চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী মো. জাহেদুল আলম চৌধুরী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থেকে কমিশন হিসেবে হাতিয়ে নিচ্ছেন বরাদ্দকৃত অর্থ। অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে বিগত ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত এই প্রকৌশলী এখনো সক্রিয় থেকে গোপনে নানা প্রকল্পে লুটপাট করছেন দুর্বার গতিতে।
এমন অভিযোগ স্থানীয় ছাত্র জনতা ও উন্নয়ন কাজে জড়িত ঠিকাদারদের। দুদক ও বিভাগীয় অডিট কার্যক্রম চালালে এই অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলেও সংশ্লিষ্টদের অভিমত। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময় ধরে এই প্রকৌশলী কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও স্কুল ভবন নির্মাণে নানা অনিয়ম করে আসছে।
এর মধ্যে কাজ শেষ না হলেও চূড়ান্ত বিল প্রদান, অতিরিক্ত বিল দেওয়া, কাজ শুরু না হতে বিল দেওয়া, আরএফকিউ নামে প্রকল্প দেখিয়ে অবৈধভাবে কাজ করা, রাজস্বের কোটি কোটি টাকা আরএফকিউসহ বিভিন্ন অনিয়ম অন্যতম। এছাড়া অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তিনি নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করতে সহযোগিতা করেছেন কতিপয় ঠিকাদারদের।
এমনকি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নানা রাস্তাঘাটের প্রকল্পের কাজ তিনি এখনো আওয়ামী, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়ে গোপনে করিয়ে নিচ্ছেন। দিচ্ছেন বিলও। চরলক্ষ্যা, জুলধা ও শিকলবাহায় এমন একাধিক প্রকল্প এখনো চলমান বলে ছাত্র ঠিকাদারদের অভিযোগ।
জানা গেছে, এই প্রকৌশলী দুই সহকারি মিলে সরকারি উন্নয়নমূলক নানা প্রকল্পে গোপনে পছন্দনীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদারদের কাজ ভাগ বন্টন করে দিয়ে ভূয়া বিল ভাউচার তৈরি করে সরকারি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী’র সাথে এই তিনজনের এতটাই সখ্যতা, যে শত অনিয়ম করলেও কোন জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ তোলার সাহস পায়নি। তারা যেটা বলেছেন সেটাই সফল করেছেন। ফলে গত ৮ বছরে অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা কোন সন্তোষজনক প্রকল্পের দেখা পায়নি একই সিন্ডিকেটের কারণে।
সূত্রের দাবি, এই এলজিইডি প্রকৌশলী জাহেদুল আলম কর্ণফুলী উপজেলায় যোগদানের পর থেকে অতীত রেকর্ড ভেঙে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। তার হাল আমলের গত ১৯ মাস ও বিগত অর্থ বছরের পিআইসি ও আরএফকিউ প্রকল্প তালিকা যাচাই-বাছাই করলে সব দুর্নীতি অনিয়ম পরিলক্ষিত হবে। পাশাপাশি এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বদলি চেয়েছেন কর্ণফুলীর অধিকাংশ সাধারণ জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও ছাত্র জনতা।
যদিও উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী কর্ণফুলীতে যোগদানের দেড় বছরের অধিক সময় হলেও বাকি দুই কার্য সহকারি জসিম ও নাছির একই উপজেলা কর্ণফুলীতে বিগত ৬ বছর যাবৎ কর্মরত রয়েছেন। এরা উপজেলা চেয়ারম্যানের সহযোগি হিসেবে প্রকল্পে লুটপাটের নেপথ্য নায়ক ছিলেন বিগত বছরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার এক কর্মকর্তা জানান, ‘ক্ষমতার দাপটে উপজেলা চেয়ারম্যান সব অপকর্মকে নির্বিঘ্ন করতে কলকাঠি নাড়তেন। ভুমিমন্ত্রীর ভয় দেখাতেন। তার কাজে সায় দিতেন উপজেলা ও জেলা প্রকৌশলীরা। এসব কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ৫ থেকে ১০ ভাগ প্রকৌশলীদের কাছে পৌছে যেত।
ওই কর্মকর্তার তথ্যমতে, ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৩৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার ১৮টি প্রকল্প নামে বেনামে বিলিয়েছেন। অথচ প্রকল্পগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে প্রকল্প কাজের অর্থ তোলা হয়েছে গত ২৪ জুন। উন্নয়নের নামে করা এসব পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি ) প্রকল্পগুলো ক্রস চেক করে পুনরায় স্বচ্ছ ভাবে কাজ করার দাবি জানিয়েছেন কর্ণফুলীবাসী।
এছাড়াও জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা থোক বরাদ্দের আওতায় রাস্তা, ড্রেন নির্মাণ ও সংস্কারের বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকার কাজ দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে গোপনে ভাগাভাগি করে দিয়েছিলেন উপজেলা প্রকৌশলী জাহেদুল। ১০ প্রকল্পে পুরো ৫০ লাখ টাকাই দুই ঠিকাদারের লাইসেন্সে দিয়ে মোটা অঙ্কের সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এমনকি গত ১১জুন একই অর্থ বছরে আসা সাবেক সংসদ সদস্যের নামে উপজেলা উন্নয়ন সহায়তা থোক বরাদ্দের ২৫ লাখ টাকা তিন প্রকল্পের নাম দিয়ে সড়কের কাজ না করেও প্রকল্প সম্পন্ন দেখিয়ে গত ২৪ জুন ২৫ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। দুদক অভিযান চালিয়ে গত ৮ বছরের অডিট প্রতিবেদন চাইলে ভয়ঙ্কর তথ্য উদঘাটন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সূত্র আরও জানায়, উপজেলার খোয়াজনগরের ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঠিকাদার কাজ করলেও এই এলজিডি কর্মকর্তা ছিলেন নীরব। এছাড়াও গত বছরে ইউজিডিপি (জাইকা প্রকল্প) অর্থায়নে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন নির্মাণে গত ২০২০ সালে আসা ৪০ লাখ টাকা ও সম্প্রতি ইউএনও বাসভবনের প্রাক্কলনসহ আনুমানিক ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে। তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতেও মুখ খুলছে না এলজিইডি প্রকৌশলী ও কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে জানতে কর্ণফুলী উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. জাহেদুল আলম চৌধুরী’র মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘যদি কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন যথাযথভাবে না হয় তাহলে বিধি মোতাবেক অবশ্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম এলজিইডি অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাসান আলী বলেন, ‘এ ধরনের কোন লিখিত কোন অভিযোগ পাইনি। তবুও খোঁজ খবর নিয়ে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেবো।’
দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মালেক বলেন, ‘উপজেলার যেকোন সরকারি প্রকল্পে লুটপাট ও সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি করলে যে কেউ দুদকে লিখিত অভিযোগ দিতে পারে। দুদক তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেবেন।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় এলজিইডি কার্যালয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব ও অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু জাফর মো. তৌফিক হাসান বলেন, ‘বিষয়টির খোঁজ খবর নিয়ে কোন অনিয়ম থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’