চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় চীনের প্রতিষ্ঠান সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভি। প্রতিষ্ঠানটি কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্ল্যান্ট বসাতে চায়। এতে চসিকের কোন আপত্তি না থাকলেও বাধা হয়ে দাড়িয়েছে পরিবেশবাদীরা।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) এ তথ্য জানান চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গত এক যুগে একাধিক বিদেশি সংস্থা থেকে ২০টি প্রস্তাব পায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। প্রস্তাবনাগুলো পর্যালোচনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চসিক। এর মধ্যে চীনের প্রতিষ্ঠান সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভির একটি প্রস্তাব রয়েছে।
একাধিক ‘লোভনীয়’ প্রস্তাবের ভিড়ে মন্ত্রণালয় চাইনিজ প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবটিতে আগ্রহ দেখায়। পরবর্তীতে প্ল্যান্ট বসাতে চর বাকলিয়ায় ৩৫ একর খাস ভূমি বন্দোবস্তের জন্য চসিককে প্রশাসনিক অনুমোদনও দেয়। খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া গেলে তা সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভির ব্যবহারে আপত্তি নেই জানিয়ে গত ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে চসিক।
তিনি আরও বলেন, চসিক যে ২০টি প্রস্তাব পায় তার মধ্যে বেসরকারি খাতে বিওও (বিল্ড, ওন, অপারেট) ভিত্তিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৩টি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে প্রেরণ করে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) প্রাথমিক মূল্যায়নের পর পাঁচটি প্রস্তাব কারিগরি ও আর্থিক কমিটি পর্যালোচনা করে।
এর মধ্যে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে চরটির তালিকা করে। সেখানে প্রথমে রয়েছে সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভির প্রস্তাবটি। যার সারসংক্ষেপ গত বছরের ১৯ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালনি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) বরাবর উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, সেভিয়া–চেক–অর্চাডের সাথে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি ট্যারিফ নির্ধারণের জন্য নেগোসিয়েশন করতে পারে। এতে সফল না হলে পরবর্তীতে যোগ্যতার ক্রমানুসারে পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নেগোসিয়েশন করবে।
তবে ওই সারসংক্ষেপে চর বাকলিয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। সেখানে বলা হয়, চসিক হালিশহর বর্জ্য ভাগাড় (টিজি) ৬ দশমিক ০২ একর জমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনাপত্তি প্রদান করেছে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান ও বর্জ্যের ব্যবস্থা করা হবে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানায় চসিক।
বাকলিয়ার চরকে বাছাই করার কারণ :
গত বছরের ২ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দেয় চসিক। এতে উল্লেখ করা হয়, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক প্রস্তাবিত চর বাকলিয়ায় ৩৫ একর খাস জমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনুকূলে বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশাসনিক অনুমোদন চায় চসিক। এ চিঠির ১৪ দিনের মাথায় ১৬ নভেম্বর চসিককে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এদিকে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে চসিক জানায়, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে যেকোনো স্থানে প্ল্যান্ট স্থাপন করলে চট্টগ্রামবাসী উপকৃত হবে বলে বিশ্বাস করে চসিক। চসিকের চার হাজার কর্মী প্রতিদিন নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে হালিশহর এবং আরেফিন নগরে টিজিতে সংরক্ষণ করে আসছে। এ দুটি টিজির ধারণ ক্ষমতা বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থায় চসিক এলাকায় প্রতিদিন উৎপাদিত প্রায় ২১ শত মেট্রিক টন বর্জ্য যথাযথ ব্যবস্থা করা চসিকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা অন্য কোনো উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা চসিকের জন্য আবশ্যক।
এদিকে বোয়ালখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) গত বছর জুলাইয়ে জেলা প্রশাসনকে একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে গত বছরের ২৩ জুলাই একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয, বোয়ালখালীর সহকারী কমিশনারের (ভূমি) প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই ৩৫ একর জমি একটি বিচ্ছিন্ন চর। চরে চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। মূল ভাগের সাথে ব্রিজ নির্মাণ করে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।
সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভির সাথে মৌখিক আলাপে জানা যায়, ওই সংস্থা বার্জ শিপের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় বর্জ্য পরিবহন করবে। এছাড়া ওই চরে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা, বার্জের মাধ্যমে বর্জ্য পরিবহনে পরিবেশগত সমস্যাসহ অন্য সমস্যা রয়েছে কিনা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি রয়েছে কিনা তা জানাতে বলা হয় চসিককে।
চসিকের অনাপত্তি :
২১ মার্চ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চর বাকলিয়ার ৩৫ একর ভূমি সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভিকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে কিনা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। মঙ্গলবার এর জবাবে চসিক জানায়, খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া গেলে তা সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভির ব্যবহারে সিটি কর্পোরেশনের আপত্তি থাকবে না।
যা বলছেন পরিবেশবাদিরা :
এদিকে চর বাকলিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন নিয়ে আপত্তি তুলেছেন পরিবেশবাদীরা। কারণ চর বাকলিয়া উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে রয়েছে স্বর্ণলতাসহ বিরল ১১৩টি ঔষধিসহ ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হলে যা ধ্বংস হয়ে যাবে। একইসঙ্গে এ চর হচ্ছে পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। প্ল্যান্ট হলে সেটাও নষ্ট হবে।
এছাড়া চট্টগ্রাম শহর থেকে বর্জ্য আনা–নেওয়ার ক্ষেত্রে তা নদীতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দূষিত হবে কর্ণফুলী। এমনকি হালদা নদীর মোহনা কাছে হওয়ায় দূষণের শিকার হতে পারে হালদাও।
এ অবস্থায় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বাস্তবায়নে সেখানকার মাটি পরীক্ষা শুরু করেছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ওই চরে গিয়ে মাটি পরীক্ষার কাজ করতে দেখা গেছে। পরীক্ষায় নিয়োজিত কর্মীরা সেখানে তাঁবু করে। এটা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবেশকর্মীরা।
চর বাকলিয়ায় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার দাবি জানিয়ে ‘কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের মঞ্চ’ এর ব্যানারে পরিবেশকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন। তারা চর বাকলিয়ায় গিয়ে মানববন্ধন করেন। সংবাদ সম্মেলন করে আল্টিমেটামও দেন। সর্বশেষ ১ এপ্রিল জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দেন।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে হাই কোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (ক) অনুসারে পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার বাধ্যবাধতা আছে। সে হিসেবে নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে বর্জ্য শোধন প্রকল্প অবৈধ।
কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের মঞ্চ–এর আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্পটি বাকলিয়া চরের পরিবর্তে অন্যত্র স্থাপনের পাশাপাশি চরটিতে কর্ণফুলীর তীরের দেশীয় প্রজাতির বাগান করা হলে পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষার পাশাপাশি দেশের বিলুপ্তপ্রায় গাছ এবং পশু–পাখির আবাসস্থল হবে।
পরিবেশবিদদের মতামত :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট করলে চর বাকলিয়ার সামগ্রিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। সেখানে প্রচুর উদ্ভিদ আছে। সেটা স্বর্ণলতার হাব। সাধারণত অন্য কোথাও স্বর্ণলতা পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, কর্ণফুলীর উজানে প্রায় ১০৫ একর জায়গা জুড়ে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ার জীববৈচিত্র্যের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ভোরের আলো ফুটতেই পাখির কিচিরমিচির ও সবুজ গাছ–গাছালিতে ভরা এ চর অন্যরকম প্রশান্তি জোগায়। বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) ২০২২ সালে তাদের একটি গবেষণায় চর বাকলিয়ার উদ্ভিদবৈচিত্র্য তুলে ধরে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় চর বাকলিয়ায় মোট ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করে। যার মধ্যে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ২০ প্রজাতির বিরুৎ, ৫৭ প্রজাতির গুল্ম, ১২ প্রজাতির লতানো উদ্ভিদ ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সংখ্যা ছিল ২টি। ১৫৫টি উদ্ভিদের ভিতর ১১৩টি ঔষধি গাছ বিদ্যমান।
তিনি বলেন, চরে গাছপালার মধ্যে পাহাড়ি শিমুল, বেগুনি হুরহুরি, প্রাজাসেন্ট্রা, হরগোজা, ভূঁই উকড়া, ঝুমকো লতা, আকন্দ, স্বর্ণলতা, ঘাগড়া, শিয়াল কাঁটা, শিরীষসহ নানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এছাড়া দেশীয় আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ নানা রকমের ফলদ গাছও আছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের এ শিক্ষক মনে করেন, চরের আশেপাশের স্থানীয়রা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এইসব ঔষধি গাছের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। কারণ দিন দিন লোকালয় থেকে অনেক উদ্ভিদই হারিয়ে যাচ্ছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই চরের গাছপালাকে বাড়তে দিলে এ চর ঔষধি গাছের সুবিশাল উৎসে রূপান্তরিত হবে। ঔষধি গাছসহ এ চরের দুর্লভ সমস্ত উদ্ভিদরাজিকে রক্ষা অতীব জরুরি। নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা এই চরের গাছপালার উপর পশু–পাখি অনেকটা নির্ভরশীল তাদের খাবারের জন্য। প্রাকৃতিকভাবে জেগে ওঠা সবুজে ঘেরা এ চরের অবস্থান মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের বিরুদ্ধে নদীকে বাঁচাতে দৃশ্যমান এক সংকেত, বিধাতা প্রদত্ত প্রকৃতির প্রতিবাদের উপমা। চর বাকলিয়া যেন প্রাকৃতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নানাবিধ ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং সেই সাথে নদীর মাঝখানে সবুজে ঘেরা এ চরকে হত্যা করে ডাম্পিং স্টেশন তৈরির চিন্তা করা প্রাণ–প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
উল্লেখ্য, শাহ আমানত সেতু থেকে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার উজানে নদীর মাঝখানে চর বাকলিয়া। ১৯৩০ সালে অর্থাৎ কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে পলি জমে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই চর জেগে ওঠে। চরের মোট আয়তন প্রায় ১০৫ একর বলে স্থানীয়দের ধারণা। বর্তমানে চরটি সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানে ভুক্ত।