রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) হাতে বর্তমানে সচল জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৫টি। এর মধ্যে বাংলার অর্জন নামে একটি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে, বাংলার জয়যাত্রা নামে একটি মালয়েশিয়ার পেঙ্গেরং আঞ্চে রয়েছে। বাকি তিনটি জাহাজ দিয়ে ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে সমুদ্রপথে পরিবহন-বাণিজ্য একচেটিয়া বিদেশি মালিকানাধীন জাহাজে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় প্রতি বছর বাংলাদেশের হাতছাড়া হচ্ছে অন্তত এক হাজার কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার জন্য হাতে থাকা ৫টিসহ মোট ২৭টি জাহাজের একটি বহর গড়ে তুলতে চায় বিএসসি।
সে হিসেবে ৫৫-৬৬ হাজার মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতার দুটি বাল্ক কার্গো জাহাজ কিনতে আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে দরপত্র আহ্বানের অপেক্ষায় রয়েছে সংস্থাটি। এ জন্য সংস্থাটির বাজেট প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ২০টি নতুন জাহাজ কিনতে কার্যক্রম চালাচ্ছে বিএসসি।
রবিবার (১৭ নভেম্বর) এমন তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএসসির বহরে ৪৪টি জাহাজ সংযোজন হয়। পরে বয়সজনিত কারণ ও নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৬টি জাহাজ বিক্রি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিএসসি অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
১৮টি জাহাজ কেনার মাধ্যমে ১৯৮০ সালের দিকে সংস্থাটির বহরে জাহাজের সংখ্যা দাড়ায় ২৬টিতে। পরে তা এসে ঠেকে মাত্র ২টিতে। বেহাল এই অবস্থায় ২০১৮ সালে বিএসসি চীন থেকে ৬টি নতুন জাহাজ কিনে। এর মধ্যে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কমিশনিং বন্ধ হয়ে যায় এম ভি বাংলার সমৃদ্ধি। এজন্য বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে সংস্থাটি।
এছাড়া বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ নামে দুইটি লাইটার জাহাজ, বঙ্গোপসাগরের বহিঃনোঙরের মাদারভ্যাসেল থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে তেল আনায়নের কাজ করতো। দুইটি জাহাজই সম্প্রতি হওয়া অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাতিল হয়ে যায়। ফলে বর্তমানে বিএসসির বহরে সচল জাহাজের সংখ্যা দাড়ায় ৫টিতে। এর মধ্যে প্রায় ৩৯ হাজার মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতার বাংলার অর্জন বর্তমানে রয়েছে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং বাংলার জয়যাত্রা রয়েছে মালয়েশিয়ার পেঙ্গেরং আঞ্চে। বাকি তিনটি জাহাজ দিয়ে ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অংশ নেওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়।
কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, দেশীয় জাহাজ পর্যাপ্ত না থাকায় পণ্য পরিবহনে প্রায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাহাজের ভাড়া সাশ্রয় ও নাবিকদের চাকরির সুযোগ বাড়াতে দেশীয় জাহাজের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।
বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমাদের স্টাফ টার্গেট অনুসারে দু’টি বাল্ক ক্যারিয়ার ৫৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার মেট্রিকটনের মধ্যে কিনতে চাচ্ছি। বিশ্বের সব মার্কেট এবং বিশ্বের মেরিটাইম সেক্টরে যে ইন্সপেকশনগুলো হয় তাতে কোয়ালিফাই করতে হবে। এবং যেকোনো পোর্টে যাওয়ার মতো যেন সক্ষমতা থাকে আমাদের সেই ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনা করেই আমরা এখন সারা বিশ্বের মার্কেট নিয়ে স্টাডি করছি। তাই সমূদ্র বাণিজ্যে আমদানি-রপ্তানি কাজে অংশ গ্রহণ করে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের জন্য নতুন আরও ২০টি জাহাজ কিনতে চায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
এর মধ্যে প্রথমে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার দুটি মাদার ট্যাংকার ও ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার চীন থেকে জিটুজি ভিত্তিতে কেনার প্রক্রিয়া চলছে। যার জন্য ব্যয় হবে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আর এর প্রায় সব টাকাই ঋণ সহায়তা দিবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে চারটি জাহাজ বিএসসির বহরে যুক্ত হবে।
বাকি ১৮টি জাহাজের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টিউস ধারণ ক্ষমতার ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ কেনার জন্য অস্ট্রেলিয়ার এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফশোর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বিএসসি। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির শিপ রিপেয়ার অ্যান্ড নিউবিল্ড ডিভিশন থেকে বিএসসির কাছে টেকনিক্যাল আউটলাইনসহ জাহাজ সরবরাহের একটি প্রস্তাবনা পাঠায়।
আবার একই ধরনের ছয়টি সেলুলার কন্টেইনার জাহাজ কেনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ডায়সান শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে বিএসসি। এর আগে ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ সরবরাহের জন্য ইচ্ছা পোষণ করে সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট সো কিউন লি।
চিঠিতে জিটুজি ভিত্তিতে বিএসসিকে ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ সরবরাহের আগ্রহের কথা জানানো হয়। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে বিএসসি। বিদ্যমান জাহাজগুলোর সঙ্গে নতুন জাহাজগুলো যুক্ত হলে ক্রমে ঘুরে দাঁড়ানো বিএসসি দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসসির পরিকল্পনা বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মাসউদ মিয়া বলেন, দুইটি জাহাজ কেনার পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিজিবল স্টাডি করা হচ্ছে। লাভ-ক্ষতি বিবেচনায় জাহাজ দুইটি ক্রয়ের জন্য ৭৫০ কোটি থেকে ৮০০ কোটি বরাদ্দ করা যেতে পারে। ফিজিবল স্টাডি শেষে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করার পর টেন্ডার (দরপত্র) করা হবে। এ সময় প্রাইস ইস্টিমেট কমিটি দাম নির্ধারণ করবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ হতে আনুমানিক ৩ থেকে ৬ মাসের মতো সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেন, দেশের বর্তমান আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া বাবদ প্রচুর অর্থ বিদেশি জাহাজ মালিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ পরিবহন ব্যয় অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, কেননা দেশের অর্থনৈতিক আকারও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
তিনি বলেন, বিএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানে দেশের বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় আরও ৪০-৫০টি জাহাজ থাকা উচিত। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূল কারণে বিশেষ করে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে না পারায় সে পরিমাণ জাহাজ কর্পোরেশনের বহরে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে সরকারের দিকনির্দেশনা ও সক্রিয় সহযোগিতায় এ সংস্থা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, বিশ্বের নানা দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে। একই সাথে রপ্তানি করা হয় ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশের আমদানি করা পণ্যের অন্তত ৮২ শতাংশ পরিবাহিত হয় সমুদ্র পথে। রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই পরিবাহিত হয় জাহাজের মাধ্যমে। এক বছরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের যে পণ্য সমুদ্র পথে পরিবাহিত হয় তাতে ব্যয় হয় অন্তত এক হাজার কোটি ডলার। এই টাকার প্রায় পুরোটা বিদেশি জাহাজ মালিকদের পকেটে চলে যায়। বিশাল এই বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব নগণ্য।
তিনি বলেন, বিএসসি কিংবা দেশীয় বেসরকারি কো¤পানিগুলোর কাছে পর্যাপ্ত জাহাজ না থাকায় বাংলাদেশ সমুদ্র বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। বর্তমানে দেশে মাত্র ৫টি কন্টেইনার জাহাজ রয়েছে বিএসসির। খোলা পণ্যবাহী জাহাজ (লাইটার) রয়েছে ৮৪টির মতো। সরকার ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন আইনের মাধ্যমে দেশীয় জাহাজ শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পর্যাপ্ত জাহাজের অভাবে তা ব্যাহত হচ্ছে। দেশীয় জাহাজ না থাকায় পরিবহন ব্যয়ের কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বিএসসি কিংবা দেশীয় বেসরকারি কো¤পানিগুলোর বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো গেলে এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাড়ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিনি আরও বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিজস্ব সময়সূচি অনুযায়ী মাদার ট্যাংকারে জ্বালানি পরিবহন করা হবে। আমদানি করা ক্রুড অয়েল সরাসরি আনলোড করার জন্য বঙ্গোপসাগরে মহেশখালীর পশ্চিম প্রান্তে ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নামের একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ফলে যে দুটি মাদার ট্যাংকার কেনা হচ্ছে, সেসব জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভিড়িয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে হতে ক্রুড অয়েল ও রিফাইন্ড প্রোডাক্ট সরাসরি ইস্টার্ন রিফাইনারির ডিপোতে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।
একইসঙ্গে রামপাল, মাতারবাড়ি ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশে প্রচুর কয়লা আমদানি হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোন এবং আনোয়ারায় চায়না ইকোনমিক জোনের কার্যক্রম শুরু হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য দ্রুত বাড়বে। আমদানি-রপ্তানি যাতে দেশীয় জাহাজ পরিবহন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে বিএসসি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন জাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজ কেনা স¤পন্ন হলে বিএসসির জাহাজের বহর সমৃদ্ধ হবে। সাশ্রয় হবে প্রচুর ডলার। পাশাপাশি বিএসসির আয় বাড়বে। এছাড়া নাবিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে দেশীয় নাবিকদের চাহিদা বাড়বে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করছে প্রতিষ্ঠানটি।