দেশের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত রেলওয়ে। প্রতিষ্ঠানটির অপ্রতিরোধ্য দূর্নীতি ঠেকাতে শীর্ষ তিন পদে চুক্তিভিত্তিক চার সেনা কর্মকর্তা নিয়োগের তোড়জোর চলছে। এমন খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন রেলওয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ ঠেকাতে ফুঁসে উঠছেন তারা।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) পদে সেনা নিয়োগ ঠেকাতে দপ্তরের সামনের সড়কে ইতিমধ্যে মানববন্ধন কর্মসূচি করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। যেখানে সেনা কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা ভাবনা থেকে সরে না আসলে সচল রেলওয়েকে অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা।
রেলওয়ে শ্রমিক ঐক্য জোটের ব্যানারে বৃহ¯পতিবার (২১ নভেম্বর) এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আমিরুজ্জামান নামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক কর্মকর্তা। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ে, শ্রমিক ঐক্য জোটের মুখপাত্র এডভোকেট এম আর মঞ্জু।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মো. জিয়াউর রহমান, তামান্না বিনতে আজাদ, আনিসুর রহমান, শাহাদাত হোসেন, লোকমান হাকিম অলিউল হাসান, আবু তালেব, উম্মে কুলসুম, নুর জাহান, আয়শা সিদ্দিকা ও মাহাবুব প্রমুখ। প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) দপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি মানববন্ধনে অংশ নেন। এই কর্মসূচির নেপথ্যে ছিলেন সিসিএস দপ্তরের এসিওএস মুহাম্মদ শরীফ উদ্দিন।
তিনি এই দপ্তরে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। রেলওয়ের প্রধান কার্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা ও রেলপথ মন্ত্রনালয়ে এক য্গ্মু সচিব, এমনকি রাষ্ট্রপতি সাহাব উদ্দিন চুপ্পুর নিকটাত্নীয় পরিচয়ে সিসিএস দপ্তরে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাবে দপ্তরের বিভিন্ন কাজে নানা অনিয়মের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য ও ঘুষ-দূর্নীাতির সাথে তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, রেলওয়ের দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহাপরিচালক (ডিজি), পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম), প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) পদে সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদের কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের চিন্তা ভাবনা চলছে।
এ খবরে এসিওএস মুহাম্মদ শরীফ উদ্দিন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারদের উস্কানি দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেন। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাঝে আতঙ্ক শুরু হয়। এক পর্যায়ে এই চিন্তা-ভাবনা থেকে সরিয়ে আসার দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মানববন্ধন কর্মসুচি পালনে মাঠে নামান তিনি।
ফলে বৃহ¯পতিবার (২১ নভেম্বর) সকালে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন সিসিএস দপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। কর্মসূচিতে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা সেনা নিয়োগের চিন্তা ভাবনা থেকে সরে না আসলে সচল রেলওয়েকে অচল করে দেওয়ার হুমকি দেন।
মানববন্ধনে রেল কর্মকর্তা কর্মচারীরা বলেন, রেলের নির্ধারিত ক্যাডার থেকে মহাপরিচালক, মহাব্যবস্থাপক, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক পদে রেল অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে আসছে। রেলওয়ে একটি টেকনিক্যাল সেক্টর হওয়ায় এ সেক্টরে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছাড়া কারো পক্ষে মহাপরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার ও প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক পদ পরিচালনা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি বাহির থেকে কর্মকর্তা এনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে রেলওয়ে পরিচালনা হবে আত্নঘাতী এবং জনসেবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সিদ্ধান্তের ভাবনা থেকে সরে না এলে, সচল রেল অচলে দায়ভার রেল উপদেষ্টা, সচিব, আমলাদের নিতে হবে। রেলওয়ে ক্যাডারের বাইরে অন্য কাউকে ডিজি, জিএম এবং সিসিএস হিসেবে রেলওয়ে শ্রমিক ঐক্য জোট মেনে নেবে না। প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও হুশিয়ারি দেন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।
চট্টগ্রামে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের মতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা রেলের সার্বিক কাজে ব্যাপক দূর্নীতির সাথে জড়িত। সেনা নিয়োগে কমিশন বাণিজ্য ও লুটপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এমনকি রেলওয়েকে অচল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
সচেতন মহলের ভাষ্য, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রেলওয়ের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত একটি দপ্তর। এই দপ্তরের এসিওএস মুহাম্মদ শরীফ উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারদের অনৈতিক সুবিধা দেন। তাদের নিয়ে তিনি তিনস্তরে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
যাদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে রেলের মালামাল ক্রয়ে ফাইভ পারসেন্ট কমিশনের বিনিময়ে কন্টাক্ট সই, সরঞ্জাম ক্রয়ের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের আড়ালে বিল ভাউচার করে সরকারি অর্থ আত্নসাৎ, স্বজনদের নামে গড়া ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে নিজের হাতে সাপ্লাই কাজ ভাগিয়ে নেওয়া, বিভিন্ন ডিপো থেকে যন্ত্রাংশ চুরি, প্রকৃত ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে মালামাল সরবরাহের সময় মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়সহ সব রকমের অনৈতিক কাজ করে চলেছেন।
এ নিয়ে সিসিএস দপ্তরের প্রকৃত ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা আতঙ্কিত সময় পার করছেন। এমনকি সিসিএস নিয়ন্ত্রক দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রক থেকে শীর্ষ কর্মকর্তারাও সিন্ডিকেটের ভয়ে তটস্থ। শরীফ উদ্দিনের সিন্ডিকেটের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মো. ফরিদ উদ্দিন ইতোমধ্যে ঢাকায় রেল ভবনে বদলি হয়ে গেছেন। আরও কয়েকজন কর্মকর্তা বদলি হওয়ার জন্য তদবির চালাচ্ছেন।
আর এই পরিস্থিতি উত্তরণে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক সেনা কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা ভাবনা করছে। একই সাথে দূর্নীতি রোধে রেলওয়ের মহাপরিচালক ও পূর্বাঞ্চল-পশ্চিসাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক পদেও সেনা কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা ভাবনা করছে রেলওয়ে। এমনটাই জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের শীর্ষ এক কর্মকর্তা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের এসিওএস শরীফ উদ্দিন বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তাছাড়া ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে ছিলাম। সচিব-যুগ্ম সচিব, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি অনেকেই আমার আত্নীয় স্বজন থাকতেই পারে। আর আমি যা করি রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই করি। সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিলে মানববন্ধন কর্মসূচিতে রেলের সবাই জড়িত। আমি কি তাদের বাইরের কেউ। উল্টো এমন প্রশ্ন ছুড়ে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের স¤পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া রেলে অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারি দুর্নীতিগ্রস্ত। বলতে গেলে রেলে কোন ভাল মানুষ নাই। সেটা আমরা এ পর্যন্ত দেখেছি। দূর্নীতি ও চুরি বন্ধে অন্তবর্তীকালীণ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কঠোর পদক্ষেপ না নিলে রেলের দূর্নীতি বন্ধ হবে এমনটা আশা করা যায় না।