মঙ্গলবার- ১২ই নভেম্বর, ২০২৪

আয়ের চেয়ে ব্যয় তিনগুণ বেশি

লাভের মুখ দেখছে না ‘কর্ণফুলী টানেল’ প্রকল্প

আয়ের চেয়ে ব্যয় তিনগুণ বেশি লাভের মুখ দেখছে না ‘কর্ণফুলী টানেল’ প্রকল্প
print news

য়ের চেয়ে ব্যয় প্রায় তিন গুণ বেশি। ফলে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। কাঙ্খিত গাড়ি চলাচলের অভাবে গত এক বছরেও লাভের মুখ দেখেনি প্রতিষ্ঠানটি। লাভের মুখ দেখতে পরিসংখ্যান অনুযায়ী আরও এক বছর সময় হাতে থাকলেও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই প্রতিষ্ঠান আদৌ লাভের মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় টানেলে যান চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। প্রাক্কলন অনুযায়ী, টানেলে শুরু থেকে দৈনিক ২০ হাজার ৭১৯টি গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যা ২০২৫ সাল নাগাদ ২৮ হাজার ৩০৫টি ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৭ হাজার ৯৪৬টি যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল।

কিন্তু চালুর প্রায় এক বছরের এই টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার যানবাহন চলাচল করছে। তাই বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে ৫ হাজার গাড়িও চলাচল করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদও একই অবস্থা বিরাজ করবে। এতে এই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখবে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আজ সোমবার (২৮ অক্টোবর) টানেল উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হলো। তবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক নতুন শহর তৈরির স্বপ্ন নিয়ে টানেলটি নির্মাণ হলেও উদ্বোধনের একবছর পর সে স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে বড় কোনো শিল্পায়ন না হওয়া, চায়না ইকোনমিক জোনের ভবিষ্যৎ ঝুলে থাকা, কর্ণফুলী সেতুর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি টোল নির্ধারণ, থ্রি হুইলার চলাচলের অনুমতি না থাকাসহ নানা কারণে টানেলে কাঙ্খিত গাড়ি চলাচল করছে না। এতে টানেলে যে পরিমাণ অর্থ আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা খরচ পোষাতেও পারছে না টানেল কর্তৃপক্ষ।

টানেলের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেলটি উদ্বোধনের পরদিন যানবাহন চলাচল শুরু হয়। উদ্বোধনের পর থেকে গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এক বছরের গাড়ি চলাচল ও আয় ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ। এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। যার মধ্যে মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি। বাসের পরিমাণ ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ শতাংশ। আর অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম।

টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে তিন হাজার ৯১০টি। তা থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেল থেকে টোল বাবদ আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। কিন্তু মাটির তলদেশে নির্মিত টানেল হওয়ায় প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ একটা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেলটির এসব ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

এখানে আয় ব্যয়ের হিসাব যদি করা হয় তাতে দেখা যাচ্ছে, সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা খরচ করে তার বিপরীতে আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এই বিশাল একটি প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার হাজার টাকারও বেশি।

অন্যদিকে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, টানেলের প্রভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে সেভাবে আলো ফেলতে পারেনি এটি। উল্টো আগের অর্থবছরের তুলনায় সর্বশেষ অর্থবছরে চট্টগ্রামে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য বিডায় নিবন্ধন নিয়েছে। অথচ এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার ৭২৬ কোটি টাকার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে এ অঞ্চলে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৭৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা বা ৩৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

প্রায় দশ হাজার সাতশো কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প কেন এত লোকসান গুনছে তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। এর কারণ খুঁজতে গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শনে এসেছেন।

টানেলের টুলের দায়িত্বরত কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, টানেলের লোকসানের মুখে গত শনিবার যোগাযোগ সচিব সরেজমিনে পরিদর্শনে এসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী ছয় মাসের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে টানেলের রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আয় বাড়াতে কার, মাইক্রোবাসের টোল কমানো, একই সাথে থ্রি হুইলার চালানো যায় কিনা তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা করছে।

টানেলকে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ বিলাসী, এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন বলে মন্তব্য করে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, কাল্পনিক সমীক্ষার ভিত্তিতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, যার নিষ্ফল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে। ওয়ান সিটি টু টাউন করার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে অথচ কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর মাধ্যমেই ওয়ান সিটি টু টাউন বাস্তবায়ন হয়েছে। যে পরিমাণ অর্থ টানেলে ব্যয় করা হয়েছে সে অর্থ দিয়ে তিনটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করা যেত।

টানেলের পরিকল্পনাবিদদের জ্ঞানহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধরনের একটি পরিকল্পনা করতে হলে যথেষ্ট জ্ঞানের প্রয়োজন, আবেগ দিয়ে পরিকল্পনা হয় না, এটা এখন ঋণ করে মিষ্টি খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের জন্য ঋণ দিয়েছে তারাও এর দায় এড়াতে পারেন না।

তিনি আরও বলেন, আগে শিল্পায়ন করে পরে প্রয়োজন হলে টানেল কিংবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো, অথচ এখন উন্নয়নের আগেই প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যেটা সবার ঘাড়ে বোঝা হিসেবে ভর করেছে।

ঈশান/মখ/সুম

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page