বৃহস্পতিবার- ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪

চট্টগ্রামে মিলছে বৈশাখি মেলা, হচ্ছে ঐতিহ্যের বলী খেলা

print news

চট্টগ্রাম ব্যুরো :
বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ ও শেকড়ের বৈশাখি মেলা শুরু হচ্ছে ২৩ এপ্রিল রবিবার। আর ২৫ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলী খেলা। মেলা এবং খেলার প্রস্তুতি পর্বে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান ঘিরে ছড়াচ্ছে রং।

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের এই বৈশাখি মেলায় লালদীঘির মাঠ ঘিরে প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে বসেছে নানা পণ্যের মেলা। যা তত্ত্ববধানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখি মেলা কমিটি।

কমিটির সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ বলেন, চট্টগ্রামে জব্বারের বলীখেলা যেমন শত বছরের ঐতিহ্য বহন করছে, তেমনি রং ছড়াচ্ছে বৈশাখি মেলাও। নগরায়ণের থাবায় লোকজ আচার-অনুষ্ঠান যখন হ্রাস পাচ্ছে সেখানে জব্বারের বলীখেলা বিলুপ্তির হাত থেকে নিজেকে এখনও রক্ষা করে জৌলুস ধরে রেখেছে।

শত বছর পার করা এই মেলা বাঙালির জীবনের বর্ণিল প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে। খেলাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মেলা নিয়ে মানুষের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস এখনো এতটুকু কমেনি। বাংলাদেশে এ মেলা এখন চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের মেলা ও মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই সবাই অপেক্ষা করে ঐতিহ্যের বলীখেলা ও মেলার জন্য।

তিনি বলেন, বলীখেলার ১১৪তম আসর এটি। আগামী ১২ বৈশাখ, ২৫ এপ্রিল বুধবার লালদীঘি মাঠে অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা। প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করবেন নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও প্রধান অতিথি থাকবেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

তিনি আরও বলেন, লালদীঘি মাঠে ইতোমধ্যে বাঁশ ও বালি দিয়ে বলী খেলার মঞ্চ (রিং) তৈরি করা হয়েছে। ২৬ এপ্রিল হবে চাঁটগাইয়া ঈদ উৎসব। এদিকে বুধবার (১৯ এপ্রিল) বলী খেলার মাঠ পরিদর্শনসহ ট্রফি, জার্সি ও থিম সং উন্মোচন করেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, সাধারণ স¤পাদক শওকত আনোয়ার বাদল, ফিরিঙ্গি বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিল হাসান মুরাদ বিপ্লব এবং সংগীত শিল্পী আলাউদ্দিন তাহের প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন :  রাঙ্গুনিয়ার পোল শিক্ষিকা মালেকা দু‘বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীর স. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে!

Ctg Boishakhi mela 20.4 5ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এ প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এ প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রতি বছর ১২ বৈশাখ নগরের লালদীঘি মাঠে এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় বলী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বলীখেলা নামে পরিচিতি।

ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির এবং একইসঙ্গে বাঙালি যুব সমপ্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই আবদুল জব্বার সওদাগর এই বলীখেলার প্রবর্তন করেন।

ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার সওদাগরকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামিদামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন বলে জানা যায়। দেশ বিভাগের পূর্বে একবার এক ইংরেজ গভর্নর সস্ত্রীক আবদুল জব্বারের বলী খেলা দেখতে এসেছিলেন বলে জানা যায়।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

১৯৬২ সালে দুজন ফরাসি মল্লবীর আবদুল জব্বারের বলীখেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশ ফিল্ম বিভাগ একবার ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবে জব্বারের বলী খেলার ছবি ধারণ করেছিলেন, যা লন্ডনের ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে বলে কথিত আছে।

তবে এখন পেশাদার বলীর খুবই অভাব। প্রতিবছরই ঘুরে ফিরে সেই পুরনো মুখ। সে কারণে বলীখেলার আকর্ষণ কিছুটা কমলেও বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। বলীখেলাকে ঘিরে তিনদিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘি ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে। বলীখেলা ও মেলার আয়োজনকে সুশৃঙ্খল রাখতে প্রতিবছরই সিএমপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

Ctg Boishakhi mela 20.4 4জব্বারের বলীখেলা ও মেলাকে ঘিরে নগরজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। নগরবাসীর মনে দেখা দেয় বাড়তি আনন্দ। দূর-দূরান্ত থেকে বলীখেলা দেখতে ও মেলায় ঘুরতে আসে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও বয়সের মানুষ। তীব্র গরম ও ভিড় উপক্ষো করে সকলেই ঘুরে বেড়ায় মেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। তবে মহিলারা ঐতিহ্যের বলীখেলা উপভোগ করা থেকে প্রতিবছরই বঞ্চিত হন। কারণ মহিলাদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা থাকে না।

নগরীর আন্দরকিল্লা, বক্সিরহাট, লালদীঘি পাড়, কেসিদে রোড, সিনেমা প্যালেস, শহীদ মিনার সড়ক, কোতোয়ালী মোড়, জেল রোডসহ প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে এ মেলার বিস্তৃতি ঘটে। উক্ত সড়কগুলোতে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে তিনদিনের জন্য। যাতায়াত ব্যবস্থায় জনসাধারণের সাময়িক দুর্ভোগ হলেও এই বলীখেলার উৎসবে এসে সবকিছুই ভুলে যান এক নিমিষেই। কারণ এই মেলা হাজার বছরের বাঙালির লোকসংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয় বারবার।

আরও পড়ুন :  রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিসিও অফিসের ঘুষের কবলে আউটসোর্সিং শ্রমিকরা

বিভিন্ন জেলা-উপজেলার গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে বিভিন্ন পসরা নিয়ে মেলার এক-দুইদিন আগে চলে আসেন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যবসায়ীরা। তারা সড়কের দু‘পাশ জুড়ে চৌকি বসিয়ে আবার কেউ মাটিতে চট দিয়ে অবস্থান নেন। থাকা-খাওয়া সবই একসাথে। অনেকে নির্ঘুম রাত কাটান।

এ মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। চট্টগ্রাম ও আশ-পাশের এলাকার কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সাংসারিক নিত্য ব্যবহার্য ও গৃহস্থালী পণ্যের প্রতিবছরের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে এই মেলা। তাই গৃহিণীদের পছন্দের তালিকায় থাকে এই মেলার পণ্য সামগ্রী।

কী নেই মেলায়-হাতপাখা, শীতল পাটি, ঝাড়ু, মাটির কলস, মাটির ব্যাংক, রঙিন চুড়ি, ফিতা, হাতর কাঁকন, বাচ্চাদের খেলনা, ঢাক-ঢোল, মাটি ও কাঠের পুতুল, বাঁশি, তৈজসপত্র, আসন, চৌকি, খাট, আলমারি, ফুলদানি, তালপাখা, টব, হাড়ি-পাতিল, দা-ছুরি, কুলা-চালুন, টুকড়ি, পলো, বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা, মুড়ি, মুড়কি, লাড্ডু, জিলাপি আরো কত কি। তবে মেলায় সবচেয়ে বেশি থাকে ঝাড়ুর চাহিদা। কয়েক লক্ষ টাকার ঝাড়ু বিক্রি হয় প্রতি বছরের মেলায়। এরপরেই থাকে হাতপাখার চাহিদা।

চাহিদার সবকিছুই পাওয়া যায় এই মেলায়। তাই চট্টগ্রামবাসীরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। সবাই অপেক্ষায় থাকে প্রতি বছরের দিনটির জন্য। দীর্ঘ অপেক্ষার পর নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সববয়সের মানুষ ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠে এ মেলা। তখন মেলা পরিণত হয় মিলনমেলায়।

ডিআই/খম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page