ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঁছড় পড়েনি চট্টগ্রামে। যদি চট্টগ্রামেও ছিল ১০ নং মহাবিপদ সংকেত। তবে ঘুর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে রবিবার দিনগত ভোর রাত থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। সেই সাথে সাগরের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের দুই তুতীয়াংশ এলাকা।
জোয়ারের সাথে বৃষ্টি কমে গেলে দুপুরের দিকে পানিও নেমে যায় ডুবে যাওয়া এলাকা থেকে। কিন্তু বিকেলের দিকে শুরু হওয়া বৃষ্টি ও সাগরে জোয়ারের পানিতে ফের থৈ থৈ করছে চট্টগ্রামের নিচু এলাকা। যেখানে জলজটের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরীর কর্মজীবি মানুষদের।
ভুক্তভোগী মানুষ জানান, সোমবার সাতসকালেই চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, জিইসি, চকবাজার, বাকলিয়া, নতুন ব্রিজ, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিং, চৌমুহনী, ইপিজেড, সল্টগোলা, বন্দর, নিমতলা, হালিশহর ও পাঁচলাইশের বিভিন্ন এলাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। সকালে এসব এলাকার হাজার হাজার কর্মজীবী মানুষকে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
দুপুরের দিকে পানি একটু কমলেও বিকেলের বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ফের ডুবে যায় নগরীর দুই তৃতীয়াংশ এলাকার সড়ক ও অলিগলি। আর এ সময় পানি মাড়িয়ে প্রধান দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অফিস গামীদের। কারণ ডুবে যাওয়া সড়কে ক্ষণে ক্ষণে রিকশা-সিএনজি চালিত অটোরিকশার দেখা মিললেও গণপরিবহন সংকটে ভোগান্তিতে পড়তে হয় বেশিরভাগ কর্মজীবীকে।
ভুক্তভোগী মানুষের ভাষ্য মতে, নগরীর দুই তৃতীয়াংশ এলাকার অলিগলি হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে গেছে। নগরীর মোহাম্মাদপুর ফ্লাইওভারে মুখ থেকে বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার পর্যন্ত কোমড় পানিতে থৈ থৈ করছে। একই সড়কে থাকা বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ইঞ্জিনচালিত গাড়ি পানিতে বিকল হয়ে পড়েছে। এসময় পথচারীরা কোন উপায় না পেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে সড়কে ডিভাইডার ধরে গন্তব্যে ফিরতে দেখা যায়। অনেকে আবার দু-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া দিয়ে রিকশা ও ভ্যানে চড়ে গন্তব্যে রওনা দেয়।
চকবাজার সৈয়দশাহ রোড এলাকার বাসিন্দা পোশাকশ্রমিক নুরজাহান বলেন, হাঁটুপানি পার হয়ে রাহাত্তারপুল এসে ১ ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়েছিলাম। গাড়ি পাচ্ছিলাম না। কয়েকটা ৪ নম্বর বাস আসলেও মহিলা সিট নেই বলে তুলেনি। পরে গাড়ি না পেয়ে আবার বাসায় ফেরত এসেছি।
জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে পড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আগ্রাবাদ হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আমিনু রশিদ বলেন, ওষুধ আর কাঁচা বাজার আনতে বের হয়ে দেখি পানি একহাঁটু। এসব ময়লা পানি মাড়িয়ে অনেক কষ্ট করে দোকানে গেলাম। গিয়ে দেখি দোকান বন্ধ। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে কী লাভ! যে লেভেলের পানি উঠেছে তাতে দোকান খোলার কোনো উপায় নাই। দোকান খুললে উল্টো ক্ষতির মুখে পড়বে। বৃষ্টি হলে পানি উঠবে তাতে সমস্যা না। কিন্তু বৃষ্টির পানি দ্রুত নামে না কেন, দায়ী কে?
আগ্রাবাদ চৌমুহনীর চারিয়াপাড়া এলাকার কিবরিয়ার বাড়ির বাসিন্দা মমতা বেগম বলেন, তিনমাস হইলো এই বাসায় উঠছি। এরকম পানি উঠবে জানলে কখনো বাসা ভাড়া নিতাম না। ঘরের জিনিসপত্রগুলো ভিজে একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। ভয় লাগছে আবার এই পানিতে সাপ পোকামাকড় থাকে কিনা। আর এই বাসায় থাকা যাবে না। একটু ভালো থাকার জন্য কম টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে এখন দুঃখ কারে কয়, কত প্রকার কি কি সব হাড়ে হাড় টের পাচ্ছি।’
একই এলাকার কমার্স কলেজ এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী কামরুন নাহার বলেন, ‘হজ্ব করার উদ্দেশ্যে কালকে মেয়ের জামাই চলে যাবে। মেয়ের বাসা সল্টগোলা ক্রসিং। এজন্য কিছু পিঠা বানিয়ে নিয়েছি মেয়ের বাসায় যাবো বলে। সকাল থেকে যে বৃষ্টি লাগছে থামাথামির নাম নাই! পরে বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে তো চোখ কপালে উঠে গেছে। কোমরপানি। কোন দিক দিয়ে রিকশা কিছু নাই। এই ময়লা পানি ভাইঙ্গা যে কষ্ট করে মেইন রোডে আসছি। এতো কষ্ট কেন আমাদের পোহাতে হচ্ছে সেটাই বুঝতেছি না।’
জলাবদ্ধতায় নগরবাসীর দুর্ভোগের বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমী বলেন, শহর বিধ্বস্ত বলার কিছু নাই। সব ওয়ার্ডে আমাদের টিম কাজ করছে। আমি নিজেও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা মুরাদপুরে থাকি। এ জলাবদ্ধতায় প্রায় সারাদিন আটকে ছিলাম, একটু আগে অফিসে আসছি। জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা কিছু কিছু জায়গায় বাঁধ ভেঙে দিয়েছি, কিছু জায়গায় এস্কেভেটর দিয়ে কাজ চলছে।
তবে আশার কথা হচ্ছে- খুব ¯িপডে পানি নামছে। জোয়ার ছিল বলে জলাবদ্ধতা বেশি হয়েছিল। এখন ভাটা, তাই পানি দ্রুত নামছে।’ এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একদিনের জন্য (২৭ মে) চট্টগ্রামের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্কুল শিক্ষার্থীদের তেমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া পূর্বাভাস কর্মকর্তা এমএইচএম মোসাদ্দেক বলেন, ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘন্টায় (গতকাল দুপুর ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত) ২৩৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী দুইদিন টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা নেই।অতি ভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও পাহাড়ধস হতে পারে।