
গ্যাস-সংকটের কারণে ২০০৯ সাল থেকে আবাসিকে নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রেখেছে সরকার। কিন্তু মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে বিতরণ সংস্থা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সংঘবদ্ধ একটি চক্র। যেখানে জড়িত সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও দালালচক্র।
সম্প্রতি চট্টগ্রামজুড়ে এমন ২ হাজার ৫০০ সংযোগের তথ্য পেয়েছে কেজিডিসিএল। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের তিন কর্মকর্তাকে এরই মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
শনিবার (৮ জুলাই) বিষয়টি স্বীকার করেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. নাহিদ আলম। তিনি বলেন, অবৈধ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করতে ১১ জুন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কাজ এখন চলমান। প্রতিবেদন জমা দিতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক মো. মোজাহার আলী বলেন, গ্যাস-সংযোগে নয়ছয়ের অভিযোগ আসার পর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, গ্যাস বিতরণ সংস্থাটিতে রাজস্ব ও আইটি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এটির সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা ও ঠিকাদার। এই চক্র ১ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকার বিনিময়ে নতুন সংযোগ দেয়। এছাড়া ঘুষ দিলে পুরোনো গ্রাহকের অনুমোদিত চুলার সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি এমন একটি অভিযোগ আসার পর কেজিডিসিএলের আইটি বিভাগ তদন্ত করে দেখেছে, প্রায় ২ হাজার ৫০০ অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দিয়েছে চক্রটি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তিন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তিন কর্মকর্তা হলেন কেজিডিসিএলের উত্তর বিভাগের (রাজস্ব) জোন ৩ ও ৯ শাখার ব্যবস্থাপক রোকেয়া ফেরদৌসী, একই বিভাগের উপব্যবস্থাপক শাহাদাত ওসমান খান ও আইটি বিভাগের উপব্যবস্থাপক আব্দুল মবিন। এই তিনজনের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এই অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। এ কারণে ১১ জুন তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কেজিডিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. নাহিদ আলমকে এই কমিটির আহ্বায়ক এবং ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাহমুদুল ইসলাম ও সুলতান আহম্মেদকে সদস্য করা হয়।
তদন্ত কমিটির তথ্যমতে, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া ওই ৩ জন অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত ছিলেন। ৮ জুন কেজিডিসিএলের একটি টিম অনলাইন ডেটাবেইস ও নেটওয়ার্ক সিস্টেম পর্যবেক্ষণ করে এই তিনজনের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে গ্রাহককে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে তথ্য সংযোজন-বিয়োজন, নাম-ঠিকানা পরিবর্তন, গ্যাস বিল ডিলিট, চুলার সংখ্যা বৃদ্ধি ও ইভেন্ট বিল তৈরি করত।
তথ্যে বলা হয়, চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকার বাসিন্দা হাজি আমীর ছাফা নামের এক গ্রাহকের ৪টি চুলার অনুমোদন ছিল। গত ৩০ মে মালিকানার পরিবর্তন দেখিয়ে ওই গ্রাহকের সংযোগ স্থানান্তর করা হয় ফয়জুন্নেসা চৌধুরীর নামে। তবে এবার চুলার সংখ্যা ৪টির স্থলে হয়ে গেছে ২৭টি। অভিনব এই জালিয়াতির তথ্য প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয় কেজিডিসিএলে। তখন তড়িঘড়ি করে ৭ জুন খাতা-কলমে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে যে দুটি ঠিকানায় এসব সংযোগ দেখানো হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ ভুয়া ঠিকানায় সংযোগগুলো এখনো চলছে।
জানা যায়, কোনো গ্রাহকের মালিকানা পরিবর্তন করতে হলে মার্কেটিং, রাজস্ব ও আইটি বিভাগের সমন্বয়ে বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু বায়েজিদের এ ঘটনার পর ইআরপি সফটওয়্যার ঘাঁটাঘাঁটি করে এমন আড়াই হাজার সংযোগের অস্তিত্ব মিলেছে। যেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, রাজস্ব বিভাগের উঁচু স্তরের তিনজনের নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট এই অবৈধ সংযোগের মূল হোতা।