বৃহস্পতিবার- ১০ই অক্টোবর, ২০২৪

চট্টগ্রামে আবাসনের কোপে সাবাড় হচ্ছে পাহাড়!

চট্টগ্রামে আবাসনের কোপে সাবাড় হচ্ছে পাহাড়!
print news

ট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির টেক্সটাইল মোড় থেকে কিছুটা দক্ষিণে গেলেই চন্দ্রনগর আবাসিক এলাকা। সেই আবাসিকের পাশ দিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে কিশোয়ান গলি। সেই গলির শেষ প্রান্তে রয়েছে এক পাহাড়, স্থানীয়ভাবে যা পরিচিত নাগিন পাহাড় হিসেবে। এই পাহাড়ের পূর্বপাশের পুরো ঢাল কেটে ফেলা হয়েছে খাড়াভাবে।

পাহাড়ের পাদদেশে কিছুটা জায়গা বাড়ির আঙিনার মতো। বছর দশেক আগেও ওই পুরো অংশে পাহাড় ছিল বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা হাশেম। কারা, কীভাবে পাহাড় কাটছে- এমন প্রশ্নে হাশেম যেন মুখে কুলুপ আঁটেন।

একপর্যায়ে শুধু বলেন, কখনও এক্সকাভেটর দিয়ে, কখনও ওপর থেকে কিছু অংশ কেটে মাটির চাক ফেলে পাহাড়গুলো কাটা হয়। তবে কারা কাটে এই বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। এলাকারই আরেকজন বলে ওঠেন এটা তো গ্রিনভ্যালি হাউজিং-২ এর অধীনে। হাউজিংয়ের সভাপতি আজম উদ্দিন সাহেব, সেক্রেটারি দিদারুল আলম। তাদের আন্ডারেই কাটা হচ্ছে। এটা তো সহজ কথা।

নাগিন পাহাড়ের ঢালের পাশ ঘেঁষে উত্তর দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে। ওই রাস্তাটাও পাহাড় কেটে বানানো। সেই পথ ধরে কিছুটা এগোলে দেখা মেলে আরেকটি টিলার মতো জায়গার। সেটি যে মেশিন দিয়ে কেটে সমান করা হয়েছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কেটে সমান করা পাহাড়ের ওই অংশটার আশপাশে টিনের কয়েকটি ঘরের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে।

ওই ঘরের বাসিন্দা বিউটি বেগম সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর এখন পাশেই আরেকটি ভাড়াঘরে থাকেন। বিউটি বেগমের আদি নিবাস নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায়। নদীভাঙনে সব হারিয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। স্বামী একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। পাহাড় কেটে বানানো ওই প্লটে ঘর করে থাকতেন তিনি। জায়গা দেখাশোনার পাশাপাশি প্লটে সামান্য চাষাবাদও করতেন বিউটি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ অনেক বছর ধরেই ওই এলাকায় পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে হাউজিং সোসাইটি। শুধু গ্রিনভ্যালি নয়, আশপাশের বেশিরভাগ হাউজিং সোসাইটি একই কায়দায় গড়া। প্রথমে পাহাড় কেটে সমান করে প্লট বানিয়ে সেখানে বিউটি বেগমের মতো জলবায়ু উদ্বাস্তু কিংবা ভূমিহীনদের থাকতে দেওয়া হয়। পরে সেসব জায়গা বিক্রি করা হয় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকায়। একেকটি প্লটের আয়তন তিন কাঠার মতো।

জানা যায়, গত সংসদ নির্বাচনের সময় বেশ কয়েকদিন ধরে দিনে-রাতে পাহাড় কাটা চলতে থাকে। এসব ঘটনা জানুয়ারির শেষদিকে নজরে আসে পরিবেশ অধিদপ্তরের। জানুয়ারিতে একটি ও গত মাসে আরও একটি মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। দুটি মামলার আসামি হলেন স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১৮ জন।

মামলার এজাহারভুক্ত দুই আওয়ামী লীগ নেতা হলেন মো. শামসুদ্দিন ও মো. বাহার উদ্দিন। বলা হচ্ছে, তাদের নেতৃত্বেই নাগিন পাহাড় কাটা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাহারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালেও পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলা হয়। ২০২১ সালে চন্দ্রনগর এলাকায় পাহাড় কাটার অপরাধে শামসুদ্দিন ও বাহারকে ৬ লাখ টাকা করে জরিমানাও করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এদের মধ্যে বাহার উদ্দিন জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শামসুদ্দিন সাংগঠনিক সম্পাদক।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘পাহাড় কেটে কোনো স্থাপনা করিনি। আমার যে ঘর ছিল, সেটি সমতলে। তারপরও পরিবেশ অধিদপ্তর আমার স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ৬ লাখ টাকা জরিমানাও করে। অধিদপ্তরের লোকজন এসে হুটহাট মামলা দিয়ে যায়, কারও কথা শোনে না। এ কারণে আসামি হয়েছি। আমি আসলে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।’

বিভিন্ন সময় মামলা করলেও বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে পাহাড় কাটা রোধ করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন মামলার বাদী পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মনির হোসেন। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। অনেকদিন ধরেই ওই এলাকায় পাহাড় কাটছে কিন্তু বিদ্যমান আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর খুঁজে তারা ঠিকই বের হয়ে যাচ্ছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘নাগিন পাহাড় কাটার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিরা আসামি। মামলা করেও তাদের থামানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত মাসেও একটি মামলা হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল এই মামলার শুনানি ছিল, কিন্তু অভিযুক্তরা কেউ আসেননি। আগের মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি।

শুধৃু নাগিন পাহাড় নয়, চট্টগ্রামের সবকটি পাহাড় এভাবে সাবাড় হচ্ছে আবাসনের কোপে। পাহাড় কাটার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এপিক প্রপার্টিজ, স্যানমার প্রপার্টিজ, সিপিডিএলসহ বহু আবাসন প্রতিষ্ঠান। এমনকি চউক ও চসিক কাউন্সিলররাও পাহাড় কাটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোন রকম আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কোনকালেও। ফলে একের পর এক সাবাড় হচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড়।

স্থানীয়দের বর্ণনামতে, নগরীর চকবাজার থানার চট্টগ্রাম কলেজ রোড সংলগ্ন পার্সিভ্যাল হিল কেটে ১২ তলা ভবন তৈরী করেছে এপিক প্রপার্টিজ। ভবনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘এপিক ভূঁইয়া এম্পেরিয়াম’। এভাবে পাহাড় কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ করায় আবাসন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদফতর। মামলাটি এখনও আদালতে বিচারাধীন। এরই মধ্যে গোপনে নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে তারা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর পার্সিভ্যাল হিল নামের পাহাড়টি কাটার দায়ে এপিক প্রপার্টিজকে ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদফতর। ২০২১ সালের ১৭ জুলাই পাহাড় কাটার সময় এপিক প্রপার্টিজের চার শ্রমিককে আটক করে পুলিশ। আটক শ্রমিকরা এপিক ভূঁইয়া এম্পেরিয়াম ভবনের নির্মাণকাজে নিয়োজিত ছিলেন। তখন তাদের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় মামলা করা হয়। পরে পার্সিভ্যাল হিল কেটে এপিক প্রপার্টিজের বহুতল ভবন নির্মাণ মামলার তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষে পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেন।

মামলার এহাজারভুক্ত আসামিরা হলেন- চকবাজার থানার পার্সিভ্যাল হিল এলাকার মৃত খায়ের উল্লাহ ভূঁইয়ার ছেলে খোরশেদ আলম ভূঁইয়া, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর এলাকার মোহাম্মদ নেছার আলীর ছেলে মো. বকুল আলী, নগরীর চান্দগাঁও থানার হামিদচর এলাকার মো. তাইজ উদ্দিনের ছেলে মো. আশরাফুল ইসলাম মিন্টু, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার তেঁতুলিয়া পূর্বপাড়া এলাকার মো. শহিদুল ইসলাম প্রামাণিকের ছেলে মো. সজীব ইসলাম ও মহাদেবপুর উপজেলার চান্দনাইশ গ্রামের মৃত কলিম উদ্দিনের ছেলে মো. রবিউল।

পাহাড় কেটে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করায় বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ১২, ৪(১), (২) ও ১৫ (১) এর ক্রমিক ১ ও ৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘনের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে চারজনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৭ জুলাই চকবাজার থানার কাশিমবাজার মৌজার বিএস খতিয়ান নং-৪১/৬, বিএস দাগ নং-২৮৮ (অংশ), ২৮৯ (অংশ) ও ২১১(অংশ)-এর পার্সিভ্যাল হিল এলাকায় পাহাড় কাটার স্থান পরিদর্শন করেন পরিবেশ অধিদফতরের পরিদর্শক মনির হোসেন। পাহাড় কাটার সময় চার শ্রমিককে আটক করা হয়। পরে পরিবেশ অধিদফতর মহানগর কার্যালয়ের পরিচালকের নির্দেশে আবারও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পরিদর্শক মনির। ওই সময় তদন্তে দুই হাজার ৪০০ ঘনফুট পাহাড় খোরশেদ আলম ভূঁইয়ার নির্দেশে কাটা হয় বলে প্রমাণ পান পরিদর্শক। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, চকবাজার এলাকার পার্সিভ্যাল হিল ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও অক্সিজেনের আধার। অথচ এসবের ক্ষতি করে পরিবেশ অধিদফতরের শর্ত ভেঙে বহুতল ভবন করছে এপিক প্রপার্টিজ।

চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতের বেঞ্চ সহকারী আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।’

এপিক প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের অভিযোগ আছে। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার লিংক রোডের আরেফিন নগর এলাকায় পাহাড় কেটে ‘এপিক রেডিমিক্স কনক্রিট’ নামে কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে।

মামলার পরও পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের বিষয়ে এপিক প্রপার্টিজের পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, ‘পার্সিভ্যাল হিলের জমিটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। পরিবেশ অধিদফতর মামলা দিয়েছে। আদালতে মামলা বিচারাধীন। আদালত কাজ বন্ধ রাখার কোনও নির্দেশনা দেননি। যার কারণে ভবনের নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছি আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘নগরীতে ভবন নির্মাণের দেখভাল করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সংস্থাটি আমাদের ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। তাদের অনুমোদন নিয়েই আমরা ভবন নির্মাণ করছি।’

অন্যদিকে নগরীর এসএস সাইফুদ্দিন খালেদ সড়কের আসকার দীঘির পাড়ের কাছে গ্রিনল্যাজ পাহাড়ের সামনের পাহাড়টির অনেকখানি কাটা হয়েছে। সেখানে ২২ তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি চেয়েছিলেন ভূমির মালিক। এবিসি টাওয়ার আর মিশন গ্রুপের ভবনের মাঝখানে ১৫ কাঠা পাহাড়ি ভূমিটি গোপনে কেটেছিল মালিকপক্ষ।

২০২০ সালের ১ জুন পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই অভিযানে ভূমির মালিক সনজিত দত্তকে জরিমানা করে। এরপর সড়ক বা আশপাশের এলাকা থেকে যাতে ওই পাহাড়ি ভূমি দেখা না যায়, সে জন্য সড়কের পাশে উঁচু করে টিনের ঘেরা দেওয়া হয়। এখন সেখানে ভবন তৈরির কাজ চলছে। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের টাকায় সিডিএ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পাহাড়ি ভূমিতে আবাসিক ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছেন মালিক। ১৫ তলা ভবনের ছাড়পত্র দিয়েছে বিশেষ কমিটি।

জানা গেছে, সিডিএর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ওই পাহাড়ি ভূমিতে ভবন নির্মাণের অনুমোদনের সুযোগ নেই। তবে ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’ চাইলেই অনুমোদন দিতে পারে। সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্রসহ চারটি শর্তে নগর কমিটি ছাড়পত্র দিয়েছে। পরিবেশ রক্ষা করে ভবন নির্মাণের শর্তে ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর; এরপর বিশেষ কমিটি ছাড়পত্র দেয়। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি এবং নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ১৫ তলার বেশি অনুমোদন পাবে না।

নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন আরেফিননগর বাজারে বাইপাস রোডের দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড় কেটে ২৬ তলা ভবন নির্মাণ করছে স্যানমার প্রপার্টিজ। প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে মহানগর সমিতির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে। প্রকল্পের প্ল্যান দেখিয়ে ২০১৬ সালে প্রতি বর্গফুট কমপক্ষে ৬ হাজার টাকা মূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করে স্যানমার প্রপার্টিজ। গ্রাহকদেরও রাখা হয় অন্ধকারে। তবে পাহাড় কাটা নিয়ে স্থানীয়রা আপত্তি তোলার পরই শুরু হয় বিপত্তি। পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরে আসে বিষয়টি। এরপর সেখানে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার সত্যতা পাওয়া যায়। বর্তমানে স্যানমার প্রপার্টিজের ‘স্যানমার গ্রিন পার্ক’ শীর্ষক প্রকল্পের স্থানে পাহাড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও স্যানমার প্রপার্টিজ এরই মধ্যে প্রকল্পটির বেশির ভাগ ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে।

স্যানমার প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের এটিই একমাত্র অভিযোগ নয়। উত্তর খুলশী থানার ইম্পেরিয়াল হিলের ১০৯/সি নং প্লটের ৪ নম্বর রোডে ছয়তলার অনুমতি নিয়ে ১২ তলা ভবন নির্মাণেরও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এ প্রকল্পেও ফ্ল্যাট কেনাবেচা চলমান রয়েছে। খুলশীর স্থানীয় ১১ জন বাসিন্দার পক্ষে এ নিয়ে স্যানমারের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন আলম।

মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, স্যানমার গ্রানডি নামের উঁচু ভবনটি নির্মাণ করতে গিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ৬০ ফুট পাহাড় কেটেছে স্যানমার। ওই স্থানে এখন আর পাহাড়ের চিহ্ন নেই। ভবনটি তৈরি করতে গিয়ে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর ১২ ধারা এবং সিডিএ আইন ২০১৮-এর ৪৪ ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে যান চলাচলের জন্য প্রশস্ত কোনো সড়কও নেই। ফলে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ড বা বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে উদ্ধার তৎপরতা চালানোও বেশ দুষ্কর হয়ে পড়বে।

এছাড়া নগরীর ষোলশহরে ডানকান হিলের পাদদেশে মাটি কেটে উঁচু ভবন নির্মাণেরও পরিকল্পনা নিয়েছিল স্যানমার। স্থানীয় ২৪ বাসিন্দা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে স্যানমারের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ আনার পর বেকায়দায় পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্প এলাকায় এরই মধ্যে অসংখ্য গাছ কেটে ফেলার অভিযোগও উঠেছে।

প্রকল্পটির ব্যাপারে সিডিএর বক্তব্য হলো ২০১৩ সালে ডানকান হিলে ২৫ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে অনুমোদনের তিন বছরেও কাজ শুরু না হওয়ায় সেটি বাতিল হয়ে যায়। পরে আর অনুমোদন দেয়া হয়নি। ডানকান হিল এলাকায় পাহাড় ও গাছ কাটা এবং বহুতল ভবন নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

স্যানমার প্রপার্টিজের অপারেশনাল ডিরেক্টর এহসানুল বারী বলেন, স্যানমার গ্রিন পার্ক প্রকল্পে বেজমেন্টসহ কাজ করতে গিয়ে পাহাড়ের হয়তো কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এখানে এক হাজার বর্গফুটের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি আছে। আমরা সেটা মেনেও নিয়েছি। আর স্যানমার গ্রানডি নামের প্রকল্পে সিডিএ যেভাবে অনুমোদন দিয়েছে, তার বাইরে কিছু করছি না। এছাড়া ষোলশহর বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডানকান হিলের প্রকল্পটি আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এটা নিয়ে এখনই কিছু বলার মতো নেই।

এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে রূপনগর আবাসিক এলাকা। এখানে দুটি স্থানে পাহাড় কাটা হয়েছে। আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ নাছিয়া ঘোনা ১ নম্বর ঝিলে পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে গাউসিয়া লেকসিটি নিউ আবাসিক এলাকা। এখানে অভিযান চালাতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন।

অন্যদিকে পরীর পাহাড়ে আইনজীবী সমিতির পাঁচ ভবনের নকশা কী করে অনুমোদন দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছে গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর দেয়া উক্ত চিঠিতে পরীর পাহাড় থেকে সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যাপারে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের উদ্যোগের কথাও উল্লেখ করা হয়। একই চিঠিতে জমির স্বত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে নকশা অনুমোদনের ক্ষমতা কোন সংস্থার নেই বলেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।

পাহাড়ে শুধু ভবন অনুমোদন দেওয়া হয়, ১৫টি পাহাড় কেটে নগরের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কটি নির্মাণ করে সিডিএ। এই পাহাড় কাটার জন্য সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ২০১৫-১৬ সালে এই সড়ক নির্মাণ শুরু হয়।

পাহাড় কাটা বন্ধ করতে না পারা ও বসতি বেড়ে যাওয়ার দায় জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নিতে হবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীদূষণ হলে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যাবে। কিন্তু পাহাড় ধ্বংস করা হলে কেউ বানাতে পারবে না। কিন্তু চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক হারে পাহাড় কাটা ও বসতি দুটোই বাড়ছে।

একটি গবেষণার বরাত দিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘২০০৮ সাল পর্যন্ত ছোট-বড় ১২০টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু পাঁচলাইশ এলাকায় ৭৪ শতাংশ পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। আকবরশাহ এলাকায় একজন জনপ্রতিনিধি (জহুরুল আলম ওরফে জসিম) নির্বিচারে পাহাড় কেটে যাচ্ছে। আশা করি মেয়র মহোদয় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।’

গত ১১ জুন চট্টগ্রামের একটি হোটেলে নগরের পাহাড় কাটা রোধে এক মতবিনিময় সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক অভিযোগ করেন, এমন কিছু পাহাড় রয়েছে, যেখানে সিডিএ ভবন তৈরির নকশা অনুমোদন করেছে। এ কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাহাড় রক্ষার মামলা বা উদ্যোগ হালকা হয়ে যায়।

অভিযোগের জবাবে তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম বলেন, তিনটি কমিটির মাধ্যমে নকশা অনুমোদন দেয় সিডিএ। এর মধ্যে অথরাইজেশন কমিটি একটি। এরপর কিছুটা জটিল হলে তা বিশেষ কমিটির কাছে যায়। যেগুলো ঝামেলাপূর্ণ, সেগুলো অনুমোদনের জন্য নগর উন্নয়ন কমিটিতে যায়। তবে জনবলের অভাবে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়।

বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বান্দরবান-রাঙামাটির পাহাড় অনেক উঁচু। সেখানে পাহাড়ের ওপর রাস্তা হয়েছে। এখানে তো অত উঁচু ছিল না। তাহলে কেন আমরা চিন্তা করলাম না। ব্যক্তির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে আমরা পাহাড় কেটে রাস্তা করেছি। আমরা একটা পাহাড় নির্মাণ করতে পারব না।’

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত কোনো প্রভাবশালীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে, আমি তাঁকে বাঁচাতে চাই, এই চিন্তা বাদ দিতে হবে। পাহাড় কাটার ব্যাপারে যদি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেখানে সবার আগে আমি থাকব। তবে সব দপ্তরের প্রধানদের নিয়ে এই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আজকের সভায় সব দপ্তরের প্রধানেরা এলে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। প্রতিনিধি দিয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।’

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দিয়ে কখনো প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করা যাবে না। সম্প্রতি চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। সরকার পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করে বলে জানায়, কিন্তু সরকার নিজে যখন পাহাড় কাটে, তখন মানুষ আর সরকারি সংস্থার ওপর ভরসা রাখতে পারে না।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page