শনিবার- ১৫ নভেম্বর, ২০২৫

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল

বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ে প্রধান প্রকৌশলী শফিকুরের ‘ভুতুড়ে ফাঁদ’

বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ে প্রধান প্রকৌশলী শফিকুরের ‘ভুতুড়ে ফাঁদ’

# দ্বিগুণ দামে কিনছে নিম্নমানের ইলেকক্ট্রিক সামগ্রী
# অঢেল সম্পদের মালিক শফিকুর
# রেলযাত্রীসহ সর্বত্রই সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তি

বৃটিশ আমলে নির্মিত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিআরবি ভবন। যেখানে লাগানো সে সময়ের অনেকগুলো ফ্যান নির্বিঘ্নে চলছে এখনো। জ্বলছে লাইটও। সচল রয়েছে অনেক সুইচ, প্লাগ, ক্যাবলসহ নানা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও। অথচ সপ্তাহও টিকে না বর্তমানে কেনা সুইচ, প্লাগ, লাইট, ফ্যান ক্যাবলসহ কোন কিছুই।

যা রেলের বগিসহ সম্প্রসারিত ভবন ও স্টেশনগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সুবাধে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনাকাটা চলছে বিদ্যুৎ গতিতেই। অনিয়ম থেমে নেই। সমগতিতে চলছে নানারকম কারসাজি ও দূর্নীতি।

এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরঞ্জাম না কিনে ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ার্সদের সহযোগীতায় সরঞ্জাম ক্রয়ের ভাউচার জমা দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় সরঞ্জাম ক্রয়ে বরাদ্দকৃত টাকা। আর যদি সরঞ্জাম কিনতেই হয় সেক্ষেত্রে হয় নিজের পকেটে নামে-বেনামে থাকা ঠিকাদারি লাইসেন্স, নতুবা মিনিমাম ১০% কমিশন আদায়ে কাজ দেয়া হয় পছন্দের ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ার্সকে।

এক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা হয় যে, সুনির্দিষ্ট বৈদ্যুতকি সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি থেকে মালামাল কিনতে হবে। ফলে বাজারের চেয়ে অনেক বেশি দামে এসব মালামাল কিনতে হয়। যা খুবই নিম্নমানের। আর ঐ কোম্পানি থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় করেন প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান।

এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ার্সরা। যারা এ বিষয়ে দূর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান। তারা জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ে পাঁচ হাজার টাকার ইলেক্ট্রিক বাতি ২৭ হাজার টাকায় কেনার রেকর্ডও করেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যা দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। এরপর অনিয়ম ও দূর্নীতির এমন কারসাজি চলছেই।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে মোড়ে মোড়ে বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান

দুদকের বরাত দিয়ে ঠিকাদাররা জানান, বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী একটি কেনাকাটায় একই ঠিকানায় নিবন্ধিত দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একই টেন্ডারে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া পণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারণ কমিটি কিসের উপর ভিত্তি করে এসব পণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারণ করেছে তা নিয়ে কোনো ডকুমেন্টস পাওয়া যায়নি।

পাশাপাশি পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বৈদ্যুতিক প্রকোশলীর কার্যালয় ৯০টি এলইডি লাইট এবং এলইডি ল্যা¤প কিনেছে। প্রত্যেকটি লাইট ২৭ হাজার ৭০০ টাকা করে কেনা হলেও ডকুমেন্টস পর্যালোচনায় করে এসব লাইট ক্রয়ে অসংগতিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

এভাবে চলছে অনিয়ম ও কারসাজির কেনাকাটা। প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী শফিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে সহকারি প্রকৌশলী ও বিভাগীয় প্রকৌশলীর সহযোগীতায় বাজার কমিটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ে লুটপাট চলছে। যাকে ভুতুড়ে ফাঁদ হিসেবে দেখছেন ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ার্সরা।

সূত্রমতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রতি অর্থবছরে কোটি কোটি টাকার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ের বরাদ্দ দেয় সরকার। যার প্রতিটি ক্রয় থেকে ১০% কমিশন পকেটে পুড়ে প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান। এছাড়া ইজিপির বদলে এলটিএম করে ঠিকাদারের পরিবর্তে সাপ্লাইয়ার্সদের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ের আদেশ দেওয়া হয়। যেগুলো শুধুমাত্র ক্রয় ভাউচার জমা দিয়ে বিল তুলে পকেটে পুড়েন প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান। এক্ষেত্রে সাপ্লাইয়ার্সরা লাভের অংশ পায় ১০% হারে।

এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি থেকে মালামাল কেনার শর্ত দেওয়া হয়। ফলে বাজারের চেয়ে অনেক বেশি দামে এসব মালামাল কিনতে হয় সাপ্লাইয়ার্সদের। আবার এসব মালামাল হয় খুবই নিম্নমানের। আর ঐ কোম্পানি থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় করেন প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান। এ অবস্থায় সাপ্লাইয়ার্সরা মালামাল না কিনে ভাউচার জমা দিয়ে বিল তুলে নিতে আগ্রহী হয়ে উঠে।

আরও পড়ুন :  খুনোখুনিতে অস্থির চট্টগ্রাম

এই কারসাজির কারণে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কাগজে কলমে লেখা থাকলেও বাস্তবে গুদামে নেই। যা নিরপেক্ষ কোন তদন্ত কমিটি দিয়ে তদন্ত করলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে ক্রয় করা নিম্নমানের এসব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হলেও তা বেশিদিন টিকে না। বিশেষ করে লাইট, সুইচ, প্লাগ এমনকি ক্যাবল পর্যন্ত পুড়ে দূর্ঘটনা ঘটে। এমনকি লাগানো নতুন ফ্যান পর্যন্ত গড়গড় শব্দ করে অচল হয়ে পড়ে।

এতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সম্প্রসারিত ভবন, রেলের বগি, স্টেশন এমনকি চলাচলের রাস্তায় লাগানো এলইডি বাতি থেকে সব ধরণের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কয়েকদিন পর পর খারাপ হয়ে অচল বা বন্ধ হয়ে যায়। এতে প্রথমত রাতের বেলায় চলাচলের রাস্তা অন্ধকার গলিতে পরিণত হয়। অফিসগুলো পরিণত হয় ভুতুড়ে পরিবেশে। অফিস ও রেলের বগিতে গরমে ঘামতে হয় বসে বসে।

এভাবে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও রেলের যাত্রীরা দুর্ভোগ পোহালেও কমিশন আর কারসাজির টাকায় আরাম আয়েশে রয়েছে প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান। দূর্নীতির টাকায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে তার। ইতোমধ্যে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এ বিষয়ে জানতে প্রধান বেদ্যুতিক প্রকৌশলী শফিকুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলতে গত তিন সপ্তাহে ১১ দিন অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর একজন অফিস সহকারি বলেন, স্যার সব সময় অফিসে আসেন না। সপ্তাহে একদিন বা দু‘দিন আসেন। যেদিন আসেন সেদিন পুরো সপ্তাহের ফাইলে স্বাক্ষর দিয়ে চলে যান। তিনি সবসময় ঢাকায় অবস্থান করেন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে এবি ব্যাংকের কর্মকর্তা অনামিকা কারাগারে

একপর্যায়ে গত সোমবার অফিসে গেলে সাক্ষাৎ মিলে প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর সঙ্গে। অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এখানে কোন অনিয়ম-দূর্নীতি নেই। রেলের মধ্যে আমার দপ্তর হচ্ছে সবচেয়ে গরিব দপ্তর। এখানে অন্যান্য দপ্তরের মতো তেমন কেনাকাটা বা কাজ নেই। নামে-বেনামে আমার কোন ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই। যে দুটি কেনাকাটার কথা বলেছেন, তা একটি বিভাগীয় প্রধান সরঞ্জাম ক্রয় দপ্তরের। আরেকটি প্রকৌশল দপ্তরের।

তিনি বলেন, গত অর্থবছরে আমার অফিসের কয়েকটি আসবাবপত্র ছাড়া কোন কেনাকাটা হয়নি। এখানে বছরে সর্বোচ্চ ৫-৭ লাখ টাকার কেনাকাটা হয়। আমার অন্য চার দপ্তরে যেসব কেনাকাটা হয় সেগুলোতে আমার কোন হাত নেই। রেলওয়ের দপ্তরে আমার মতো সৎ অফিসার একজনও খুঁজে পাবেন না।

এ সময় দপ্তরে উপস্থিত থাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের কাছে গত অর্থবছরে কেনাকাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার দপ্তরেও বরাদ্দ কম। মাত্র ৫ কোটি টাকার মতো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনাকাটা হয়েছে। বরাদ্দকৃত আরও ৫ কোটি টাকার ফেরত গেছে। এই কেনাকাটা প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে হলেও তিনি তার দায় বিভাগীয় প্রকৌশলীর কাঁধে তুলে দেন।

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সুবক্তগীনের মুঠোফোনে একাধিক কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ সংক্রান্ত বক্তব্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

ঈশান/খম/মসু

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page