে বনে ঢুকত না। তখন বন্যহাতি বা কোন প্রাণী লোকালয়ে এভাবে ছুটে আসত না। তখন গহিন বনে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য কে দিত? খাবারের সন্ধানে যে বন্যপ্রাণী ছুটে আসার কথা বলছে সেটা ভুল মনে করছেন তিনি। তার সাথে একমত পোষণ করেছেন আনোয়ারা উপজেলার সংরক্ষিত দেয়াং পাহাড় এলাকার বয়োজেষ্ঠ্য নবী হোসেন, আবদুল মুনাফসহ অনেকেই।
একই কথা উঠে এসেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা নূরজাহান বেগমের মুখেও। তিনি বলেন, বন্যহাতি বা অন্য যে কোন প্রাণী খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসছে এই কথাটা আসলে ভুল। বন্যহাতিরা যেসব স্থানে আসে সেগুলো কয়েক দশক আগেও তাদের বিচরণস্থল ছিল। হাতিরা তাদের নিজেদের বিচরণস্থলে এসে যখন দেখে তা জবরদখল হয়ে গেছে তখন তারা উদভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে। কখনো মানুষ হাতিদের চ্যালেঞ্জ করে, তখন হাতিরা ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করে।
তিনি বলেন, স্বভাবগতভাবে হাতিরা শান্ত ও নিরীহ প্রাণী। ঘাস ও গুল্মভোজী হাতিদের জন্য অরণ্যে খাবারের অভাব নেই। তারা প্রতিদিন দেড়শ কিলোগ্রাম খাবার গ্রহণ করে। হাতিরা খাবার হজমের জন্য দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই হাঁটাচলা ও তাদের অরণ্যপথ বা এলিফ্যান্ট পাস ধরে বিচরণ করে। তাদের এই হাঁটা ও বিচরণ স¤পূর্ণ মেমোরির বা স্মৃতিশক্তির ওপর চলে। তারা যখন কোথাও এসে দেখে জায়গাটি আগের মতো নেই তখন তারা বিচলিত-উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় জ্ঞান, লজিস্টিকস, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে হাতিদের জীবন রক্ষায় দ্রুত কাজ করা সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার রেল লাইন ও ছয় লেন সড়কের সম্ভাব্য প্রকল্প- সবই হাতির আবহমান বিচরণপথ ধ্বংসের সামিল হবে। এশিয়ান গ্রুপের এইসব হাতির জীবন রক্ষার কথাটি যে কোনো উন্নয়ন কাজে হাত দেওয়ার আগে ভাবা উচিত। বাংলাদেশে এযাবত হাতির ওপর কোনো গবেষণা হয়েছে বলে তা জানা নেই বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মারুফ হোসেন বলেন, এটা সত্য যে, দখলদাররা রাজনৈতিক প্রভাবে শক্তিশালী। যা প্রকাশ করারও সুযোগ নেই। মুখ খুললে বসার চেয়ারও আর থাকবে না। তাই আসল সত্য প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, পূর্বে অনুন্নত এলাকায় নতুন বসতি স্থাপন, চাষাবাদের ভূমির ব্যবহারে পরিবর্তন, অবকাঠামো এবং বনজ স¤পদের উপর মানুষের নির্ভরতার কারণে হাতির করিডোরের দিন দিন অবনতি ঘটে। এতে হাতি এক বন থেকে অন্য বনে খাদ্য, জল, আশ্রয় এবং প্রজননের জন্য খন্ডিত ও অবনতিশীল আবাসস্থল ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। হাতির জনসংখ্যা টিকে থাকার জন্য করিডোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইইউসিএনের সুপারিশ:
হাতি চলাচলের জন্য ১২ করিডোর রক্ষায় আইইউসিএন যে সব সুপারিশ করেছে তা হলো, করিডোর ঘোষণা ও সীমানা নির্ধারণ এবং আইনি সুরক্ষা প্রদান, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ কমানো। বন-নির্ভরশীল মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, বাগানকে প্রাকৃতিক বনে রূপান্তর করা। করিডোর এলাকা প্রশস্ত করা, কুমির প্রজনন কেন্দ্র, রাবার বাগান অফিস, টেলিভিশন কেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির স্থানান্তর। পাহাড় কাটা, মাটি উত্তোলন, পোল্ট্রি ফার্ম স্থানান্তর করা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আইইউসিএনের সুপারিশগুলো বাস্তবমুখী। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে বনভুমি কয়েকদশক আগের মতো স্বভাবগত ধারায় ফিরে আসবে। বনপ্রাণীরাও ফিরে পাবে আবাসস্থল। কমে যাবে বন্যপ্রাণী ও মানুষের সংঘাত। আর এই সুপারিশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।