
চট্টগ্রাম মহানগরের ৪০ শতাংশ এলাকায় ওয়াসার পানির জন্য হাহাকার রয়েছে। কোথাও সংযোগ থাকলেও পানি নেই। আর কোথাও সংযোগই নেই। অথচ প্রতিদিন গড়ে ৯ কোটি লিটার পানি হাওয়া। যা সিস্টেম লস দেখিয়ে হিসাবভুক্ত করছে চট্টগ্রামে পানি ও পয়োব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার গত জুন মাসের এমআইএস রিপোর্ট অনুযায়ী, সরবরাহ করা মোট পানির ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ সিস্টেম লস হয়। সিস্টেস লস হওয়া পানিকে নন–রেভিনিউ ওয়াটার হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে ওয়াসা। এ হিসাবে দৈনিক নন–রেভিনিউ পানির পরিমাণ কমবেশি ৯ কোটি লিটার।
ওয়াসার হিসাবেই, বর্তমানে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদিত পানির মধ্যে পাইপে ফুটোর কারণে প্রতিদিন নষ্ট হয় আড়াই কোটি লিটার। বাকি সাড়ে ৬ কোটি লিটার পানি চুরি, অবৈধ সংযোগ, মিটারে কারসাজির মাধ্যমে নষ্ট হয় বলে দাবি করেছেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা।
আর এসব পানির বিলও পাচ্ছে না সংস্থাটি। ওয়াসা দাবি, এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে সংস্থার খরচ হয় ২৭ টাকা। পানি পরিশোধনে ব্যবহৃত রাসায়নিক, বিদ্যুৎ খরচ, জনবলের বেতন-ভাতা অন্তর্ভুক্ত করে এ উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে সংস্থাটি হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
এদিকে চট্টগ্রামের তুলনায় দেশে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ কম। ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ২০ শতাংশ, রাজশাহী ওয়াসায় ২৯ শতাংশ ও খুলনা ওয়াসায় ২৪ শতাংশ। সিস্টেম লস না কমিয়ে গত পাঁচ বছরে চারবার পানির দাম বাড়িয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সর্বশেষ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। বর্তমানে আবাসিকে এক হাজার লিটার পানির দাম ১৮ টাকা, বাণিজ্যিকে ৩৭ টাকা।
গ্রাহকদের অভিযোগ, সিস্টেস লস দেখানো কোটি কোটি লিটার পানি বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যাদের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে রয়েছে অন্তত ৩০০টি চোরাই পাম্প হাউজ। যেগুলো বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ নেই ওয়াসার। আবার ফুটো সারাতে বছরে গড়ে খরচ দেখানো হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি। যা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে ঢুকছে।
ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপলাইনের ফুটো কোনদিন সারবে না। ফুটোর নামে কিছু পানি বিক্রি করছে তারা। ফুটো মেরামতের নামেও বাড়তি বিল করা যায়। এতে কোটি কোটি টাকা কর্তাব্যক্তিদের পকেটে চলে যাচ্ছে।
ফুটোর কারণে পানির অপচয় ও পাম্প হাউজের মাধ্যমে চুরি রোধ করা গেলে নগরের বড় একটি অংশে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যেত বলে মনে করছেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা। বিশেষ করে নগরীর বাকলিয়া, হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, পাহাড়তলী, বাঘগোনা, আকবর শাহসহ বিভিন্ন এলাকায় বছরজুড়ে পানির সংকট থাকে। এসব এলাকার গ্রাহকেরা কখনো কখনো সপ্তাহে এক দিনও পানি পান না।
পাহাড়তলীর ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা কে এম মোস্তফিজুল কবির বলেন, ১ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দু‘বার পানি পেয়েছি। প্রতি মাসেই তাঁর এই পানির কষ্ট। অথচ পাইপে ফুটোর কারণে কোটি কোটি লিটার পানি নালায় চলে যাচ্ছে।
সংযোগ পাইপে ফুটো যাতে না হয়, তার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ। তিনি বলেন, নানা কারণে ফুটো হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে কমে এসেছে। এ ছাড়া নতুন পাইপলাইন বসানো হয়েছে। নতুন লাইনে ফুটো কম হচ্ছে।
তবে নতুন পাইপেও ফুটো হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মড-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইফতেখার উল্লাহ। তিনি বলেন, সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। এতে পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফুটো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ফুটোর কারণে নষ্ট পানির জন্য কোটি টাকা গচ্চার পাশাপাশি মেরামত করতেও গুনতে হচ্ছে কোটি টাকা। ফুটো মেরামতে গত পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে মড-৩-এ পাঁচ বছরে মাত্র দেড় হাজার ফুটো মেরামতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
ওয়াসার দুজন বোর্ড সদস্য অভিযোগ করেন, মাত্র দেড় হাজার ফুটো মেরামতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। আদতে এসব ফুটো মেরামতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম ওয়াসা বর্তমানে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে নগরজুড়ে পানি সরবরাহ করে। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৮৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন নতুন করে বসানো হয়েছে। বাকি লাইন এখনো পুরোনো। তবে নতুন ও পুরোনো দুই পাইপলাইনেই ফুটো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংস্থার নথি অনুযায়ী, ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরের ৬৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানি সরবরাহ করত। এরপর থেকে নতুন নতুন প্রকল্পে বেড়েছে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য। ২০০৯ সালে শুরু হয় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬৮ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হয়। এরপর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ। বসানো হয় ১৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন।
২০১৩ সালে শুরু হয় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)। কাজ শেষ হয় গত বছর। এই প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ৬৮৭ দশমিক ৫২ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হয়েছে। গত পাঁচ বছরে এসব পাইপে ১০ হাজার ৪৬৮টি ফুটো হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
ফুটোর মাধ্যমে পানির অপচয় রোধে ওয়াসার পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রায় এক হাজার কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। এতে গ্রাহক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ পরিমাণ পানি বাঁচানো গেলে পানির দাম বাড়াতে হয় না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সেদিকে নজর নেই। উল্টো সিস্টেম লসের নামে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরোনো। ফলে সার্বিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করা না গেলে অপচয় কমবে না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. মাকসুদ আলম বলেন, নগরীর চান্দগাঁও ও আগ্রাবাদ এলাকায় ৩ হাজার স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ চলছে। নগরীতে এখনো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পুরোনো পাইপলাইন রয়েছে। নতুন পাইপলাইন বসানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকার এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নতুন পাইপলাইন এবং স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ শেষ হলে সিস্টেম লস একেবারেই সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্র জানায়, পানি পরিশোধনের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার রয়েছে তিনটি শোধনাগার। এই তিন প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করা হয়। এরমধ্যে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প–১ থেকে ১৪ কোটি লিটার, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প–২ থেকে ২৪ কোটি লিটার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে ৭ কোটি লিটার পানি সরবরাহ হয়। পাশাপাশি গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে ওয়াসা গভীর নলকূপ থেকেও দৈনিক ৫ থেকে ৬ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তবে পানির চাহিদা কম হলে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হয় না।