বৃহস্পতিবার- ১০ই অক্টোবর, ২০২৪

সীতাকুণ্ডের কোটিপতি ৯ ইউপি চেয়ারম্যান লাপাত্তা!

সীতাকুণ্ডের কোটিপতি ৯ ইউপি চেয়ারম্যান লাপাত্তা!
উপরে বাম থেকে মোরশেদ হোসেন চৌধুরী, শেখ রেজাউল করিম, ছাদাকাত উল্লাহ্ মিয়াজী ও শওকত আলী জাগাঙ্গীর। নিচে বাম থেকে মনির আহমেদ, সালাউদ্দীন আজিজ, নাজিম উদ্দীন, তাজুল ইসলাম নিজামী ও রেহান উদ্দীন রেহান।
print news

ওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকে লাপাত্তা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কোটিপতি ৯ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। ক্ষমতার জোরে বৈধ বা অবৈধভাবে কেউ বনে যান ঠিকাদার, কেউ রিয়েল এস্টেট (জমি), কেউ শিপইয়ার্ডের স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী। শূন্য থেকে বনে যান কোটিপতি। এদের মধ্যে আটজন চলাফেরায় ব্যবহার করতেন মন্ত্রী-এমপিদের মতো দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি। যা বছর বছর পাল্টেও যেত। তারা লাপাত্তা হওয়ায় এখন কোনোরকম নাগরিক সেবা পাচ্ছেন না সেবাপ্রার্থীরা।

তারা হলেন, ১ নম্বর সৈয়দপুর ইউপির চেয়ারম্যান এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী (৪ বার চেয়ারম্যান), ২ নম্বর বারৈয়াঢালা ইউপির রেহান উদ্দীন রেহান (৪ বার), ৪ নম্বর মুরাদপুর ইউপির রেজাউল করিম বাহার (২ বার), ৫ নম্বর বাড়বকুণ্ড ইউপির ছাদাকাত উল্লাহ্ মিয়াজি (৪ বার), ৬ নম্বর বাঁশবাড়িয়া ইউপির শওকত আলী জাহাঙ্গীর (৪ বার), ৭ নম্বর কুমিরা মোরশেদ চৌধুরী (৩ বার), ৮ নম্বর সোনাইছড়ি ইউপির মনির আহমেদ (৩ বার), ৯ নম্বর ভাটিয়ারী ইউপির নাজিম উদ্দীন (৪ বার) এবং ১০ নম্বর সলিমপুর ইউপির চেয়ারম্যান সালাউদ্দীন আজিজ (৪ বার)।

এসব তথ্য জানান সেবাপ্রার্থীরা। তাদের মতে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে লাপাত্তা হন ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। এ পরিস্থিতিতে সেবাপ্রার্থীরা কোনো নাগরিক সেবা পাচ্ছেন না। চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতিতে নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ওই সব ইউনিয়নে সাময়িকভাবে পদায়ন করেছেন। বর্তমানে তারাই পরিষদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া এই ৯টি ইউনিয়নে একই ব্যক্তি বারবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ছিলেন নির্বিকার! এ চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে স্ব-স্ব এলাকায় পাহাড়সম অভিযোগ রয়েছে। তবে ভয়ে কেউ এতদিন মুখ খোলেননি। কারণ প্রতিবাদ করলেই পড়তে হতো রোষানলে। এ ছাড়া অনেকে হামলা-মামলার ভয়ে এলাকায় থাকতেন না। অনেককে হুমকি-ধমকি দিয়ে এলাকা ছাড়া করার অভিযোগও মিলেছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর এসব প্রভাবশালী চেয়ারম্যান উধাও হয়ে গেছেন। এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে সবাই। একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় চেয়ারম্যানরা এখন সেখানেও নিষ্ক্রিয়। অনেকেই নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি ডিজেবল করে রেখেছেন।

সূত্র জানায়, সাগর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০২৩ সালের ৬ মার্চ বাড়বকুণ্ড ও বাঁশবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যানকে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আড়াই লাখ টাকা অর্থদণ্ড করেছিল। অন্যদিকে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে শিল্পকারখানা করতে হলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ্ মিয়াজিকে, এমন অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চেয়ারম্যানদের অনেকেই পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেও তারা ইচ্ছে হলে পরিষদে আসতেন। এদের মধ্যে সোনাইছড়ি ও সলিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান অন্যতম। সলিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ ও সোনাইছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মনির আহমেদকে ফোনে কখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান স্থানীয়রা। নিজের ইচ্ছানুযায়ী পরিষদে আসা-যাওয়া করতেন। এ ছাড়া সালিশে মাতাল অবস্থায় অনেককে মারধরের অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যান সালাউদ্দীন আজিজের।

রেহান উদ্দীন রেহান বারৈয়াঢালার চেয়ারম্যান ছিলেন চার মেয়াদে। তারও রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি। থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। তালাকসংক্রান্ত বিচারে তার রয়েছে দক্ষতা। দুই পক্ষকে ধমক দিয়ে বসান বৈঠকে। তারপর সালিশের নামে মূল টাকার অর্ধেক নেন নিজের পকেটে। এভাবেই তার এলাকায় রাজত্ব ধরে রেখেছিলেন তিনি।

তামজিদ রহমান নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তার কাছে প্রথমে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন ৫ নম্বর বাড়বকুণ্ড ইউপির চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ্। পরে ৫ হাজার টাকার ট্রেড লাইসেন্স তিনি শেষ পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকায় নেন। এ ছাড়া রাজধানীর একটি শিল্পগ্রুপ তার এলাকায় শত শত একর জমি কিনেছে। ওয়ারিশ সনদ জালিয়াতি ও হিন্দুদের সম্পত্তি জোর খাটিয়ে নানা কারসাজিসহ শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। সালিশ-বিচারেও দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়া অন্যদের পাত্তাও দিতেন না এই চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে ওই এলাকার জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলামকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তার মৃত্যুর ঘটনায় চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহকে প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়। মামলা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান এই চেয়ারম্যান।

আরেকজন সৈয়দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী। রাজনীতিবিদ হলেও একসময় পেশায় ছিলেন শিক্ষক। সেখানকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন সরে দাঁড়ালে ভাগ্য খুলে যায় তাজুল ইসলাম নিজামীর। ধাপে ধাপে শুরু হয় তাজুল ইসলামের আধিপত্য। ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নেন পুরো এলাকার সব ধরনের ব্যবসার। এরপর তার ছেলে ওই এলাকার ইন্টারনেট ও ডিশ লাইন ব্যবসা দখল করেন।

ভুক্তভোগী ইন্টারনেট ব্যবসায়ী নবী বলেন, ‘চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম নিজামীর ছেলে রাহুল সৈয়দপুর এলাকায় আমাদের ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তার কেটে বলেন এই এলাকায় শুধু সে ব্যবসা করবে, অন্যরা করতে পারবে না। এর পর থেকে আমরা ব্যবসা করতে পারিনি।’

তাজুল ইসলাম চেয়ারম্যানের আরেক ভাই সাইফুল ইসলাম নিজামী ডেকোরেশন ব্যবসাসহ ওই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে ইট, বালি ও সিমেন্টের ব্যবসা করতে থাকেন। এলাকায় যেকোনো ব্যবসা করতে হলে তাকে দিতে হয় কমিশন। এই চেয়ারম্যানের আরেক ভাই আশরাফুল ইসলাম নিজামী সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদে কাম-কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তবে পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। সেখানে সরকারি সেবা নিতে গেলে খারাপ আচরণের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এদিকে আলাদীনের চেরাগ পেয়েছেন বাঁশবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর। রাজধানীর একটি শিল্পগ্রুপ তার এলাকায় প্রকল্প করার উদ্দেশ্যে শত শত একর জমি কেনে। জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যান ও তার শ্যালক জনি এসব জমির কারবার করেন। তাদের বিরুদ্ধে এলাকার সাধারণ মানুষের জমি জোরপূর্বক দখল করে বা প্রভাব বিস্তার করে কেনার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ওয়ারিশদের নাম বাদ দিয়ে প্রতারণা করে নিয়েছেন অসংখ্য জমি। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে ওয়ারিশরা মিস মামলা করেছেন। এসব জমির হিস্যা অংশ মিস মামলার মাধ্যমে ফিরে পেলেও জোর করে দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে নিয়েছেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর ওই কোম্পানির জন্য জমি কেনা ও সাগর থেকে অবৈধভাবে বালু নিয়ে ভরাটের দায়িত্বও নেন। তার সুবাদে চেয়ারম্যান ও তার শ্যালক জনি মিলে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাট-প্লটসহ বিপুল সম্পত্তি। সীতাকুণ্ড পৌর সদরের সোবহানবাগ রোডে পাঁচ তলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি দেখা গেছে চেয়ারম্যানের শ্যালক জনির। তাদের দুজনেরই চট্টগ্রাম নগরীতে কোটি টাকার ফ্ল্যাট ও জায়গা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগের বার মুরাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন জাহেদ হোসেন নিজামী। পরিবার নিয়ে শহরে থাকতেন তিনি। তার চলাফেরা ছিল রাজার মতো। নানা অনিয়ম করে চেয়ারম্যান পাঁচ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হন।

কুমিরা ইউপি চেয়ারম্যান মোরশেদ হোসেন চৌধুরীও টানা চার মেয়াদের চেয়ারম্যান। কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, তার এলাকার শিল্পকারখানা থেকে নেন অবৈধ সুবিধা।

ভাটিয়ারীর চার মেয়াদে ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। নাগরিক সেবায় তার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স, ওয়ারিশ সনদসহ বিভিন্ন সনদ পেতে হয়রানি করতেন তিনি।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page