সোমবার- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

ফের লতিফ চেম্বারে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম চেম্বার!

ফের লতিফ চেম্বারে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম চেম্বার!

# কারাগারে বসে কলকাঠি নাড়ছেন সাবেক এমপি লতিফ
# সাপোর্ট দিচ্ছেন সাবেক এক সভাপতি
# লতিফ বিরোধী ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ

ওয়ামী লীগের আমলে ১৫ বছর ধরে লতিফ চেম্বার হিসেবে পরিচিতি ছিল চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। এই সময়ে ব্যবসায়ীদের শতবর্ষী এই সংগঠনকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ।

ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লতিফের পরিবার ও সিন্ডিকেটতন্ত্র থেকে মুক্ত হয় সংগঠনটি। গ্রেফতার হন এম এ লতিফ। যেখানে বসে নাড়ছেন কলকাঠিও। যার ফলে একবছরের মাথায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ফের পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। চট্টগ্রাম চেম্বার পরিণত হচ্ছে লতিফ চেম্বারে।

অভিযোগ উঠেছে, ভোটের স্বার্থে চেম্বারের ওই সাবেক সভাপতি বিতাড়িত সেই লতিফের পরিবার ও সিন্ডিকেটতন্ত্রকে পুনর্বাসন করছেন। এরই মধ্যে লতিফের ছেলেসহ তার সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে ভোটার করা হয়েছে। যা বিস্ময়ের ব্যাপার।

শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এমন মন্দব্য করেছেন লতিফের দাপটে চেম্বারে দীর্ঘসময় কোণঠাসা হয়ে থাকা চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজের আহ্বায়ক এসএম নুরুল হক। তিনি বলেন, গত বছর ৫ আগস্টের পর প্রশাসকের চিঠি অনুযায়ী তদন্তের মাধ্যমে যাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলো, তারা আবার কীভাবে, কোন কৌশলে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেন সেটা আমরা জানতে চাই।

তিনি বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলকেন্দ্র বন্দরনগরীতে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয় চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। বৃটিশ আমলে ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা এ চেম্বারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর চেম্বারে নেতৃত্ব দেওয়া অন্তত আটজন সংসদ সদস্য ও চারজন মন্ত্রী হন। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতৃত্বদাতা সংগঠন হিসেবে জন্য এ চেম্বারের মর্যাদা যেমন বেশি, তেমনি রাজনৈতিকভাবেও ব্যবসায়ীদের আগ্রহের কমতি নেই।

তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম চেম্বার এম এ লতিফের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হয়েছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, যিনি পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তিনি লন্ডনে পালিয়ে যান বলে গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছে।

জাবেদের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে জামায়াত ঘরানার এম এ লতিফ ছিলেন চেম্বারের সহ-সভাপতি। ২০০৮-০৯ মেয়াদে লতিফ চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপরই মূলত তার উত্থান শুরু। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে লতিফ চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন, যিনি আগে কখনোই দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ওই নির্বাচনসহ মোট চারবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। নগরীর আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম চেম্বারের কার্যালয় লতিফের নির্বাচনি এলাকার মধ্যেই। এ সুবাদে চেম্বারের কার্যালয়ে বসেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করেন।

এরপর থেকে কখনো সাজানো নির্বাচন, কখনো নির্বাচন ছাড়াই নিজের পরিবারের সদস্য ও পছন্দের ব্যবসায়ীদের দিয়ে চেম্বারকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন লতিফ। চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনে এম এ লতিফ সমর্থিত প্যানেল বিজয়ী হন।

প্রথমবারের মতো সভাপতি হন লতিফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম। তিনি ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে পরবর্তী সময়ে তিনি লতিফের আশীর্বাদে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতিও নির্বাচিত হন।

এর মধ্যে ২০১৭-১৯ সালের মেয়াদে বিনা ভোটে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক হন এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ। ২০২৩-২৫ সালের মেয়াদের ২৪ সদস্যের পুরো পর্ষদের সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই পর্ষদে এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ সভাপতি এবং ওমর মুক্তাদির পরিচালক হয়েছিলেন।

তৎকালীন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমের মেয়ে রাইসা মাহবুব সহ-সভাপতি এবং ভাই আলমগীর পারভেজ চেম্বারের পরিচালক হয়েছিলেন। এছাড়া কমিটিতে পরিচালক হয়েছিলেন নির্বাচনি বোর্ডের প্রধান নুররু নেওয়াজ সেলিমের মেয়ের জামাই বেনাজির চৌধুরী নিশান ও ছেলে মোহাম্মদ সাজ্জাদ উন নেওয়াজ। এছাড়া, বাকি পরিচালকরাও ছিলেন লতিফের বলয়েরই।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আত্নগোপনে চলে যান এম এ লতিফ। অবশ্য ১৭ আগস্ট তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এখন কারাগারে আছেন তিনি। ওই বছরের ১৮ আগস্ট নগরীর আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের চেম্বার কার্যালয়ের সামনে বৈষম্যের শিকার ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে চেম্বারকে লতিফের পরিবার ও সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্ত করার দাবি জানান।

আরও পড়ুন :  সিএমপির ‘মানিলন্ডারিং’ তালিকায় ১৪৫ নেতা ও মন্ত্রী-এমপির নাম

এ পরিস্থিতিতে ২৮ আগস্ট চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি তরফদার রুহুল আমিন ও পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ২ সেপ্টেম্বর সভাপতি ওমর হাজ্জাজসহ পর্ষদের বাকি ২২ জন পদত্যাগ করেন। ১১৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ চেম্বার থেকে পুরো পরিচালনা পর্ষদ পদত্যাগের ঘটনা সেটিই প্রথম।

এরপর ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসকের দায়িত্ব নেন তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা। চলতি বছরের ১১ আগস্ট চট্টগ্রাম চেম্বারের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আগামী ১ নভেম্বর চট্টগ্রাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে চেম্বারের নির্বাচন।

যেভাবে পরিবারতন্ত্র পুনর্বহালের অপচেষ্টা হচ্ছে
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অন্তরালে বিভিন্ন ধরনের খেলা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লতিফের সিন্ডিকেটভুক্তদের ভোট টানার কৌশল, যার মধ্য দিয়ে তাদের ফের চেম্বারে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। কারাগারে বসেই এ নিয়ে কলকাঠি নাড়ছেন এম এ লতিফ।

সূত্র জানায়, চেম্বারে অন্তর্ভুক্ত দুটি আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ হলো- টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপ। এগুলো লতিফের পকেট ভোট হিসেবে পরিচিত। তাদের মাধ্যমেই লতিফ চেম্বারের ভোট নিয়ন্ত্রণ করতেন। ব্যবসায়ীদের লিখিত আপত্তির প্রেক্ষিতে এ দুটি গ্রুপকে গত ২০ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অকার্যকর ঘোষণা করে।

গত ৭ সেপ্টেম্বর চেম্বার নির্বাচনের প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এতে বাদ পড়ে বিতর্কিত টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপ। কিন্তু বিস্ময়করভাবে চেম্বার নির্বাচনের আপিল বোর্ড গত ১৪ সেপ্টেম্বর এ দুটি ক্যাটাগরিকে আবারও ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

জানা গেছে, টাউন অ্যাসোসিয়েশনের চারটি প্রতিষ্ঠান ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছে। এগুলো হলো-পটিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, রাঙ্গুনিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, হাটহাজারী অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বোয়ালখালী অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।

পটিয়া অ্যাসোসিয়েশন থেকে ভোটার হয়েছেন এম এ লতিফের ছেলে ওমর মুক্তাদির। পটিয়ায় একটি মৎস্য খামারের মালিক হিসেবে তিনি এই অ্যাসোসিয়েশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। পটিয়া অ্যাসোসিয়েশন থেকে ভোটার হয়েছেন লতিফের আপন ভাগ্নে আদনানুল ইসলাম।

রাঙ্গুনিয়া অ্যাসোসিয়েশন থেকে ভোটার হয়েছেন আবছার হাসান চৌধুরী জসিম। হাটহাজারী অ্যাসোসিয়েশন থেকে ভোটার হয়েছেন দুজন। এরা হলেন-আনিস উদ্দিন ও মোহাম্মদ মনির উদ্দিন। এদের মধ্যে মনির উদ্দিন হলেন লতিফের স্ত্রীর বড় ভাইয়ের জামাতা।

বোয়ালখালী অ্যাসোসিয়েশন থেকে ভোটার হয়েছেন সাজ্জাদ উন নেওয়াজ। তিনি লতিফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুন নেওয়াজ সেলিমের ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি ফেনীতে। কিন্তু তিনি বোয়ালখালী অ্যাসোসিয়েশনের ভোটার হয়েছেন।

অপরদিকে ট্রেড গ্রুপের ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো-চিটাগাং টায়ার টিউব ইমপোটার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ, চিটাগাং মিল্ক ফুড ইমপোটার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ এবং চিটাগাং ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যালস ইমপোটার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ।

চিটাগাং টায়ার টিউব থেকে ভোটার হয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম সাইফুল আলম। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক। চিটাগাং মিল্ক ফুড থেকে ভোটার হয়েছেন চারজন। এর মধ্যে রয়েছেন-পিএইচপি মোটর্সের প্রোপাইটার আকতার পারভেজ হিরু। তিনি পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের ছেলে।

চিটাগাং ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যালস থেকে ভোটার হয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে রয়েছেন-স্মার্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ও সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমীরুল হক। মোস্তাফিজুর রহমান এম এ লতিফের বেয়াই। লতিফের দ্বিতীয় ছেলে ওমর খৈয়াম মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়েকে বিয়ে করেছেন। চিটাগাং ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যালস গ্রুপ নামের এই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি হলেন মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ের জামাতা ওমর খৈয়াম। টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপ থেকে তিনজন করে ছয়জন প্রার্থী পরিচালক পদে নির্বাচন করবেন। কিন্তু তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন।

ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, চলতি বছর ২০ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে এমন কী খেলা হলো পর্দার আড়ালে, যাতে আবারও লতিফ সাহেবের ছেলে, আত্নীয়স্বজনকে চট্টগ্রাম চেম্বারে ফেরত আনা হলো? পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এই লতিফ গংকে যদি শেষপর্যন্ত ভোটার তালিকায় রেখে নির্বাচনের আয়োজন করা হয় তাহলে আমরা ১ নভেম্বর সেই নির্বাচন হতে দেব না।

আরও পড়ুন :  সিএমপির ‘মানিলন্ডারিং’ তালিকায় ১৪৫ নেতা ও মন্ত্রী-এমপির নাম

ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, একসময় চট্টগ্রাম চেম্বারে নেতৃত্ব দেওয়া একজন সভাপতি এই নির্বাচনে একটি প্যানেল দিচ্ছেন। ভোটের কৌশল হিসেবে তিনি লতিফের পরিবারের ছয়জনকে ভোটার করার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন। পর্দার আড়ালে এম এ লতিফের সঙ্গে তিনি সমঝোতা করেছেন বলে তাদের অভিযোগ।

ব্যবসায়ীরা জানান, এম এ লতিফ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। সেখানে বসে তিনি কলকাঠি নাড়ছেন। এতে তার পরিবারের ছয়জনকে ভোটার করা হচ্ছে। তার মানে চট্টগ্রাম চেম্বারে এম এ লতিফ আবার আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী যে প্রেক্ষাপট, সেই প্রেক্ষাপটে আবার লতিফের পরিবারতন্ত্রকে চেম্বারে পুনর্বাসন করা, চট্টগ্রাম চেম্বার এবং ব্যবসায়ীদের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। এর মধ্য দিয়ে এম এ লতিফ গং আবারও চেম্বারকে কুক্ষিগত করার সুযোগ পাবে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, যিনি এ কাজগুলো করছেন তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। লতিফ চেম্বারকে কুক্ষিগত করে রাখার কারণে একসময় তিনি পরিচালক নির্বাচন করেও হেরে গিয়েছিলেন। অথচ সেই ব্যক্তি কীভাবে লতিফের মতো একজন ব্যক্তিকে চেম্বারে পুনর্বাসন করছেন। আমরা এতে বিস্মিত হয়েছি।

পুরনোদের বহাল করলেও নতুনরা বাদ
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ আগে থেকেই ট্রেড গ্রুপের সদস্য। কিন্তু শেষ কয়েক বছর চেম্বারের পক্ষপাতদুষ্টু আচরণে তারা সদস্য পদ নবায়ন করেনি। এবার চেম্বার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে এমন আশা থেকে সদস্যপদ নবায়ন করতে আবেদন করার কথা জানান সংগঠনটির ব্যবসায়ী প্রকৌশলী মাশফিক আহমেদ রুশাদ।

তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, চেম্বার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। তাই আমরা আগের সব ঝামেলা বাদ দিয়ে ট্রেড গ্রুপের সদস্যপদ নবায়ন করার জন্য আবেদন করি। কিন্তু আবেদনের প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও ফলাফল জানতে পারিনি। আবেদন করার পর যদি কোনো সদস্য থাকে তাহলে তা বাদ করে দিতেই পারে। কিন্তু সদস্যপদও দিচ্ছে না, আবার বাতিলও করছে না; এমন অবস্থায় আমরা যে স্বচ্ছতা আশা করেছি, তা পাচ্ছি না।

এ বিষয়ে চিটাগং চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নুরুল হক বলেন, এগুলো আসলে দিচ্ছে না কোনো একটা অদৃশ্য কারণে। যে সংগঠনগুলো তদন্ত পরবর্তীতে বাতিল হয়েছে, তারা একদিনেই আবার ফাইনাল ভোটার লিস্টে ঢুকে গেছে। এ সূত্র মিলাতে পারলেই বোঝা যাবে, এখানে একটি চক্র বাইরের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে লতিফের প্রেতাত্না এখনও চেম্বারে সক্রিয় রয়েছে।

নতুনদের সদস্যপদ পেতেও নাজেহাল!
জানা যায়, চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলা সিমেন্ট ডিলার এন্ড মার্চেন্ট গ্রুপ নতুনভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ সদস্যপদ নবায়নের জন্য আবেদন করে। এরপর তাদের পক্ষ থেকে লিখিত এবং মৌখিকভাবে আবেদন অনুমোদনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলেও চেম্বারের কোনো সাড়া পাননি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলা সিমেন্ট ডিলার এন্ড মার্চেন্ট গ্রুপ পুনরায় আবেদন করেও কোনো ফল পায়নি।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক কাভার্ড ভ্যান ও মিনি ট্রাক মালিক গ্রুপের প্রতিনিধি মো. আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থাকা অবস্থায় সদস্যপদ নবায়নের জন্য আবেদন করি, কিন্তু চেম্বার থেকে কোনো সাড়া পাইনি। ট্রাক মালিক গ্রুপ থেকেও সাধারণ সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিলাম, তবু বহুবার যোগাযোগ করার পরও কোনো ফল পাইনি। পরে চেম্বারের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি সালাউত উল্লাহ জানান, পরবর্তী বোর্ড গঠনের পর বিষয়গুলো সমাধান করা হবে।

এ নিয়ে দীর্ঘ ভোগান্তি পোহানো চট্টগ্রাম জেলা সিমেন্ট ডিলার এন্ড মার্চেন্ট গ্রুপের প্রতিনিধি এবং ডায়মন্ড সিমেন্টের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাকিম আলী বলেন, জটিলতা কি, তা তো আমরা বুঝিনি। তারা জানিয়েছে, এখন সিদ্ধান্ত নিবে না। ৫ আগস্ট পর একটু এলোমেলো রয়েছে। এজন্য তারা এখন সদস্যপদ দিচ্ছে না। শুধু বলেছে, এখন প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। তবে পরবর্তীতে দেখবেন বলে আমাদের আবেদনটি পেন্ডিং রেখেছে।

আরও পড়ুন :  সিএমপির ‘মানিলন্ডারিং’ তালিকায় ১৪৫ নেতা ও মন্ত্রী-এমপির নাম

সদস্যপদ নবায়নেও নাজেহাল!
চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সদস্যপদ গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক ট্রেড গ্রুপ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া এবং বিভিন্ন ধাপ স¤পন্ন করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা নানা জটিলতার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, সদস্যপদ নবায়নের জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন, ব্যাংক ড্রাফট, ট্যাক্স সনদ ও ট্রেড লাইসেন্সসহ একাধিক কাগজপত্র জমা দিতে হচ্ছে। তবে যাচাই-বাছাই ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে সময়মতো সদস্যপদ মেলেনি। এতে করে তিনটি ট্রেড গ্রুপে চেম্বারের আসন্ন নির্বাচনে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

চেম্বার সূত্রে জানা যায়, ১৪ সেপ্টেম্বর চূড়ান্তভাবে ৬,৭৮০ জন সদস্যের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এরমধ্যে সাধারণ সদস্য হিসেবে ৪,০০১, সহযোগী সদস্য হিসেবে ২,৭৬৪, চারটি শহর সমিতির সদস্য হিসেবে ৫ জন এবং তিনটি ট্রেড গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১০ জন তালিকাভুক্ত হয়। তবে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া একাধিক ট্রেড গ্রুপ আবেদন করার পরও তা গ্রহণ বা বাতিল করা হয়নি। নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ততা থাকায় আবেদন করা ট্রেড গ্রুপগুলোর সদস্যপদ নিয়ে নতুন বোর্ড সিদ্ধান্ত নিবে বলে মৌখিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, চেম্বার ব্যবসায়ীদের সংগঠন। ব্যবসায়ীরা যদি রাজনীতির বলি হন, এতে চেম্বারের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রন্ত হবেন। নির্বাচন সামনে, তাই সদস্যপদ নিবন্ধন বা নবায়নের কাজ বন্ধ থাকা উচিত নয়। যারা আবেদন করেছেন, তাদের কাগজপত্র যাচাই করে নেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি তাদের সদস্যপদ দেওয়ার কোনো আপত্তি থাকে, তা ¯পষ্টভাবে জানানো উচিত। চার-পাঁচ মাস ধরে আবেদন ঝুলিয়ে রাখা ঠিক নয়।

চেম্বারের নির্বাচন বোর্ডের মতামত!
অধিকাংশ ব্যবসায়ীর অভিযোগ, চিটাগং চেম্বারের মেম্বারশিপ শাখার সহকারী সচিব মো. সালাউত উল্লাহর অসহযোগিতার হাত রয়েছে। তবে এ বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আমাদের হাতে কিছু নেই। আমরা কাজ করি, কিন্তু চেম্বারের অনেক বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। প্রশাসক মহোদয় যেভাবে নির্দেশ দেন, আমরা তা অনুযায়ী কাজ করি।

পুরো বিষয়টি উপস্থাপন করে চাইলে চেম্বারের নির্বাচন বোর্ডের সদস্য আহমেদ হাছান বলেন, “চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বিধি অনুযায়ী, জুন মাসের পর সকল সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায় এবং ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নবায়ন করতে হয়। একই বিধি অনুযায়ী, নির্বাচনের জন্য চেম্বারের পুরাতন সদস্যরা ৬০ দিন আগে এবং নতুন সদস্যরা ১২০ দিন আগে সদস্যপদ গ্রহণ করলে তারা ভোটার হিসেবে গণ্য হবেন। সদস্যপদ নিয়ে যে জটিলতার কথা বলা হয়েছে, তা আমার জানা নেই।

তবে আমার জানা মতে, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ ছিল। এর মধ্যে গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ গ্রুপ বা এ ধরনের একটি নামি সংগঠন আপিল করেছে। তবে তারা তিন দিনের মধ্যে আপিল করেনি, বরং চতুর্থ দিনে আবেদন করেছিলেন। বিষয়টি আমরা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক পদে নিযুক্ত চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. নুরুল্লাহ নুরী বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। ১ সেপ্টেম্বর ভোটার তালিকা প্রকাশ হয়েছে। আমি ৯ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নিয়েছি। ভোটার তালিকা নিয়ে কী অভিযোগ, আমি কিছুই জানি না। আমার কাজ হচ্ছে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নির্বাচনটা স¤পন্ন করে দায়িত্ব নির্বাচিতদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বিদায় নেওয়া। কারও কোনো আপত্তি থাকলে সেটা নির্বাচন কমিশন সমাধান করবে।

উল্লেখ্য, গত রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) থেকে চট্টগ্রাম চেম্বার নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফরম বিক্রি হবে। মনোনয়ন ফরম জমাদানের শেষ তারিখ ২১ সেপ্টেম্বর। ৫ অক্টোবর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। এরপর ১ নভেম্বর নগরীর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট অনুষ্ঠিত হবে।

ঈশান/মখ/মসু

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page