দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি পরিচালনায় অপরিহার্য কুলিং টাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের পর দুই বছর না যেতেই ভেঙে পড়েছে। ১৮ কোটি টাকায় স্থাপন করা এ প্ল্যান্টটির স্থায়ীত্ব কাল ছিল কমপক্ষে ২০ বছর। অভিযোগ উঠেছে, প্ল্যান্টটি নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। টাওয়ারে ব্যবহার করা নাটবল্টু, জয়েন্ট প্লেট, পাম্পসহ সবই ‘নকল’।
কুলিং টাওয়ারটি ভেঙে পড়ার পর ৫৭ বছর আগে স্থাপন করা পুরোনো টাওয়ার তড়িঘড়ি মেরামত করে কাজ চালানো হচ্ছে। কিন্তু এটিও যেকোনো সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভেঙে পড়া নতুন টাওয়ারটিও কোনো রকমে ঠিক করা হয়েছে। এ অবস্থায় দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েই গেছে। আন্তর্জাতিক পরীক্ষা, পরিদর্শন এবং সার্টিফিকেশনে বিশেষায়িত সংস্থা ফ্রান্সের ব্যুরো ভেরিটাসের পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি নতুন কুলিং টাওয়ারটি স্থাপনের জন্য ইউয়েন থাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বিপিসির চুক্তি হয়। ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল ৪ হাজার ঘনমিটার সক্ষমতার এ টাওয়ার স্থাপনের কাজ শেষ হয়। ভেঙে পড়ার কারণে গত ৬ এপ্রিল কুলিং টাওয়ারটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইস্টার্ন রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ। এ সময় রিফাইনারির সব কটি প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তড়িঘড়ি কোনো রকমে সচল করা হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার সময় ৫৭ বছর আগে স্থাপন করা কুলিং টাওয়ারটি।
কুলিং টাওয়ার ভেঙে পড়ার ঘটনায় তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। ইস্টার্ন রিফাইনারির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী রায়হান আহমাদকে আহ্বায়ক করে গঠন করা এ কমিটিতে রয়েছেন কুলিং টাওয়ার প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ইস্টার্ন রিফাইনারির ডেপুটি ম্যানেজার প্রকৌশলী এ কে এম নঈম উল্লাহও।
কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কুলিং টাওয়ার সরবরাহকারী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের একজন বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক পরীক্ষা, পরিদর্শন এবং সার্টিফিকেশনে বিশেষায়িত সংস্থা ফ্রান্সের ব্যুরো ভেরিটাসের একজন বিশেষজ্ঞ টাওয়ারটি পরিদর্শন করেন। ব্যুরো ভেরিটাসের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কুলিং টাওয়ারে ব্যবহৃত নাটবল্টু, জয়েন্ট প্লেট, পাম্পসহ সবকিছুতে মরিচা পড়েছে। টাওয়ারটির বড় অংশজুড়ে মরিচা ও শৈবাল দেখা যাওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ব্যুরো ভেরিটাসের প্রতিবেদনে।
এদিকে নতুন কুলিং টাওয়ার দুই বছরে ভেঙে পড়া সত্ত্বেও গত সাত মাসে এটি স্থাপন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ, হয়নি পূর্ণাঙ্গ তদন্তও। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর টাওয়ার স্থাপনে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন একজন (নাম প্রকাশ না করে)। বিষয়টি জ্বালানি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়ানোর পর ওই কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছে রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে প্রকৌশলী এ কে এম নঈম উল্লাহ বলেন, ‘টাওয়ার ভেঙে পড়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু এরপর আমরা এটা দ্রুত ঠিক করে ফেলেছি। এগুলো আপনাদেরকে কে জানায়?’ উল্লিখিত ঘটনায় টাওয়ার স্থাপন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীকে শোকজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
ইস্টার্ন রিফাইনারির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী নাজির আহমেদ বলেন, কমপক্ষে ২০ বছরের জন্য ডিজাইন করা কুলিং টাওয়ারটি দুই বছরেরও কম সময়ে ভেঙে পড়ার পর সংস্কার করা হয়েছে। ৫৭ বছর আগের টাওয়ার ও সংস্কার করা টাওয়ার দুইটা ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরীফ হাসনাতকে কয়েক দফা ফোন করেও তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আর বিপিসির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও গণসংযোগ) মো. ইসতিয়াক হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি শোকজের কপি পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে সরাসরি কিছু না বলে শুধু ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’ বলে কথা শেষ করেন।
প্রসঙ্গত, কুলিং টাওয়ার হলো তাপ স্থানান্তর করা যন্ত্র, যা মূলত পানিকে শীতল করার পর পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে। মূল প্ল্যান্টের যন্ত্রাংশ যাতে বেশি উত্তপ্ত না হয়, সে জন্য শীতল পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হয়। প্রবাহিত শীতল পানি উত্তপ্ত যন্ত্রাংশের তাপ শোষণ করে তা যায় কুলিং টাওয়ারে। সেখানে পানিকে শীতলীকরণ করে আবার সেই পানি মূল প্ল্যান্টে প্রবাহিত করা হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি। বছরে এটি ১৪ লাখ টন তেল পরিশোধন করে।