রবিবার- ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কমিশন-স্ক্র্যাপ সব খান তবুও সাধু রেল কর্মকর্তা সাজ্জাদ

কমিশন-স্ক্র্যাপ সব খান তবুও সাধু রেল কর্মকর্তা সাজ্জাদ

# চক্রের মুলে সরঞ্জাম ক্রয়ের এসিওএস রফিক উল্লাহ
# বাকি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে করেন দূর্ব্যবহার

মিশন ছাড়া ছাড়ে না এস আরের ফাইল, মোটা অঙ্কের উপরি পেলে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এস আরের মালামালের আইটেম সংখ্যা। এটা হলো রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল, চট্টগ্রাম ইনভেন্টরি কন্ট্রোল সেল (আইসিসি) কার্যালয়ের দূর্নীতির নমুনা।

অন্যদিকে পাহাড়তলি আমবাগানে অবিস্থত রেলওয়ের ডিপো থেকে গোপনে বিক্রি করেন স্ক্র্যাপও। আবার বিভিন্ন দপ্তরের রেলের মালামাল বুঝে পাওয়ার ভুয়া কাগজও দেন। যেখান থেকে প্রতিমাসে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তবুও মুখে সাধু রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দুই দপ্তরের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদুল ইসলাম।

আর সাজ্জাদের মূল ক্যাশিয়ার হলেন দুই দপ্তরের আরেক কর্মকর্তা রফিক উল্লাহ। তিনি রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম ক্রয় দপ্তরের ইনেসপেকশন শাখার এসিওএস, আবার আইসিসি দপ্তরের সহকারি পরিচালক (অতিরিক্ত) হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রকৌশলী সাজ্জাদুল ইসলামের অনেক পছন্দের লোক এই রফিক উল্লাহ। যিনি ঠিকাদারের কমিশনসহ সকল অনৈতিক কাজের টাকা পৌছে দেন সাজ্জাদুল ইসলামের কাছে। বলতে গেলে রফিক উল্লাহ আইসিসির অঘোষিত পরিচালক।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালে নভেম্বর মাসে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের সরঞ্জাম শাখার পাহাড়তলি আমবাগানস্থ ডিপোর পরিচালকের চেয়ারে বসে রেলের জন্য ক্রয় করা নানা সরঞ্জাম ও স্ক্র্যাপ নয়ছয় করে বিতর্কিত হন। পরে চলতি বছর জুলাই মাসে সিআরবি ইনভেন্টরি কন্ট্রোল সেল দপ্তরের পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান তিনি।

যা পোয়াবারো হয়ে উঠে দূর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার জন্য। আর এই দপ্তরের চেয়ারে বসেই মহাগরম সাজ্জাদুল ইসলাম। তারমতে, আগের পরিচালক একজন মহা দূর্নীতিবাজ। এমনকি তার নামের সাথে মিলিয়ে জানোয়ার বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। এমন কোন অনিয়ম-দূর্নীতি তিনি বরদাস্ত করবেন না বলে চোখ রাঙিয়ে ধমক দিয়ে ভয় দেখান কর্মচারিদের।

এমনকি তথ্যানুসন্ধানে কোন সাংবাদিক আসলে তাদের সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন সাজ্জাদুল ইসলাম। তবে দপ্তরের একমাত্র মধ্যমনি সহকারি পরিচালক রফিক উল্লাহ ও পছন্দের ঠিকাদারদের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন তিনি। যাদের কাছ থেকে মালামাল ক্রয়ের এস আর থেকে ১০% পর্যন্ত কমিশন নিয়ে সাজ্জাদুল ইসলামের কাছে পৌছান রফিক উল্লাহ।

এর বিপরীতে বাড়িয়ে দেন মালামাল ক্রয়ের বাজার দর। এমনকি ঠিকাদারদের সাথে গোপনে আঁতাত করে মালামাল ক্রয়ের আইটেম সংখ্যা দ্বিগুণ-তিনগুণ এমনকি পাঁচগুণও বাড়িয়ে দেন। যেখান থেকে ফিফটি পারসেন্ট টাকা ভাগিয়ে নেন সাজ্জাদ। এক্ষেত্রে মালামাল ক্রয়ে গঠিত কমিটির সদস্যদেরকেও ম্যানেজ করেন তিনি। যারা সাজ্জাদের পছন্দের লোক হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে মানুষের দখলে হাতির আবাসস্থল-করিডোর!

একই অভিযোগ ডিপো পরিচালনার ক্ষেত্রেও। যেখানে ১০% কমিশন ছাড়া মালামাল ক্রয়ের কোন ফাইল ছাড়েন না তিনি। এছাড়া পরিচালকের চেয়ারে বসার পর সবকটি ডিপোতে বেড়ে যায় স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা। যার কিছু ধরা পড়ে আরএনবি ও পুলিশের হাতে। যা স্ক্র্যাপ চুরির নমুনা মাত্র।

সংশ্লিষ্টদের মতে, গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামত কারখানা থেকে ময়লার গাড়ির আড়ালে মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ওই গাড়িচালককে আটক করে খুলশী থানার পুলিশ। পরে ওই গাড়ি চালক মো. রাসেলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

কারখানার তৎকালীন কর্ম ব্যবস্থাপক রাজীব কুমার দেবনাথ মালামাল চুরির এবং চালক বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, রাসেল রেলওয়ের নিয়মিত ট্রাকচালক। প্রতিদিন ট্রাকে করে সে কারখানা থেকে ময়লা অপসারণ করে। এ সুযোগে সে স্ক্র্যাপ ও সরঞ্জাম চুরি করে বলে স্বীকার করে। ফলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

তিনি জানান, ট্রাকে গড়ে ৫০০-৭০০ কেজি লোহাজাতীয় স্ক্র্যাপ পাচার করা হয়, যার মাসিক পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কেজি এবং বছরে প্রায় ৬০ হাজার কেজি। বাজারমূল্যে যা প্রায় ৩০ লাখ টাকার সমান। গত কয়েক বছর ধরে রেলের সরঞ্জাম ও স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা বেড়ে যায় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় প্রতিবছর সাড়ে ৯০০ যাত্রীবাহী ও প্রায় ৭ হাজার মালবাহী বগির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজ হয়। ফলে এখানে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ ও স্ক্র্যাপ জমা থাকে, যা পাচার চক্রের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

এছাড়া গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে রেলের সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড থেকে তিন ট্রাক স্ক্র্যাপ চুরি করে পাচার করা হয়। ট্রাকগুলো ঢাকায় যাওয়ার পথে মিরসরাই থানা পুলিশ আটক করে। এর আগে ১৪ আগস্ট রেলের ওয়ার্কশপ থেকে সরঞ্জাম ও স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটে। যার মুল্য কোটি টাকারও বেশি।

আরও পড়ুন :  জাকসুর ভিপি স্বতন্ত্র প্যানেলের, জিএস শিবিরের

এভাবে প্রায়ই প্রতিমাসে রেলওয়ের নিউ ডিপো, সেল ডিপো, ক্যারেজ, ওয়ার্কশপ, সরঞ্জাম ক্রয় স্টোরসহ বিভিন্ন স্টেশনে রাখা কোটি কোটি টাকার স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের শেষের দিকে।

সেটি হল টেন্ডারের মাধ্যমে স্ক্র্যাপ বিক্রির ঠিকাদারের সাথে গোপন চুক্তিতে ৬০ টন স্ক্র্যাপ পাচার। সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৮ আইটেমের ১৪০৯ দশমিক ০১৫ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ টেন্ডার মুলে বিক্রয় (দরপত্র প্যাকেজ নং সেল/২২/২০২৩) করা হয়। এটি ছিল গত এক দশকের মধ্যে স্ক্র্যাপ বিক্রয় সবচেয়ে বড় টেন্ডার।

যার সাথে প্রায় ৬০ টন চোরাই স্ক্র্যাপ ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যাই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। যা ডিপো থেকে বের হওয়ার পর সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সেনাবাহিনী তখন ট্রাকভর্তি স্ক্র্যাপ রেলওয়ে পুলিশের কাছে অর্পণ করে। এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন মুখে সাধুর মন্ত্র পাঠে সিদ্ধহস্ত সাজ্জাদুল ইসলাম।

আর এই ঘটনায় রেলওয়ের তৎকালীন এডিজি সরদার শাহাদাত হোসেন (বর্তমানে এলপিআরে) ওয়ার্কশপের তৎকালীন ব্যবস্থাপক আমির উদ্দিন, ডিপোর সহকারী গোলাম রাব্বানী ও নজরুল ইসলাম স্ক্র্যাপ বোঝাই করার দায়িত্বে ছিলেন। ফলে তারা সকলে মিলে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লাগে।

এক পর্যায়ে ঘটনা প্রকাশ না করতে চট্টগ্রামে চাঁদাবাজ তৈরীর কারখানা খ্যাত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের রেলবিটের এক সাংবাদিককে ১০ লাখ এবং ঢাকা থেকে সম্প্রচারিত একটি স্বনামধন্য টিভির এমডিকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ প্রদান করা হয়। এ ঘটনায় সরদার শাহাদাত হোসেনের ডিজির পদোন্নতি ৬ মাসের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। আর সাজ্জাদুল ইসলাম স্কেল হেল্ডাপের দন্ড পান। আর শাস্তিমুলক বদলি পান আমির উদ্দিন, গোলাম রাব্বানী ও নজরুল ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে রবিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ইনভেন্টরি কন্ট্রোল কার্যালয়ে গেলেও সাজ্জাদুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারি বলেন, তিনি এখানে আসেন না। দায়িত্ব গ্রহণের পর এক মাস কোনরকমে এসেছিলেন। এখন ডিপোতে বসেন। অফিসের কাজ ডিপোতে গিয়ে করিয়ে আনতে হয়। সহকারি পরিচালক রফিক উল্লাহ গিয়ে গোপনে সব করিয়ে আনেন। তিনিই এখন আইসিসির অঘোষিত পরিচালক।

আরও পড়ুন :  জাকসুর ভিপি স্বতন্ত্র প্যানেলের, জিএস শিবিরের

একপর্যায়ে দুপুরের দিকে ডিপোতে গেলে সাক্ষাত হয় সাজ্জাদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওখানে আমার কোন কাজ নেই। আমি এস আর থেকে কোন কমিশন নিইনি। নিছি এমন কেউ বলতে পারবে না। আমার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিন্তু আইসিসি দপ্তরের এক কর্মচারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত তিন মাসে দপ্তরে শতাধিক এস আর হয়েছে। যেখানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। যে এস আরে ১০০ আইটেম লাগবে সেখানে ২০০, এমনকি ৩০০-৫০০ আইটেম পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখান থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেছে রফিক উল্লাহ ও সাজ্জাদুল ইসলাম।

প্রশ্নের জবাবে সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, অনৈতিক কোন কাজটা করেছি প্রমাণ দিতে পারবেন না। রেলওয়েতে ১৩ বছর চাকরি জীবনে আমি কোন অনিয়ম-দূর্নীতি করিনি। কোরআনের কসম খেয়ে সেটা বলতে পারি। স্ক্র্যাপ পাচারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তো দুই-তিন বছর আগের ঘটনা। সেটা সমাধান হয়ে গেছে। এখানে স্ক্র্যাপ পাচারের কোন প্রমাণ পায়নি। আমার কোন স্কেলও হেল্ডাপ হয়নি। বদলিও ছিল স্বাভাবিক।

এ বিষয়ে জানতে আইসিসি দপ্তরের সহকারি পরিচালক ও সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের ইনেসপেকশন শাখার এসিওএস রফিক উল্লাহ মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো, বেলাল উদ্দিন বলেন, স্ক্র্যাপ পাচারের ঘটনায় সাজ্জাদ জড়িত ছিল না। ভুল বুঝাবুঝির কারণে বিভাগীয় দন্ড হিসেবে তার স্কেল হেল্ডাপ হয়েছিল। তাছাড়া এস আর নিয়ে অনিয়মের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তবে রফিক উল্লাহ করে সেটা জেনেছি। কাজগুলো মাঠ পর্যায়ে হওয়ায় অনেক কিছু আমাদের নজরে আসে না। বিষয়টি আমি দেখছি। আপনিও ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে নিউজটা করুন।

ঈশান/মখ/মউ

(বি: দ্র: রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল, চট্টগ্রাম ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল (আইসিসি) দপ্তর ও জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের সরঞ্জাম শাখার পরিচালক প্রকৌশলী সাজ্জাদুল ইসলামের নানা অনিয়ম ও দূর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রিয় পাঠক প্রতিবেদন-২ দেখতে চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানের অনলাইন ও প্রিন্ট ভার্সনে) 

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page