সোমবার- ১০ নভেম্বর, ২০২৫

সীতাকুণ্ড টু বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড

জাহাজ কেনায় শওকত আলী চৌধুরীর রহস্যময় লেনদেন

জাহাজ কেনায় শওকত আলী চৌধুরীর রহস্যময় লেনদেন

# তিন ভুয়া কোম্পানির অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি বিএফআইইউ
# শওকত আলী চৌধুরীর নামে ১৪টি, তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীনের নামে ১৫টি, মেয়ে জারা নামরীনের নামে ৯টি একাউন্ট ছাড়াও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে দেশের ২৮টি ব্যাংকে মোট ১৮৭টি একাউন্ট রয়েছে।

বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড থেকে পুরোনো জাহাজ কেনায় জড়িয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির (ইবিএল) চেয়ারম্যান শওকত আলী চৌধুরী ও তার তিন প্রতিষ্ঠানের নাম। একই ঠিকানায় নিবন্ধিত এই তিন প্রতিষ্ঠানের বিদেশি কোম্পানি থেকে জাহাজ কেনার কোন অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)।

সংস্থার একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে জানা যায়, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখা ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এস এন করপোরেশনের পক্ষে তিনটি ঋণপত্র খোলা হয়। সুবিধাভোগী ছিল রেড রুবি গ্রুপ লিমিটেড, ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেড এবং কলাম্বিয়া সিস লিমিটেড। তিনটি কোম্পানিই বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত এবং তিনটির নিবন্ধনের ঠিকানা ছিল একই।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ) জানায়, বৃটিশ ভার্জিনের এই ঠিকানা থেকেই তদন্তের প্রথম সূত্র পাওয়া যায়। পরে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৮ হাজার কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করে।

বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের এলসি নং ২৪৯৪১৫০২০০৩৯-এর মূল্য ছিল ৭৪ দশমিক ৯৬ লাখ ডলার (প্রায় ৯৩৭ কোটি টাকা), ২০২০ সালের এলসি নং ২৪৯৪২০০১০০২৫-এর মূল্য ৪ দশমিক ৬৪ লাখ ডলার (প্রায় ৫৮ কোটি টাকা) এবং ২০২৩ সালের এলসি নং ২৪৯৪২৩০১০০১৩-এর মূল্য ছিল ২১ দশমিক ৪১ লাখ ডলার (প্রায় ২৬৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন দেশের সঙ্গে লেনদেনে ব্যাংকগুলোকে এনহ্যান্সড ডুয়ো ডিলিজেন্স বা ইডিডি করতে হয়। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ইডিডি ছাড়াই এলসিগুলো খুলেছে। ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশন ২০১৮ নির্দেশনার এ লঙ্ঘনের উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।

আরও পড়ুন :  প্রাথমিকে ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন যেভাবে

তদন্তে আরও দেখা যায়, ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেডের ইমেইল ঠিকানা এবং রেড রুবি গ্রুপ লিমিটেডের ইমেইল ঠিকানা ছিল একই। এতে মালিকানা ও স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। জাহাজ কেনাবেচা, বিপুল অঙ্কের লেনদেন এবং এলসির অসঙ্গতি—সব মিলিয়ে এই রহস্যময় লেনদেন নিয়ে অনলাইন পোর্টাল বাংলা আউটলুকে জুলকারনাইন সায়ের তুলে ধরেছেন বিস্তারিত অনুসন্ধান।

বাংলা আউটলুক লিখেছে, বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত সন্দেহভাজন শেল কোম্পানির সঙ্গে এই আর্থিক লেনদেন বৈদেশিক বাণিজ্যের স্বচ্ছতা এবং অর্থ পাচারের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে। পুরোনো বা অচল জাহাজ সাধারণত দেশে আনা হয় ভাঙার উদ্দেশ্যে।

পুরোনো জাহাজ আমদানি করে ভেঙে লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়ামসহ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। দেশের মোট লোহা ও রডের চাহিদার বড় অংশ আসে এই খাত থেকে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলজুড়ে রয়েছে দেশের প্রধান শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হিসেবেও বিবেচিত। বছরে শতাধিক জাহাজ ভাঙা হয় এই উপকূলে।

বাংলা আউটলুক বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নথি পর্যালোচনা করে দেখেছে, শওকত আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীন, মেয়ে জারা নামরীন, ছেলে জারান আলী চৌধুরী এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে দেশের ২৮টি ব্যাংকে মোট ১৮৭টি হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে শওকত আলীর নামে ১৪টি, তাসমিয়া আম্বারীনের নামে ১৫টি, জারা নামরীনের নামে ৯টি, জারান আলীর নামে ৩টি এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ১৪৬টি হিসাব।

চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত এসব হিসাবে জমা হয়েছে ৮ হাজার ৪০৭ দশমিক ৯ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে তোলা হয়েছে ৮ হাজার ২৪৭ দশমিক ৫ কোটি টাকা। বর্তমানে হিসাবগুলোতে স্থিতি রয়েছে প্রায় ১৭৩ দশমিক ৫৩ কোটি টাকা।

বাংলা আউটলুককে বিএফআইইউ জানিয়েছে, এসব হিসাবের কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী এবং কাগজপত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওপেন সোর্স ও সরকারি সংস্থার তথ্যও পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিদেশে সম্পদ বা বিনিয়োগের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।

আরও পড়ুন :  শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ

বাংলা আউটলুকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এস এন করপোরেশনের নামে ২০১২ সাল থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানির ১৪১টি এলসি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি এলসিতে জাহাজের চূড়ান্ত গন্তব্য চট্টগ্রাম ছিল কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শিপিংবিষয়ক বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সংবাদমাধ্যম লয়েডস লিস্টে একই জাহাজ সম্পর্কে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। একই ঠিকানায় নিবন্ধিত তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে জাহাজ কেনা এবং তথ্যের অসঙ্গতিগুলো সন্দেহ আরও ঘনীভূত করছে।

চট্টগ্রামের ৬ ব্যাংকের একাউন্ট ঘিরে রহস্য
চট্টগ্রামে ঢাকা ব্যাংক পিএলসির জুবিলি রোড শাখায় শওকত আলী চৌধুরীর প্লাটিনাম হিসাবে ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জমা পড়েছে ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সব টাকাই তুলে ফেলা হয়েছে। ব্যক্তিগত এই হিসাব ব্যবহৃত হয়েছে এসএন করপোরেশনের ব্যবসায়িক লেনদেনে।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির শাখায় শওকত আলীর ব্যক্তিগত প্রিমিয়াম সেভিংস হিসাব থেকে ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ আল মামুন অন্তত ১২৫ বার নগদ টাকা তুলেছেন। একই শাখায় শওকতের মেয়ে জারা নামরীনের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ী হিসাবে ২০১৫ সাল থেকে জমা পড়েছে ৩১ কোটি টাকা, যদিও তার আয়ের সঙ্গে টাকার এই অংক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখান থেকেও ৯৮ বার নগদ টাকা তুলে নিয়েছেন কোম্পানি সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ আল মামুন।

মিডল্যান্ড ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায়ও শওকতের ছেলে জারান আলী চৌধুরীর সুপার সেভার হিসাবে এস এন করপোরেশন থেকে টাকা ঢুকেছে। ওই টাকা থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগও করা হয়েছে। জারানের আয়ের উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মায়ের ব্যবসা।

চট্টগ্রামের জুবিলি রোডে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শাখায় এসএন করপোরেশনের সিসি (হাইপো) হিসাব থেকে নামরীন এন্টারপ্রাইজ ও শিপ ব্রেকিং খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তরের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া নিড ড্রেসেস প্রাইভেট লিমিটেডে জমা হওয়া ৫০ কোটি ৪০ লাখ টাকা তদন্তকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আরও পড়ুন :  শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ

অন্যদিকে দি সিটি ব্যাংক পিএলসির আগ্রাবাদ শাখায় শওকত আলীর ব্যক্তিগত হিসাব ব্যবহার করে ৩ কোটি টাকা মিডওয়ে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হয়েছে। একই হিসাবে জমা পড়ে ১০৬ কোটি টাকা, যা পরে স্থানান্তর করা হয় এস এন করপোরেশনে। এতে কর ফাঁকির আশঙ্কার কথা উল্লেখ রয়েছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা অনুমোদন ছাড়াই এস এন করপোরেশনকে ২৬ দশমিক ৯ কোটি টাকার এলটিআর সুবিধা দেয় এবং পরে পোস্ট-ফ্যাক্টো অনুমোদন নেয়, যা ব্যাংকিং নীতি ও রীতির লঙ্ঘন।

এস এন করপোরেশনের নামে ২০১২ সাল থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানির ১৪১টি এলসির মধ্যে ১১টি এলসিতে জাহাজের চূড়ান্ত গন্তব্য চট্টগ্রাম ছিল কি না, সেটা নিয়ে আছে গুরুতর সন্দেহ। নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী।

এক বিবৃতিতে ইবিএল চেয়ারম্যানের পদে থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন— এমন অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেন শওকত আলী চৌধুরী বলেন, আশির দশক থেকে তিনি ব্যবসায় জড়িত এবং দেশের অর্থনীতিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছেন। ব্যাংকিং, বিমা, শিপ রিসাইক্লিং, চা, সিরামিকস, আবাসন ও লজিস্টিকসসহ নানা খাতে তার বিনিয়োগ রয়েছে। ৪০ বছরের বেশি সময়ের ব্যবসায়িক জীবনে কখনো কোনো ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হননি, ঋণ পুনঃতফসিল বা সুদ মওকুফের আবেদনও করেননি।

তিনি দাবি করেন, ‘আমার কোনো খেলাপি ঋণ না থাকলে আত্মসাৎ করা টাকার প্রশ্নই ওঠে না। ব্যবসায়িক লেনদেনে ৮ হাজার কোটি টাকার পরিমাণ অস্বাভাবিক নয়।’ তার ভাষায়, ২০১৩–১৪ থেকে ২০২৩–২৪ করবর্ষ পর্যন্ত টানা ১১ বছর তিনি, তার স্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেরা করদাতার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

ঈশান/বেবি/মম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page