আমানতের সুদহার এতদিন এতই কমছিল যে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে টাকা রাখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে পরিস্থিতি এখন বদলাচ্ছে। তফসিলি ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক শিগগিরই নতুন সুদহার ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ফলে সঞ্চয়কারীরা আবার ব্যাংকমুখী হচ্ছেন। এতে ব্যাংকের আমানত বাড়ছে। পাশাপাশি তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছিলেন। কারণ বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো যে সুদ বা মুনাফা দিত, তা ছিল মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। এতে সঞ্চয়কারীদের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বছরের শেষে চাপ আরও বাড়তে থাকে।
বতর্মানে মূল্যস্ফীতির গড় হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে সুদ দেয় সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। এর ফলে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হচ্ছে গ্রাহককে। এসব কারণে ব্যাংকের টাকা বাইরে চলে যায়।
উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে এখন মানুষের সঞ্চয়ক্ষমতা কমেছে। এর মধ্যে ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে এখন সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি ঋণ না দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে তারল্যের চাহিদা থাকায় আমানতের সুদহার বাড়ছে।
ব্যাংকারদের মতে, অনেক টাকা ব্যাংকের বাইরে পড়ে আছে। এই টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেরত আনতে হবে। এ জন্য আমানতকারীদের আকর্ষণীয় মুনাফা দিতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। তারা মনে করেন, আমানতের সুদহার বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়কারীরা উৎসাহিত হবেন। ব্যাংকে টাকা আরও বেশি যাবে।
যোগাযোগ করা হলে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ব্যাংক খাতে সুদহারের ৯-৬ পদ্ধতি চালু করা উচিত হয়নি, কারণ ওটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। যে কারণে আমাদের মাথা নত করতে হয়েছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করার ফল আমরা দেখেছি ভালো কোনো ফল আসেনি। বরং আরও খারাপ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ডলারসংকট তৈরি হয়েছে। টাকা ব্যাংকে জমা রাখায় আমানতকারীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখায় বছর শেষে ৯০ টাকা হয়ে গেছে। মুনাফায় ক্ষয় হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আগে এক কেজি চাল যে দামে কিনতে হতো, এখন তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমানতের সুদহার বাড়াতেই হবে। তা না হলে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’
আনিস এ খান আরও বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসতে হবে, যাতে গ্রাহক এসব খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন। আমানতের সুদ অনেকেই সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। শিগগিরই অনেক ব্যাংক নতুন সুদহার ঘোষণা দেবে। আমি মনে করি, এটা ঠিক আছে। কোনো কোনো ব্যাংক এর চেয়ে বেশি দিচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি আছে।’
“ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখায় বছর শেষে ৯০ টাকা হয়ে গেছে। মুনাফায় ক্ষয় হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আগে এক কেজি চাল যে দামে কিনতে হতো, এখন তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমানতের সুদহার বাড়াতেই হবে। তা না হলে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার বেশি দিচ্ছে। পদ্মা ব্যাংক এখন মেয়াদি আমানত নিচ্ছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে। ন্যাশনাল ব্যাংক বিশেষ সঞ্চয় স্কিমে সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ তথা ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। অথচ ঋণের সুদহার যেখানে সাড়ে ১১ শতাংশ। তবে সব ব্যাংকই এত বাড়তি সুদে আমানত নিচ্ছে তেমন নয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংক তিন বছর মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ সুদ দিচ্ছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকও মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ সুদ দিচ্ছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি আমানত রাখলে সর্বোচ্চ মুনাফা দিচ্ছে ৭ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলেন, সংকটে পড়া ব্যাংক অনেক সময় ঋণের সর্বোচ্চ সীমার বেশি সুদে আমানত নেয়। সাময়িক সংকট মেটানোর জন্য একটি ব্যাংক এমন করে থাকে। এ উপায়ে আমানত নিয়ে হয়তো ব্যাংকটি স্বল্পমেয়াদে টিকে থাকতে পারে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা; আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। এদিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা কমে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৮ কোটি টাকায় নেমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সুদের হারের ৯-৬ সীমা তুলে দেওয়ার পর আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ঋণের সুদহার আড়াই শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। সমান তালে বেড়েছে আমানতের সুদহারও। এর ফলে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ব্যাংকার আনিস এ খান বলেন বলেন, ‘সুদহারের নির্দিষ্ট সীমা তুলে দেওয়ার পর আমানত বাড়ছে। এতে মানুষ ভালো সুদ পাচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফিরছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার মতো তারল্য বাড়ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক যে মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে, তারই ফলে আমানতের সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এতে বিনিয়োগ কিছুটা নিরুৎসাহিত হলেও সঞ্চয়কারীরা উপকৃত হবেন।
ঈশান/খম/মউ