আমদানি হ্রাস পাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি) নি®পত্তি ও নতুন ঋণপত্র খোলার হারও কমেছে। যার প্রভাবে জাহাজ আসা কমেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এতে পণ্যমূল্য বাড়ায় অস্থির হয়ে পড়েছে বাজারও।
এই পরিস্থিতিতে আগামী রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ এবং পণ্যমূল্য নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষকেই শুধু নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনকেও বিষিয়ে তুলেছে।
বাধ্য হয়ে তারা খাদ্য ব্যয়ে লাগাম টেনেছে। ভোগ কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। ফলে পণ্য আমদানিতেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এতে বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে। এ অবস্থায় আসছে রোজায় সরবরাহ সংকটের নামে আরেক দফা বাড়তে পারে পণ্যমূল্য। তাতে পরিস্থিতি আরও অস্থির হতে পারে।
এমন মন্তব্য খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ স¤পাদক মো. ইদ্রিসের। তিনি বলেন, ভারত থেকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারগুলোতে আলু-পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। নগরীর খাতুনগঞ্জে গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ আকার ও মানভেদে ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯৫-৯৮ টাকায়। খুচরা বাজারে এসব পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।
রিয়াজউদ্দিন বাজার আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ স¤পাদক মো. ফারুক শিবলী বলেন, ভারত থেকে আলু রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে মুন্সীগঞ্জের কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণে আমাদের এখানেও প্রভাব পড়েছে। নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে সপ্তাহখানেক আগে প্রতি কেজি আলু ৫৯ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। খুচরা বাজারে সপ্তাহখানেক আগে কেজিপ্রতি আলু ৭০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।
এভাবে ছোলা, মটর, আদা, হলুদ, রসুন, মসুর ডাল, তেল ও মসল্লাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্য ক্রমেই বাড়ছে। ভারত গত মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দিবাগত রাত ১২টার দিকে আলু ও পেঁয়াজ রপ্তানির ¯¬ট বুকিং বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিলেও আমদানিতে গতি নেই। এর প্রভাবে প্রতিটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের এই দুই ব্যবসায়ী নেতা।
অন্যদিকে আমদানি হ্রাসের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরেও কন্টেনার জাহাজ চলাচলের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। বন্দরের চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে জেটি অনুযায়ী জাহাজ নেই। বহির্নোঙরেও নেই অপেক্ষমাণ কোন জাহাজ।
শনিবারও (৩০ নভেম্বর) বন্দরের আরো জেটি খালি থাকবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রার বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিম। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ কোন কন্টেনার জাহাজ ছিল না। বন্দরের কন্টেনার জেটি হিসেবে ব্যবহৃত জেনারেল কার্গো বার্থের ১১ নম্বর জেটি এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের তিনটি জেটিই খালি ছিল। শুক্রবার একইসাথে খালি হয়ে গেছে বন্দরের ৬টি জেটিও।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বার্থিং মিটিং অনুযায়ী, শুক্রবার বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থের ৯, ১০ এবং ১১ নম্বর জেটি, চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনালের ১ নম্বর জেটি, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালের ২ ও ৩ নম্বর জেটি জাহাজ শূন্য ছিল। শনিবার খালি থাকবে ১১ নম্বর জেটিও। শনিবারের মধ্যে ৭টি কন্টেনার জাহাজ বিদেশ থেকে এসে সরাসরি খালি জেটিগুলোতে বার্থিং নেবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জেটি খালি থাকছে। জাহাজ এসে অনঅ্যারাইভাল বার্থিং পাচ্ছে। আগের তুলনায় জাহাজ আসার পরিমান কমেছে। সাম্প্রতিক স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে একসাথে এতগুলো জেটি খালি থাকার নজির নেই।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমদানিতে শ্লথ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই বার্তা আমরা বিভিন্নভাবে নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। এখানে গতি আনতে হবে। আগামী রোজার চাহিদা পূরণের জন্য সব ধরনের পণ্য ডিসেম্বরের মধ্যেই আমদানি নিশ্চিত করা ভালো হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের মতে, করোনাকাল থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর গত কয়েক বছর ধরে আমদানি যা হয়েছে ভোক্তার তুলনায় তার পরিমাণ কম ছিল। এ জন্য নিত্যপণের বাজারে অস্থিরতা কমাতে পারেনি বিগত সরকার। এখন যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে তার পরিমাণও কম। এর অর্থ হলো-অর্থনীতি দুর্বল অবস্থায় আছে, এটা তারই ইঙ্গিত।
তিনি বলেন, আগে ছিল বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার সংকট। এ কারণে বিগত সরকারের সময়ে আমরা দেখেছি আমদানি সংকোচন করা হয়েছিল। এলসি মার্জিনও ছিল। কিন্তু এবার আমরা কী দেখছি? বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে। ফলে নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। তারপরও আমদানিতে আশানুরূপ গতি ফিরছে না। এর অর্থ হলো চাহিদা কমেছে।
এর কারণ দুটি। এক. উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। খাদ্য কিনতে খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। এটা কে কতটুকু পারে? নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ তো খাদ্যের বাইরে চিকিৎসা ও সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ব্যয় করে। তারা ওই সব ব্যয় কমাতে পারে না। বাধ্য হয়ে খাদ্য ব্যয়ে তারা লাগাম টেনেছে। তারা কম ভোগ করছে বা চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।
দুই. আমদানিকারক এবং তার ব্যাংক বৈদেশিক ঋণ (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) পাচ্ছে না। কারণ থার্ড পার্টি হিসেবে যারা ঋণ দেয়, তারা এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আশানুরূপ কিছু পাচ্ছে না। এর ফলে আমদানিকারকদের জন্য সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পাওয়া সহজ হচ্ছে না।
অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমদানির তথ্য বলছে, দেশের অর্থনীতি সচল হয়নি। এর কারণ কী? আপনি যদি পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে, মার্কেটে নিরাপত্তার অভাব দেখেন, তাহলে আপনি কী করবেন? বাইরে যাবেন না। কাজ করবেন না। আয় করবেন না। ভোগ কম বা ত্যাগ করবেন। বিনিয়োগ নিয়ে ভাবনা বাদ দেবেন। এই তো হবে। তাই হচ্ছে। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে সবার আগে। আমাদের ইতিবাচক দুটি সূচক আছে। এর একটি হলো রেমিট্যান্স এবং অন্যটি রপ্তানি। সুতরাং নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে এনফোর্সমেন্ট পর্যন্ত দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতি সচলতার দিকে এগিয়ে যাবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নানা কারণে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি বড় আন্দোলন গেছে। সেই সময়ে পরিবহন, সরবরাহ ও উৎপাদনে একটা স্থবিরতা ছিল। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা- এসব কিছুর কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকটা মন্দ গেছে। আশা করা যায় দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ ডিসেম্বরে পরিস্থিতির কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তবে অর্থনীতি যে ভালো নেই, নানাবিধ চ্যালেঞ্জ আছে, তা তো ¯পষ্ট। তাই অর্থনীতি আগের অবস্থায় যেতে সময় লাগবে।
এ অবস্থায়ও আশার বাণী শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম শাখার নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোক্তাপণ্যের আমদানিতে শূন্য মার্জিনে ঋণপত্র খোলা এবং সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণে আমদানি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যদিও আশানুরুপ ফল মিলছে না এখনো। তবে এই মুহূর্তে আমদানি একটি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। বছরের সার্বিক আমদানি পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে মর্মে আশা করা যাচ্ছে।