
# মূলে বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ
# আছে রাজনৈতিক মদদ
# অসহায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদি সরকার পতনের পর থেকে চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়েছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে ঘটছে খুনোখুনি। এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে অন্তত এক ডজন শীর্ষ সন্ত্রাসী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের নয় জন দেশে থাকলেও তিন জন বিদেশে অবস্থান করে এখানের অপরাধ জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
তাদের প্রত্যেকের এলাকাভিত্তিক একাধিক উপ-গ্রুপ রয়েছে। যাদের দিয়ে অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। উপ-গ্রুপের সদস্যদের কাছে আছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, ইট-বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে এসব গ্রুপের মধ্যে ঘটছে খুনোখুনির ঘটনা।
সর্বশেষ গত বুধবার চালিতাতলীতে আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উলাহ গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। প্রকাশ্যে গণসংযোগের সময় শত শত মানুষের সামনে ঘাড়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামে বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, ইট-বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিরোধে জেলাকে অস্থির করে রেখেছে। গত ১৪ মাসে ৪০টির মতো হত্যাকান্ড ঘটেছে। এরমধ্যে রাউজান উপজেলায় ১৭টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৪টি ও চট্টগ্রাম শহরে ৪টি হত্যাকান্ড রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে ঘটেছে।
সক্রিয় এক ডজন সন্ত্রাসী গ্রুপ
পুলিশের বিভিন্ন সূত্রমতে, চট্টগ্রামে এক ডজন সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে আছে সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ, রায়হান আলম, হাবিব খান, সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ, মোবারক হোসেন ইমন, শহিদুল ইসলাম বুইস্যা, ইসমাইল হোসেন টে¤পু, ফজল হক, মেজর ইকবাল, বিধান বড়ুয়া, আজিজ উদ্দিন ইমু ও আজিজুল হক। এর মধ্যে বড় সাজ্জাদ, হাবিব খান ও ফজল হক বিদেশে অবস্থান করলেও উপ-গ্রুপ দিয়ে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে।
আলোচিত হত্যাকান্ড
চট্টগ্রামে গত ১৪ মাসে রাউজান উপজেলায় বেশ কিছু হত্যাকান্ডে নাম এসেছে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের। এরমধ্যে গত বছরের ২৯ আগস্ট কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে যুবলীগ কর্মী আনিস ও মাসুদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২১ অক্টোবর চান্দগাঁওয়ে তাহসীনকে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি রাউজানের নোয়াপাড়া এলাকায় দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে, ২৯ মার্চ বাকলিয়া এক্সেস রোডে সরওয়ার বাবলার দুই সহযোগী মানিক ও রিফাতকে, ১১ এপ্রিল রাউজানে যুবদল কর্মী ইব্রাহিমকে, ২৩ মে পতেঙ্গায় ঢাকাইয়া আকবর, ২৫ অক্টোবর রাউজানে যুবদল কর্মী আলমগীর আলম সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর বিএনপির চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৮ মামলার আসামি সরওয়ার বাবলাকে।
বিদেশে বসে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ বড় সাজ্জাদের
বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিয়াতলী এলাকার আব্দুল গণি কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ। আলোচনায় আসে নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই। ছাত্রশিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদের বিরুদ্ধে খুনসহ রয়েছে এক ডজন মামলা। যদিও ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে একাধিক বিবৃতিতে বলা হয়, সাজ্জাদ শিবিরের কেউ নয়।
১৯৯৯ সালে পাঁচলাইশের তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খান নিজ বাড়ির সামনে খুন হন। ওই সময় লিয়াকত হত্যায় সাজ্জাদের নাম উঠে আসে। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে ওই মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান সাজ্জাদ। এরপর থেকে অপরাধ জগতে সাজ্জাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
২০০০ সালের ১২ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটের কাছে দিনদুপুরে ব্রাশফায়ারে মাইক্রোবাসে থাকা ছয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ আট জনকে হত্যা করা হয়। ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ মামলাটির রায় দেন চট্টগ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ একরামুল হক চৌধুরী। এ মামলায় বড় সাজ্জাদসহ চার জনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। হাবিব খানসহ তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়।
২০০০ সালের ৩ অক্টোবর বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিয়াতলীতে একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হয় বড় সাজ্জাদ। গ্রেপ্তারের পর ২০০৪ সালে জামিনে ছাড়া পেয়ে সাজ্জাদ দুবাইয়ে পালিয়ে যায়। তাকে ধরতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ এখনও ঝুলছে।
সাজ্জাদ বিদেশে বসে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী, চান্দগাঁও এবং হাটহাজারী এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। সবশেষ বাবলাকে হত্যার ঘটনায় গত বৃহ¯পতিবার বায়েজীদ থানায় মামলা করেন নিহতের বাবা আবদুল কাদের। এতে বিদেশে পলাতক সাজ্জাদসহ সাত জনের নামোল্লেখ করে ২২ জনকে আসামি করা হয়।
কথায় কথায় গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসী রায়হান
রাউজানের ৭ নম্বর রাউজান ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জুরুরকুল খলিফা বাড়ির মৃত বদিউল আলমের ছেলে রায়হান আলম। চট্টগ্রাম পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী। তার বিরুদ্ধে খুন, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানায়, রায়হানের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় জোড়া খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলা। গত ৩০ মার্চ রাতে নগরীর বাকলিয়া এক্সেস রোডে প্রাইভেটকারে থাকা মো. বখতিয়ার হোসেন ওরফে মানিক (২৮) ও আব্দুল্লাহ আল রিফাত (২২) নামে দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় বখতিয়ার হোসেন ওরফে মানিকের মা ফিরোজা বেগম বাদী হয়ে বাকলিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী শারমিন আক্তার তামান্নাকে হুকুমের আসামি করা হয়। রায়হানকেও এই মামলার আসামি করা হয়। এই মামলায় পুলিশ চার জনকে গ্রেপ্তার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে রায়হান।
পুলিশ সূত্র জানায়, ছোট সাজ্জাদের বাহিনীতে রয়েছে ২৫ জন সক্রিয় সদস্য। গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিংমল থেকে সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বাহিনীর হাল ধরে পাঁচ সহযোগী। তাদের অন্যতম সাজ্জাদের ডানহাত হিসেবে পরিচিত রায়হান। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে রায়হান দ্বিতীয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিতো রায়হান। স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিএনপির সভা-সমাবেশে যোগ দিতে শুরু করে।
পুলিশের ভাষ্যমতে, কথায় কথায় গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসী রায়হান। ঠিক তার গুরু সন্ত্রাসী সাজ্জাদের মতো। তাকে ধরতে একাধিকবার অভিযান চালিয়েও পাওয়া যায়নি। রাউজান ও ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা তার। সেখান থেকে এসে অপরাধ করে, বিশেষ করে গুলির পর দ্রুত পাহাড়ের নিরাপদ স্থানে চলে যায়। মূলত সন্ত্রাসী সাজ্জাদের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে রায়হান দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে।
কারাগারে বসে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ ছোট সাজ্জাদের
হাটহাজারী থানার শিকারপুর গ্রামের সোনা মিয়া সওদাগর বাড়ির জামালের ছোট ছেলে সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ। তাকে বুড়ির নাতি হিসেবে অনেকে চেনেন। ছোট সাজ্জাদের বিরুদ্ধে খুনসহ এক ডজন মামলা রয়েছে। গত ১৫ মার্চ ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিংমল থেকে পুলিশ সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে কারাগারে আছে। অনেকের মতে, এখনও কারাগারে বসে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে সাজ্জাদ।
২০০৪ সালে বড় সাজ্জাদ বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর তার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে একেক সময়ে একেকজনকে কাছে টেনে নিয়েছে। এমনকি বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও এবং হাটহাজারী এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই ফোন আসে সাজ্জাদের। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলে শিষ্যদের দিয়ে হামলা করায়।
গত ২৯ আগস্ট রাতে কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে মো. আনিস ও মাসুদ কায়ছারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পৃথক মামলার আসামি ছোট সাজ্জাদ। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে বায়েজিদ বোস্তামীর কালারপুল এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে প্রকাশ্যে চালায় সাজ্জাদ। গত ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়া এলাকায় মাইক্রোবাসে এসে প্রকাশ্যে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসীন নামের এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে সাজ্জাদ আলোচনায় আসে।
বিদেশে বসে চাঁদাবাজি হাবিব খানের
শীর্ষ সন্ত্রাসী হাবিব খান আবারও অপরাধ জগতে সক্রিয় হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও হাটহাজারী উপজেলায় চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু ঘটনায় উঠে এসেছে হাবিব খানের নাম। যদিও হাবিব খান বর্তমানে বিদেশে পলাতক আছে। বিদেশে বসেই তার অনুসারীদের দিয়ে চাঁদাবাজি ও অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি আলী মর্তুজা চৌধুরী, নগরের বহদ্দারহাটে আলোচিত আট জন হত্যাসহ অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে।
অভিজ্ঞ শুটার ও ভাড়াটে খুনি মোবারক
ফটিকছড়ির বাসিন্দা মোবারক হোসেন ইমন অপরাধ জগতে অভিজ্ঞ শুটার হিসেবে পরিচিত। তাকে ভাড়াটে খুনি বলা হয়। সেও ছোট সাজ্জাদের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুনসহ ৯টি মামলা।
চান্দগাঁও এবং পাঁচলাইশে বুইস্যা আতঙ্ক
ভোলার দৌলতখান উপজেলার মোহাম্মদ আলীর ছেলে শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা। চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম ষোলশহর এলাকায় থাকে। পড়াশোনা করেছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। আওয়ামী লীগের সময়ে বিভিন্ন সমাবেশে দলবল নিয়ে যোগ দিতো। পরিচয় দিতো ছাত্রলীগের নেতা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে যুবদল নেতা হিসেবে।
চান্দগাঁও এবং পাঁচলাইশ এলাকার মানুষ এখন বুইস্যার আতঙ্কে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদকসহ ২০টি মামলা রয়েছে। চাঁদা আদায় ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে কথায় কথায় প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে। তার রয়েছে টর্চারসেলও। চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে তাদের ধরে নিয়ে টর্চারসেলে নির্যাতন করা হয়।
কারাগারে বসে অপরাধ কর্মকান্ড করায় টে¤পু ইসমাইল
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ইউসুফের ছেলে ইসমাইল হোসেন টে¤পু। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে চান্দগাঁও থানার পশ্চিম ফরিদাপাড়া এলাকায়। এখন পরিবার নিয়ে থাকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটি এলাকায়।
ছোটবেলায় টে¤পু চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতো। ২০০৩ সালে বহদ্দারহাট এলাকায় মাছ কাটার কাজ শুরু করে। তখন থেকেই বহদ্দারহাট এলাকায় ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে অপরাধ জগতে প্রবেশ। পরে গড়ে তুলেছে টে¤পু বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্য রয়েছে নগরজুড়ে। হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ অন্তত ৩০টি মামলার আসামি। বর্তমানে টে¤পু ইসমাইল কারাগারে থাকলেও একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে তার বাহিনীর সদস্যরা।
বিদেশে বসে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে ফজল হক
রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফজল হক। ২০০০ সালে রাউজানসহ চট্টগ্রামের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত ছিল ফজল হক বাহিনী। এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেওয়াসহ টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যা ছিল এ বাহিনীর অন্যতম কাজ। রাউজানের আওয়ামী লীগ নেতাকে ইকবাল ও জামিলকে প্রকাশ্যে খুন করার পর সে এলাকা ছাড়ে। বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফজল হক বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এলাকায় তার ভাই জানে আলমসহ বাহিনীর একাধিক সদস্য তার নির্দেশে অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
৫০ সদস্যের বাহিনী রয়েছে বিধান বড়ুয়ার
রাউজান থানাধীন পূর্ব গুজরা আঁধারমানিক বড়ুয়া পাড়া গ্রামের মৃত হিমাংশু বড়ুয়ার তিন ছেলের মধ্যে ছোট বিধান বড়ুয়া। ১৯৯৩ সালে রাউজান উপজেলার পূর্বগুজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকতার হোসেন রাজুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে আলোচনায় আসে বিধান। এরপর তার হাতে রাউজানসহ চট্টগ্রামের অসংখ্য ব্যক্তি খুন হন। তার রয়েছে ৫০ সদস্যের একটি বাহিনী। গত বছরের ৫ আগস্টের পর রাউজান উপজেলায় একের পর এক হত্যাসহ রাজনৈতিক সংঘর্ষের মূলে তার বাহিনীর স¤পৃক্ততা পেয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মেজর ইকবাল বাহিনীর তৎপরতা
রাউজান উপজেলার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইকবাল হোসেন ওরফে মেজর ইকবাল। আগে আওয়ামী লীগের রাউজান আসনের সাবেক সংসদ এবিএম ফজমে করিম চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে কাজ করতো। এমন কোনও অপরাধ নেই যা ফজলে করিমের হয়ে করেনি। বর্তমানে রাউজান বিএনপির এক নেতার হয়ে তার অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ওই বিএনপি নেতার নাম জানায়নি পুলিশ।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ও রাউজান কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) মজিবুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ১৯৮৯ সালে। এসব খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে মেজর ইকবাল। ১৯৯৩ সালে পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকতার হোসেন রাজুকে ব্রাশফায়ারে হত্যার প্রধান আসামি করা হয় মেজর ইকবালকে।
রাউজানে দুই ভাই টিটু ও মিঠুকে একসঙ্গে হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা নিহার কান্তি বিশ্বাসকে হত্যা, ইকবাল ও জামিল নামে দুই আওয়ামী লীগের কর্মীকে হত্যাসহ ১৫ মামলার আসামি ইকবাল। এসব মামলায় জেলও খেটেছে বেশ কয়েক বছর। বর্তমানে তার অনুসারীদের দিয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
মুখোশ পরা সন্ত্রাসী ইমু
রাউজান উপজেলার হরিষখান এলাকার মৃত বজল আহাম্মদের ছেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী আজিজ উদ্দিন ইমু। তার নেতৃত্বে রয়েছে সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের দিয়ে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ১৪টি মামলার আসামি। আগে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় অপরাধ কর্মকান্ড করে বেড়ালেও বর্তমানে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে।
২০১৫ সালে রাউজান রাঙামাটি সড়কের চারাবটতল এলাকায় যুবলীগ কর্মী শহিদুল আলমকে মুখোশ পরে সিনেমা স্টাইলে মাইক্রোবাস থেকে নেমে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলায় ১ নম্বর আসামি ইমু। এরপর থেকে মুখোশ পরা সন্ত্রাসী ইমু নামে পরিচিত।
অসহায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
সন্ত্রাসীরা একের পর এক খুনোখুনি করলেও নিরব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজনৈতিক মদদ থাকায় সন্ত্রাসীদের কাছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অসহায় হয়ে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে এ কথা মানতে নারাজ চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু।
তিনি বলেন, এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। রবিবার রাতেও রাউজান নোয়াপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ দু‘জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা রাউজানের বিএনপি কর্মী আব্দুল হাকিম হত্যা মামলার আসামি। বাকি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
র্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল হাফিজুর রহমান বলেন, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ওসব সন্ত্রাসীর ডাটা-তালিকা সবই আমাদের কাছে আছে। কিছু কিছু সন্ত্রাসী অপরাধ করে পাহাড়ি এলাকায় চলে যাচ্ছে। এ কারণে তাদের গ্রেপ্তারে সময় লাগছে।









































