শনিবার- ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

জড়িত চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন

পাহাড় কেটে চসিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তার হাসপাতাল!

অনুমোদন নেই চউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের

পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরীর বেলভিউ হাসপাতাল ভবন। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের যোগসাজশে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে শেভরণ বিশেষায়িত হাসপাতালের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে ১২ তলা বিশিষ্ট এই হাসপাতাল ভবন।

অথচ এই হাসপাতাল ভবন নির্মাণে অনুমোদন নেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে ঘেড়া-বেড়ার আড়ালে এই হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হলেও নিরব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ সব সংস্থা।

ভবন নির্মাণের পর সম্প্রতি ঘেড়া-বেড়া খুলে নেয়া হলে স্থানীয়দের নজরে আসে পাহাড় কাটার বিষয়টি। স্থানীয়রা জানান, প্রবর্তক মোড়ে সড়কের সামনে থেকে পাহাড় কাটার বিষয়টি নজরে আসার সুযোগ নেই। বিশাল ভবন আর চারপাশের দেয়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে পাহাড় কাটার বিষয়টি। ভবনের পেছনে গেলেই প্রত্যক্ষ করা যায় পাহাড় কাটার দৃশ্য।

সম্প্রতি সরেজিমন ঘুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, কোথায় আমরা পাহাড় কেটেছি, বরং সামনে থেকে তোলা মাটি পেছনে ফেলায় পাহাড়ের মতো লাগছে। তাছাড়া পাহাড় কাটার বিষয়টি আপনাদের কে বলেছে?

তিনি বলেন, দেখুন আমি একজন সাংবাদিক বান্ধব মানুষ। চট্টগ্রামের বড় বড় সব সাংবাদিকের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদেরও টিভি আছে। কই তারা তো কেউ পাহাড় কাটার কথা বলেনি। তারা কেউ নিউজও করেনি। আপনি কেন করবেন। আমরা জনগণের সেবার জন্য হাসপাতাল করেছি। এখানে ৩০০-৪০০ ডাক্তারের কর্মসংস্থান হবে। এটা কি আমরা খারাপ কাজ করেছি। আপনি যান, আমরা হাসপাতাল চালুর সময় আপনাকে ডাকব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এই বেলভিউ হাসপাতালের এমডির দায়িত্বে আছি। সিটি কর্পোরেশনের চাকরির সাথে হাসপাতালের দায়িত্বে থাকার ক্ষেত্রে চাকরির বিধিমালায় সাংঘর্ষিক কোন কিছু নেই।

হাসপাতাল ভবন নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চউক, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সব কিছুর অনুমোদন আছে। তবে এ বিষয়ে এখন কিছুই বলা যাবে না।

এছাড়া হাসপাতালের নির্মাণ ব্যয়, অর্থের উৎস ও কি পরিমাণ জমির উপর এই হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে জানতে চাইলে ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, এসব কোন বিষয়ে এই মুহুর্তে বলা যাবে না। হাসপাতাল উদ্বোধনের সময় আমরা একটি সাংবাদিক সম্মেলন করব। সেখানে সব সাংবাদিককে ডাকব। সেখানে সব জানাব।

এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আপনি কি নিউজ করবেন? নিউজ করলে টিভি-ক্যামেরা আমাদেরও আছে। আমরাও ক্যামেরা নিয়ে আপনাদের কাছে যাব। এভাবে হুমকি দেন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম চৌধুরী।

স্থানীয়রা জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রবর্তক মোড়ে শেভরণ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পাশে প্রায় ৮০ শতক জমির উপর এই বেলভিউ হাসপাতাল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। যার পেছনের অর্ধেকাংশই উচু পাহাড়ি জমি। এই পাহাড় কেটেই নির্মাণ করা হয়েছে ১২ তলা বিশ্ষ্টি বহুতল হাসপাতাল ভবন।

এছাড়া হাসপাতালের সামনের অংশ সড়কের পাশে জায়গা দখল করে দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল ভবনের বাউন্ডারি দেয়াল। যার ফলে সড়কে যানবাহন চলাচলে নিত্যজট লেগেই থাকে। এমনকি সাধারণ পথচারিকে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন তলায় এখনো নির্মাণ কাজ চলছে। ভবনের পেছনে পাহাড় কাটাও দৃশ্যমান। যার স্থির ও ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয়রা আরও জানান, যে জমির উপর এই হাসপাতাল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে তাও নিকটস্থ সেবা সংগঠন প্রবর্তক সংঘের। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন ওই জমি তারা এই সংগঠনের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন।

কিন্তু প্রবর্তক সংঘের দায়িত্ব শীল প্রশাসনিক কর্মকর্তা পার্থ সারথি রক্ষিত বলেছেন, এই জমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মাসিক ভাড়া চুক্তিতে লীজ দেওয়া হয়েছে। প্রবর্তক মোড়ের বিপুল পরিমাণ পাহাড়ি জমি প্রবর্তক সংঘের অনুকুলে লীজ নেওয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে সরকারি জমি লীজ প্রাপ্ত সংগঠন ওই জমি অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে লীজ প্রদান বা বিক্রয়ের নামে হস্তান্তরের কোন নিয়ম নেই। সেক্ষেত্রে লীজ বা ক্রয়-বিক্রয় কোনটাই বৈধ নয়। এই অবস্থায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে সরকারি পাহাড়ি জমির উপর হাসপাতাল ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবর্তক সংঘের সাথে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির অভিযোগ, চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বর্তমান সরকারের একজন উপমন্ত্রীর নিকট আত্নীয় পরিচয়ে প্রভাব কাটিয়ে প্রবর্তক সংঘ থেকে এই জমি জোর পূর্বক দখল করে এই হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করেছেন।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের জামাল খানে অবস্থিত ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান এয়ার বেল এই হাসপাতাল ভবন নির্মাণ বাস্তবায়ন করেছেন। এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাইয়ুম চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। জামালখান এলাকায় পেসিফিক টাওয়ারে প্রতিষ্ঠানটির কর্পোরেট অফিসে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সেখানে কর্মরত নারী কর্মচারীরা বাধা সৃষ্টি করে। এমনকি অশালীন আচরণও করা হয়।

এদিকে হাসপাতাল ভবন নির্মাণে অনুমোদন থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন সামশ বলেন, হাসপাতাল ভবন নির্মানে চউক থেকে কোন অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অনুমোদন ছাড়াই তারা কীভাবে হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করেছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে হাসপাতাল ভবন নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরেরও কোন ছাড়পত্র নেই বলে জানান অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস। তিনি বলেন, হাসপাতাল ভবন নির্মাণে চউকের অনুমোদন না থাকলে, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া পাহাড় কেটে হাসপাতাল ভবন নির্মাণের বিষয়ট আমাদের জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে হাসপাতাল ভবন নির্মাণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন মিলেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এক কর্মকর্তা। আর বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে ফোন করা হলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, এসব বিষয় নিয়ে তো আর আমি ঘুরি না। যেখানে এসব বিষয়ে ফাইল সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে গিয়ে জেনে নেন-এ কথা বলেই তিনি সংযোগ কেটে দেন।

(বি:দ্র: বেলভিউ হাসপাতাল ও চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির আরো সংবাদ আসছে আগামি পর্বে। চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে)

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page