সোমবার- ২রা ডিসেম্বর, ২০২৪

হালদার মাছ রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেই

হালদার মাছ রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেই
print news

# যোগাযোগের পর সিসি ক্যামেরা সচল
# ৬ হ্যাচারীর মধ্যে দুটি বিধ্বস্ত

মাছের মা হালদা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একমাত্র প্রাকৃতি মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এই নদীকে সরকার বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করেছে মুজিব বর্ষে। এই নদীর মাছের পোনার চাহিদা সারা দেশ জুড়ে। এখনকার মাছের শাররীক গঠন বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন জেলার মাছ চাষীদের হালদার পোনার আগ্রহ যুগে যুগে।

বিভিন্ন জেলার মানুষ হালদা পাড়ে এসে মাছের মৌসুমী ডিম থেকে উৎপাদিত পোনা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এই নদী থেকে সংগ্রহ করা ডিমে পোনা উৎপাদন করে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মৎস্যজীবি আদিকাল থেকে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

যুগে যুগে হালদা নদী থেকে মাছের ডিম সংগ্রহ করে উপকৃত হয়ে আসা মৎস্যজীবি ও এই নদীর জীববৈচিত্র রক্ষায় অবদান রেখে আসা গবেষকগণের অনেক বছর থেকে অভিযোগ রয়েছে, এই প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের খনিটি রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়ে এখন প্রাণ যায় যায় অবস্থার মধ্যে ঠেকেছে নদীর জীববৈচিত্র।

তারা বলেছেন, দুষণ অবহেলার শিকার বিশেষায়িত নদীটি রক্ষায় গত প্রায় দুই দশকে শুধু পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। এরমধ্যে বেড়েছে নদীতে মাছ চোরের তৎপরতা। মাছ চোর ও যান্ত্রিক নৌকার উৎপাত বন্ধে জেলা পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে গত কয়েক বছর আগে নদী পাড়ে অস্থায়ী একটি নৌপুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করেছে।

নদীর সীমিত এলাকায় মাছ চোরদের তৎপরতা রোধে বসিয়েছিল আটটি সিসি ক্যামরা। মৎস্য বিভাগ প্রায় আড়াই দশক আগে মৌসুমী মাছ ডিম সংগ্রহকারীদের সংগ্রহ করা ডিম থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনে জন্য নদীর দুই পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল ছয়টি হ্যাচারী। প্রশাসন মাছ চোরের উৎপাত বন্ধ ও ডিম সংগ্রহকারীদের সহায়তা হ্যাচারী নির্মাণ করলেও কোনটি ঠেকসই হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, মৎস্য বিভাগের ছয় হ্যাচারীর মধ্যে ২টি প্রায় দেড় যুগ থেকে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। নৌপুলিশের স্থাপন করা সিসি ক্যামরার মধ্যে চারটিই নষ্ট হয়ে পড়েছিল এক বছর ধরে। তবে এই প্রতিবেদকের যোগাযোগের পর নষ্ট সিসি ক্যামেরা নামিয়ে বসানো হয়েছে সচল নতুন সিসি ক্যামেরা।

আরও পড়ুন :  ঋণখেলাপি মামলায় এস আলমের দুই ব্যাংকের শেয়ার ক্রোকের নির্দেশ

হালদার নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৭ মে হালদায় মা মাছ যে পরিমান ডিম দিয়েছে তা পর্যপ্ত ছিল না। সংশ্লিষ্টদের মতে প্রাপ্ত ডিম থেকে পোনা পাওয়া গেছে মাত্র পাঁচ কেজি। সূত্রমতে, যতটুকু ডিম পাওয়া গেছে বলা যায় তা নমুনা ডিমের চাইতে একটু বেশি।

দেখা গেছে নদী পাড়ে এনজিও সংস্থা আইডিএফ হালদা নদীর মাছ রক্ষায় প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। তারা তাদের প্রকল্পের আওতায় নদী পাড়ে স্থাপন করেছে ২০টি সিসি ক্যামরা ও ডিম থেকে পোনা উৎপাদনে ডিম সংগ্রহকারীদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেছে একটি হ্যাচারী।

নদী পাড়ের অনেকেই ক্ষোভ হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, মুজিব বর্ষে এই নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করেছিল সরকার। আশা করা হয়েছিল যুগে যুগে অবহেলার শিকার এই বিশেষায়িত নদীর প্রাণ ফিরে পাবে, নানা অবস্থাপনার দুর করা হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

হতাশাগ্রস্তরা বলেছেন, মানুষ দেখছে মা ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে আগে যেসব অবকাঠামো ছিল তাও একে একে নষ্ট হয়ে পড়েছে। নষ্ট হয়ে থাকা হ্যাচারী ও সিসি ক্যামেরা সচল করার কোনো উদ্যোগ ছিল না। যদিও ১৪ মে মঙ্গলবার নষ্ট সিসি ক্যামেরা সরিয়ে নতুন ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এরপরও নদীর বিশাল এলাকাসহ সংযুক্ত খাল প্রশাসনের নজরদারির বাইরে রয়েছে।

জানা যায়, নৌপুলিশ ক্যাম্পের নজরদারিতে বসানো হয়েছিল আটটি সিসি ক্যামরা। গত বছর থেকে নষ্ট হয়ে পড়েছিল চারটি। এ সুযোগে নদীতে নজরদারি সংকোচিত হয়ে পড়ায় এর সুযোগ হাতছাড়া করেনি লোভী মৎস্যজীবিরা। মা মাছ ডিম দেয়ার এই মৌসুমে অরক্ষিত নদী ও খালে জাল বসিয়ে মাছ মারছে। মৌসুমী ডিম সংগ্রহ ও নদীর পরিস্থিতি দেখতে প্রায় প্রতিদিন নদীতে ভ্রমন করছেন হালদা বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণি বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক হালদা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেছেন, আগামী পূর্ণিমার থিতিতে মা মাছ পূর্ণমাত্রায় ডিম দিতে পারে। পূর্ণিমায় না হলেও পরবর্তী আরো দুটি জো সামনে রয়েছে। শেষ পর্যায়ে মা মাছ পূর্ণমাত্রায় ডিম দিতে পারে। অতীত রেকর্ড এর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, গত বছর শেষ জো’তে মা মাছ প্রচুর ডিম দিয়েছিল। রূপালী সম্পদের এই খনিটি রক্ষায় যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেয়া যায় ততই মঙ্গল বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন :  জামিন পেলেও মুক্তি মিলছে না বাবুল আক্তারের

প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসে মা মাছ ডিম দেয়ার মৌসুম। এই সময়ের মধ্যে নদীতে মা মাছ একাধিক দফায় ডিম দিয়ে থাকে। হালদা রক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিবর্গ বছরের পর বছর এই নদীতে দুষিত বর্জ্য নিক্ষেপ, মা মাছের নিরাপত্তা বিঘ্নিতকারী নৌযান চলাচল বন্ধ ও মাছ শিকারে জাল পাতা, রড়শি ফেলা নিষিদ্ধের দাবিতে বহু বছর থেকে স্বোচ্ছার রয়েছে। পরিবেশবাদী ও হালদার রক্ষার আন্দোলনে থাকা সর্বস্তরের মানুষের আন্দেলনের মাঝে প্রশাসনের টনক নড়ে।

সর্বশেষ গত প্রায় দুবছর আগে আন্দোলনকারীদের এই দাবির যুক্তিকতার মধ্যে প্রশাসন পরিবেশবাদী, নদী গবেষণায় থাকা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করে কিছু পদক্ষেপ নেয়। এসব পদক্ষেপের ফলে নদীতে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধ হয়। দুষিত বর্জ্য নিক্ষেপ কমে আসে। তবে নদীতে জাল পাতা বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়েও মা মাছ চোরদের তৎপরতা বন্ধে এখনো হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে।

এমন পরিস্থিতিতে নদীতে নজরদারি বাড়িয়ে মাছ চোরদের সনাক্ত করতে ২০২১ সালে নদীর পাড়ে বসানো হয় সিসি ক্যামরা। সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ নদীর হাটহাজারী অংশের রামদাস হাট এলাকায় বসায় আটটি ক্যামরা। এসব ক্যমরার নিয়ন্ত্রন নৌপুলিশের রামদাস হাট অস্থায়ী ক্যাম্প পুলিশের হাতে। তারা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকায় নজরদারি করছিল আটটি শক্তিশালী সিসি ক্যামরার মাধ্যমে।

একই লক্ষ্য নিয়ে নদীর পাড়ে ১২টি সিসি ক্যামরা লাগিয়েছেন এনজিও সংস্থা আইডিএফ। তাদের স্থাপন করা ক্যামরা গুলো সক্রিয় থাকলেও ক্যামরার আওতার বাইরে রয়েছে নদীর বিশাল অংশসহ সংযুক্ত কয়েকটি খাল।

আরও পড়ুন :  শান্তিচুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে অশান্তি, চুক্তির মুলে নোবেল পুরুস্কারের লোভ

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মা মাছ ডিম দেয়ার এই মৌসুমে নদী ও খালের বিভিন্নস্থানে বেড়েছে মাছ চোরদের উৎপাত। অপরদিকে দেখা যায় মাছের ডিম থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য নদীর দুই পাড়ে (হাটহাজারী ও রাউজান) মৎস্য বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হ্যাচারী রয়েছে ৬টি। হাটহাজারী অংশের মদুনাঘাট, শাহমাদারী ও মাছুয়াঘোনায় থাকা তিনটি হ্যাচারী মোটামোটি ডিম ফুটানো উপযোগি থাকলেও রাউজানের পশ্চিম গহিরা সিপাহীঘাট ও কাগতিয়ার হ্যাচারী দুটি প্রায় এক যুগ থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই উপজেলার একমাত্র মোবারকখীল হ্যাচারীটি তালি জোড়া দিয়ে চালানো হচ্ছে।

এ ব্যাপারে কথা বললে চট্টগ্রাম ক্যান্টেমেন্ট স্কুল কলেজের শিক্ষক হালদা বিশেষজ্ঞ ড. শফিকুল ইসলাম বলেন গত বছর সংগ্রহকারীরা প্রচুর ডিম সংগ্রহ করলে হ্যাচারী গুলোর অব্যবস্থাপনায় স্থান সংকুলন করতে না পেরে অনেক ডিম নষ্ট করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নদী পাড়ে হ্যাচারী সংখ্যা বাড়ানো ও নষ্ট হয়ে থাকা হ্যাচারী চালু করার উদ্যোগ নেয়া। নদীতে মা চোরদের উৎপাত বন্ধে নদী পাড়ে আরো সিসি ক্যামরা লাগানো ও নষ্ট হয়ে থাকা ক্যমরা গুলো দ্রুত সছল করার পক্ষেও অভিমত দেন এই বিশেষজ্ঞ।

হালদা পাড়ের নৌ পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মাহফুজুল হাসান বলেছেন, আমাদের আটটি ক্যামরার মধ্যে চারটি নষ্ট হয়ে পড়েছিল প্রকৃতিক দুর্যোগের কারণে। বাজেট না থাকায় ক্যামরা স্থাপন করা হয়েছিল নড়বড়ে বাঁশের খুটিতে। বজ্রপাত ও বাতাসে চারটি ক্যামরা নষ্ট হয়েছে। তবে এখন সবগুলো ক্যামেরা সচল করা হয়েছে।

তিনি জানান গত এপ্রিলে নৌ পুলিশ অভিযান চালিয়ে নদীতে মাছ চোরদের পেতে রাখা ১৭ হাজার মিটার জাল জব্দ করেছে। অরক্ষিত এলাকায় মা চোরের তৎপরতা প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের একটি মাত্র স্পীড বোর্ড রয়েছে তাদের। পর্যপ্ত সংখ্যক জনবল ও জ্বালানী পাওয়া যায়নি। একারণে অরক্ষিত এলাকায় নজরদারি করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ঈশান/খম/সুপ

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page