বুধবার- ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪

খাতুনগঞ্জে গড়ে তোলা হচ্ছে পণ্যের মজুদ, বাড়ছে দামও

খাতুনগঞ্জে গড়ে তোলা হচ্ছে পণ্যের মজুদ, বাড়ছে দামও
print news

চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে গড়ে তোলা হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের মজুদ। যদিও ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় পণ্য আমদানি জটিলতার কথা বলছেন আড়তদাররা।

বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে রমজানের ভোগ্যপণ্য ছোলা. মটর, চিনি, সয়াবিন, মসুর ও খেসারি ডালের মজুদ চলছে দেদারছে। মজুদ করা হচ্ছে রসুন, আদা এমনকি রপ্তানি নিষিদ্ধ ভারতীয় পেঁয়াজও। পরিবহন করে আনা ট্রাক থেকে বস্তায় বস্তায় এসব পণ্য আড়তে নিয়ে যাচ্ছেন নিয়োজিত শ্রমিকরা।

শ্রমিকরা জানান, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের প্রতিটি আড়ত এখন নিত্যপণ্যের মজুদে ঠাসা। সামনের রমজানে বাজার ধরতে এসব পণ্য আমদানি করেছেন আড়তদাররা। এরপরও বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। তবে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন রমজানে পণ্য মূল্য সহনীয় রাখতে পণ্য মজুদ করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, যেসব পণ্য এখন আমদানি করা হচ্ছে তা বুকিং থেকে শুরু করে গুদামে আসা পর্যন্ত দেড়-দুই মাস সময় লেগে যেতে পারে। রমজান মাসকে সামনে রেখে এখন থেকে পণ্য গুদামজাত না করলে বাজার ধরা কঠিন হবে। ফলে ইতোমধ্যে প্রচুর পরিমাণে ছোলা. মটর, চিনি, সয়াবিন, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মসুর ও খেসারি ডাল আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া গত বছরের অনেক অবিক্রিত পণ্য গুদামে থেকে গেছে। ফলে সব মিলিয়ে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম সহনশীল পর্যায়ে থাকবে। তবে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ায় পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি হতে পারে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জে গড়ে তোলা হচ্ছে পণ্যের মজুদ, বাড়ছে দামও

নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছেই
নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর একই সময় অস্ট্রেলিয়ার ছোলার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৯০ টাকা, যা বর্তমানে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৯৮ টাকায়। গত বছর ভারতীয় ছোলার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৯২ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকায়। প্রতিবছর রমজানে দেশে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টন ছোলা লাগে। যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর।

এছাড়া আগের বছর প্রতি মণ চিনি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টাকা দরে, এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৯০০ টাকায়। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রমজানে প্রয়োজন পড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ টন চিনির। বাজারে চাহিদার প্রায় পুরো চিনিই আমদানি নির্ভর।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামের সরকারি স্কুলে আসনের ৬২ গুণ ভর্তির আবেদন!

এছাড়া গত বছর কেজিপ্রতি ৮২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল মসুর ডাল। যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। গত বছর যে খেসারি ডালের দাম ছিল ৯০ টাকা, বর্তমানে তা ৯৮ টাকা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে। মটর ডাল গত বছর বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা, বর্তমানে ৬৫ টাকা। আগের বছর কেজিপ্রতি ৫২ টাকা দরে বিক্রি হওয়া সাদা মটর বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকায়।

এছাড়া মুগ ডাল গত বছর রমজানের আগে বিক্রি হয়েছে ৭২ টাকা, কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৩২ টাকা। প্রতি মণ (৩৭.৩২ কেজি) সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৮০০ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া পাম তেল প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৩০০ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৭৫০ টাকা।

আগের বছর একই সময়ে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা, তা বর্তমানে বিক্রয় হচ্ছে কেজিপ্রতি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দরে। ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে প্রচুর মজুদ রয়েছে। এছাড়া দেশি পেঁয়াজ বিক্রয় হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ টাকায়। একইভাবে ১২০ টাকার রসুন বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২০৫ টাকায়। চীনা আদা গত বছর ছিল ১৬০ টাকা, বর্তমানে ২২০ টাকা এবং একবছর আগে মিয়ানমারের আদা বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।

যেভাবে আসছে ভারতীয় পেঁয়াজ
খাতুনগঞ্জে গড়ে তোলা হচ্ছে পণ্যের মজুদ, বাড়ছে দামও

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে আসছে ভারতীয় পেঁয়াজ। তবে এ বিষয়ে সরাসরি মুখ খুলছেন না খাতুনগঞ্জের কোন আড়তদার। নানা প্রশ্নের মুখে নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের এক আড়তদার বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও চোরাই পথে পেঁয়াজ আসা থেমে নেই। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে আসা পেঁয়াজ আসছে খাতুনগঞ্জে। তবে কী পরিমাণ পেঁয়াজ চোরাই পথে আসছে তা তিনি বলতে পারেননি।

আরও পড়ুন :  সেনাবাহিনীকে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত করার প্রত্যয় সেনাপ্রধানের

তবে খাতুনগঞ্জের লোড-আনলোড শ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিন ১৩ টনের এক থেকে দুই ট্রাক ভারতীয় পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জে আসছে। আর এসব পেঁয়াজ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। জাতভেদে এসব পেঁয়াজ পাইকারি কেজিতে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

শ্রমিকরা জানান, গত ৮ ডিসেম্বর এক আদেশে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারত। এরপর দিনাজপুরের হিলি, সোনামসজিদসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বর্তমানে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে। ভারতীয় চোরাকারবারীরা এই পেঁয়াজ পাচারের সাথে জড়িত।

এদিকে নগরীর কাজীর দেউড়ি বাজার, কর্ণফুলী মার্কেট ও হালিশহর এলাকার কিছু দোকানে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রয় করতে দেখা গেছে। চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে কিনে এনে ১৪০ টাকায় পেঁয়াজগুলো বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন দোকানদাররা।

চাক্তাইয়ে আফরা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, এবার দেশে প্রচুর পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। খাতুনগঞ্জেও দেশি পেঁয়াজের পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ রয়েছে। গত বছর সরকার বছরের শুরুতে কয়েক মাস পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল। এ বছরও আগামী কয়েক মাস পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখার সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজ আসায় সবার জন্য ভালো হচ্ছে। কারণ ভারতের পেঁয়াজের কারণে দেশি পেঁয়াজের দাম কমতির দিকে। না হলে দেশি পেঁয়াজ ১০০ টাকার ওপরে কিনে খেতে হতো।

খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেটের ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, রমজানকে কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্যের আমদানি আগের চেয়ে বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের দোকান ও গুদামে প্রচুর পরিমাণ পণ্য মজুদ রয়েছে। সাধারণত রমজান আসলে শরবতের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই চিনির ব্যবহারও বাড়ে কয়েক গুণ। বর্তমানে বাজারে চিনির কোনো ঘাটতি নেই।

এছাড়া সারা দেশে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে ছোলা এসেছে। এছাড়া এর বাইরে রমজানে সাদা মটর ও মসুর ডালেরও চাহিদা বেড়ে যায়। ভোজ্যতেল, চিড়া এবং খেজুরের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। সাধারণত খেজুর আমদানি হয় ইরান, তিউনিসিয়া, দুবাই ও সৌদি আরব থেকে।

আরও পড়ুন :  শান্তিচুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে অশান্তি, চুক্তির মুলে নোবেল পুরুস্কারের লোভ

খাতুনগঞ্জে গড়ে তোলা হচ্ছে পণ্যের মজুদ, বাড়ছে দামও

আড়তদারদের মন্তব্য
চাক্তাই আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, রমজান উপলক্ষে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পণ্য গুদামজাত শুরু করেছেন। আমদানিকৃত পণ্য চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করবেন ব্যবসায়ীরা। তবে এ বছর আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেশি।

দাম বাড়ার পেছনে ডলার সংকট, পর্যাপ্ত এলসি না হওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। বরবারের মতো প্রশাসন প্রতিদিন অভিযান চালালেও দাম কমছে না নিত্যপণ্যের।

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, গত তিন চার মাস আগে থেকে রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলেন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে সেইসব পণ্য গুদামজাত হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। আবার তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। বর্তমানে যে পরিমাণ পণ্য আমদানির মাধ্যমে মজুদ করা হয়েছে, রমজানে পণ্যের দাম বাড়বে না।

ক্যাবের বক্তব্য
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, ব্যবসায়ীরা একবার সয়াবিন, একবার পেঁয়াজ, একবার ডাল, আটা-ময়দা এভাবে প্রতিটি পণ্যের মজুদ গড়ে তোলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন। এখন রমজান ঘিরে পণ্য মজুদ করছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ ধরনের কারসাজি ও অতিমুনাফার কার্যক্রম এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কালক্ষেপণে সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার উপপরিচালকের বক্তব্য
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, পণ্য শুল্ক কমানো হয়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি কারণে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি আড়তদারগুলোর একটা অজুহাত। কারণ ডলারের যে বাড়তি দাম, এই দামে কেনা নিত্যপণ্য বাজারে আসতে দুই মাস লাগে। তারা এই সুযোগটা নিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম যেটা ঠিক করে দেয় সেটা কখনই বাজারে কার্যকর হয়নি।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page