বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ স¤পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এর কাছে রাজস্ব বাবদ ৩৫ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে এনবিআর। যা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসআরও শর্ত প্রতিপালন, অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণ, গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের ওপর ভ্যাট ও স¤পূরক শুল্ক পরিশোধ না করা, গ্রাহক থেকে ভ্যাট আদায় করে পরিশোধ না করা, ভর্তুকি মূল্যের ওপর ভ্যাট পরিশোধ না করা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে জেট ফুয়েল সরবরাহকে রপ্তানি হিসেবে গণ্য না করা, আয়কর অধ্যাদেশের ৮২সি ধারা বিতর্কসহ মামলা জটিলতায় এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ স¤পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বছরের পর বছর পেট্রোবাংলা ও বিপিসির কাছে আটকে থাকা ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া রাজস্ব আদায়ে তিন চেয়ারম্যানকে নিয়ে বৈঠক করেছেন অর্থ সচিব এবং জ্বালানি ও খনিজ স¤পদ বিভাগের সচিব। বৈঠকে ৩০ জুনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
গত সোমবার (২০ সে) আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এ বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম পেট্রোবাংলা ও বিপিসির কাছে বকেয়া রাজস্ব কত সময় থেকে পাওনা রয়েছে জানিয়ে তা চলতি অর্থবছরে পরিশোধের অনুরোধ জানান। কতবার এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দেওয়া হয়েছে, তাও তিনি উল্লেখ করেন।
বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের শুল্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে কোন কোন খাতে রাজস্ব বকেয়া রয়েছে, তা তুলে ধরেন। তবে এনবিআরের দাবি করা রাজস্বের পরিমাণের সঙ্গে দ্বিমত করেন পেট্রোবাংলা ও বিপিসির চেয়ারম্যান। তারা এসব বকেয়ায় কিছু ছাড় পাবেন বলেন জানান। ফলে বকেয়ার পরিমাণ কমবে বলেও দাবি করেন। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের সঙ্গে আবারও হিসাব করা প্রয়োজন বলেও জানান তারা।
বৈঠকে আগামী অর্থবছরে জ্বালানি খাতের ভর্তুকির পরিমাণ নিয়েও আলোচনা হয়। এ ছাড়া আসছে বাজেটে জ্বালানি খাতের শুল্ক কর ও ভ্যাট নির্ধারণের বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত থাকা এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব দাবি করা হয়েছে তা বিপিসি ও পেট্রোবাংলার হিসাবের চাইতে কিছু বেশি। অর্থবছরের শেষ সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি আছে। এনবিআর সরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখন দেখা যাক কতটা আদায় হয়। বছরের পর বছর এ বকেয়া আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান দুটি বিভিন্ন অজুহাতে বকেয়া পরিশোধ করছে না।
বৈঠকে উত্থাপিত এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, পেট্রোবাংলা হাইকোর্টে রিট করলে আদালত এনবিআরের পক্ষে রায় দেন। পরে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সভায় বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে এই রাজস্ব পরিশোধের সিদ্ধান্ত হলেও এখনো পরিশোধ করা হয়নি। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহকের কাছ থেকে ভ্যাট ও স¤পূরক শুল্ক হিসেবে ১৫ হাজার ৬৯৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আদায় করেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বিধিবহির্ভূতভাবে সমন্বয় করা ১ হাজার ৭৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা কর বাতিল করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই দুটি খাতে পাওনা হিসেবে ১৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ২৩ লাখ বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হলেও এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
বৈঠকের সার সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ স¤পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্য খাত থেকে রাজস্ব আদায় করে এনবিআরের কাছে জমা দিয়ে থাকে। এর পরিমাণ মোট রাজস্ব আদায়ের প্রায় ১০ শতাংশ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ভ্যাট ও স¤পূরক শুল্ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
বকেয়ার বাকিটা আয়কর ও শুল্ক। এসআরও শর্ত প্রতিপালন, অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণ, গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের ওপর ভ্যাট ও স¤পূরক শুল্ক পরিশোধ না করা, গ্রাহক থেকে ভ্যাট আদায় করে পরিশোধ না করা, ভর্তুকি মূল্যের ওপর ভ্যাট পরিশোধ না করা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে জেট ফুয়েল সরবরাহকে রপ্তানি হিসেবে গণ্য না করা, আয়কর অধ্যাদেশের ৮২সি ধারা বিতর্কসহ মামলা জটিলতায় এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া।
২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে মোট পাওনা ২১ হাজার ৮০১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৭ কোটি আট ৮ টাকা। রেয়াত গ্রহণের শর্ত পালন না করায় পেট্রোবাংলার কাছে পাওনা হয়।
২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি করা এলএনজি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ এবং সুনির্দিষ্ট কর আরোপিত পণ্যে রেয়াত গ্রহণের সুযোগ না থাকায় ২ হাজার ১৯৪ কোটি ১২ লাখ টাকা ভ্যাট পাওনা রয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের ওপর অপরিশোধিত ভ্যাট ও স¤পূরক শুল্ক হিসেবে পাওনা হয় ১ হাজার ৮২৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা।