বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

নিত্যপণ্যের বাজারে অসহায় মধ্য আয়ের মানুষ

নিত্যপণ্যের বাজারে অসহায় মধ্য আয়ের মানুষ
print news

ট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটে মাছের দাম দেখে বেড়াচ্ছেন মধ্যবয়সী এক নারী। ৭-৮টি দোকানে রুই, কাতলা, পাবদাসহ বিভিন্ন জাতের মাছের দাম জানতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু এক দোকানে গিয়ে তিনি কিনেন পাঙাশ মাছ। তাও কেজি ২২০ টাকা দামে।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরের ঘটনা এটি। মাছের দোকানের সামনে কথা হয় এই নারী ক্রেতার সঙ্গে। তার নাম বিপাশা দত্ত। চাকরি করেন চট্টগ্রামের চকবাজারে একটি বেসরকারি বাংকে। চার সদস্য নিয়ে থাকেন বহদ্দারহাট নতুন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।

এ নারী বলেন, বিগত ৮-১০ বছর আগে ব্যাংকে যে বেতন ছিল, বর্তমানেও একই বেতন। দিন দিন খরচ বাড়লেও বাড়েনি কোন আয়। খরচ বাড়ায় বাসার একটি রুম এখন সাবলেট দিয়েছি। মাসে যে বেতন পায়, তার অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি অর্ধেক খরচ হয় গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলে। বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিয়ে বাজার থেকে যে ভালো খাবার কিনবো তার কোন উপায় নেই। সব মিলিয়ে মাসের শেষ সপ্তাহে হতাশা বেড়ে যায়।

একই বাজারে কথা হয় ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকার শিক্ষিক আবদুর রউফের সাথে। তিনি বলেন, নব্বই দশকের শেষেও বেতন যা পেতাম তা দিয়ে মোটামুটি পরিবার চালানো যেত। এখন তো আয় বাড়েনি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে এখন কোনভাবে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এবারে ঈদে বাচ্চাদের পোষাক কিনে দিলেও আমরা পুরোনো কাপড় দিয়েই ঈদ পালন করেছি। আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষ এখন খুবই অসহায়। মাসের শেষে আর্থিক টানাপোড়েনে থাকি। মাসের বাজার চাল, ডাল, মরিচ কেনার পর, সাপ্তাহিক কাঁচাবাজার করতে বহদ্দারহাটে আসি। মাছ ও গরুর মাংস দূরের কথা, এখন ব্রয়লার মুরগীও আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষদের নাগালের বাইরে।

একই বাজারে মাংসের দোকানে কথা হয় হামজারবাগ লেইনের বাসিন্দা আফছারুল আমিনের সঙ্গে। তিনি একটি এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সামান্য বেতনের চাকরি করি। যা বেতন পায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠছে। স্ত্রীকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেয়াসহ সাংসারিক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কোনো চাকরি করতে পারে না। তবে সে অনলাইনে কিছু ব্যবসা শুরু করেছে। সেখান থেকে অল্পকিছু আয় হয়। এভাবেই কোনমতে টেনেটুনে সংসার নিয়ে চলছি।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

এ কর্মকর্তা আরও বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারের অবস্থা এমন থাকলে পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। অসৎপথে তো আয় করতে পারছি না। নিজেরও তেমন জমা নেই। এখন মাসের শেষে এসে দেখি কয়েকটা দোকানে ঋণের বোঝা! নিজেকে বর্তমান অবস্থায় বেশ অসহায় মনে হচ্ছে।

নগরীর চকবাজার মোড়ে কথা হয় সিএনজি অটোরিক্সা চালক মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে বাকলিয়া কালামিয়া বাজারের একটি বস্তিতে থাকেন। তিনি বলেন, এলাকায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করেছিলাম। এখন কাজ নেই, তাই চট্টগ্রামমুখী হয়েছি। বস্তিতে একটা রুমে একা থাকি। মেয়ের বিয়ের জন্য ঋণ হয়েছে ২ লাখ টাকা। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে কিস্তির টাকা পাঠাতে হয়। এখানে এখন এক প্লেট ভাত ১৫ টাকা। হোটেলে সামান্য সবজি দিয়ে খাবার খেলে বিল আসে ১০০ টাকার উপরে। অটোরিকশা চালিয়ে যা পাই তাতে কুলায় না। গরমে কারও থেকে ১০ টাকা ভাড়া বাড়তি চাইলেও দেয় না। অটোরিকশার দৈনিক জমা ও ঘর ভাড়া দিয়ে হাতে তেমন টাকা থাকে না।

শুধু অটোরিকশা চালক, শিক্ষক বা ব্যাংক কর্মকর্তা নয়, আরো অনেকের সাথে কথা হলে তারা নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। নিজেদের মধ্য আয়ের মানুষ হিসেবে দাবি করে তারা জানান, খরচের সঙ্গে আয়ের ভারসাম্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসার সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

মঙ্গলবার সকালে নগরীর কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা। আটা-ময়দার দামও বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা। পর্যাপ্ত যোগান থাকার পরও ডালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা। এছাড়া আদা, রসুন, পেঁয়াজের বাজার রয়েছে স্থিতিশীল।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

বাজার ঘুরে দেখা যায়, নাজির ও মিনিকেট মানের সরু চালে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৭৬ টাকা, পাইজাম ও লতা মানের মাঝারি চাল ৫৩ থেকে ৫৮ টাকা আর স্বর্ণা, চায়না ও ইরি মানের মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। যা গত সপ্তাহে কম ছিল প্রায় ৫ টাকার নিচে।

চালের পাশাপাশি খোলা ময়দা ও আটার দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা। গত সপ্তাহে যে খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় তা মঙ্গলবার সকালে বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। আর যে মানের খোলা আটা বিক্রি হয়েছিল ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় তা এখন ৪৭ থেকে ৪৫ টাকায়।

চাল, ময়দা ও আটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে সকল ধরনের ডালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা। বাজারে ডালের মধ্যে মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা যা গত সপ্তাহে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। আর বড় দানার মশুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা যা গত সপ্তাহে ছিলো ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা। আর ছোট দানার মসুর ডাল ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৫০ টাকা।

এছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে চড়া মসলাজাত পণ্য পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের বাজারেও কোন পরিবর্তন আসেনি। বাজারে দেশি ও আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা। আর আদা ও রসুন ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও সবজির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কমতির দিকে থাকলেও গত এক মাসের ব্যবধানে এ তিনটি পণ্যের দাম বেশ বাড়তি।

গত এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে গত মঙ্গলবার ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা আর সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৩৪০ থেকে ৩৫৫ টাকায়। আর গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকা। তাছাড়া মাসের ব্যবধানে প্রত্যেক শাকসবজির দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ টাকা।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

বাজারে টমেটো, শিম, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, বেগুনসহ প্রায় সকল সবজির দাম ছিলো ৩৫ থেকে ৬০ টাকায়। স্থিতিতে রয়েছে ডিমের দাম। বাজারে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১২৫ টাকায়। মাছের বাজারের কোন সুখবর নেই। বাজারে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার নিচে কোন মাছই মিলছে না।

মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি রুই ও কাতলা ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকা, শিং ও টাকি মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, শোল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, তেলাপিয়া, কই ও পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা, কোরাল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং চিংড়ি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং ছোট ইলিশের কেজি দেড় হাজার টাকারও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মাছের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগরীর ফিশারি ঘাটের আড়তদার আবুল কাসেম বলেন, সাগরে আগের মতো মাছ ধরা পড়ছে না। ফলে বাজারে মাছ সংকট তৈরী হয়েছে। এতে মাছের দাম বেড়েছে।

মুরগির দাম বিষয়ে জানতে চাইলে বহদ্দারহাটের পাইকারি মুরগি বিক্রেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, গরমে মুরগি মারা যাচ্ছে। ফলে মুরগির দাম কমছে না। এমনিতে বাচ্চা সংকটের কারণে মুরগির খামারিরা লোকসানে বলে জানান তিনি।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিন বলেন, ঈদকে ঘিরে কমদামে এলসি করা ভারতীয় ডাল, ছোলা আমদানি পণ্য আসার কথা থাকলেও তা পর্যাপ্ত আসেনি। যার ফলে অনান্য দেশ থেকে মসুর, অ্যাংকর আমদানি করতে হওয়ায় বুকিং রেট বেশি পড়েছে। যার ফলে দাম বেড়েছে।

চালের দাম বাড়ার বিষয়ে পাহাড়তলি বাজারের আবদুল গণি সওদাগর বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে মৌসুমের ধান বের না হওয়ায় উত্তরবঙ্গের চালের উপর বাজার নির্ভরশীল। পরিবহন ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়ায় মিলার পর্যায়ে চালের দাম সাময়িক বেড়েছে। নতুন ধান বের হলে দাম কমে যাবে বলে জানান এ ব্যবসায়ী।

ঈশান/সুম/খউ

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page