চট্টগ্রামের পটিয়া ও বাঁশখালীতে কৃষিজমি ধ্বংস করে অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে কৃষি জমিতে পড়ছে স্কেভেটরের কোপ। জমি অধিগ্রহণ না করেই পটিয়ায় কৃষি জমিতে মাটি ফেলা হলেও বাঁশখালীর পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে জমি মালিককে ম্যানেজ করেই কৃষি জমির মাটি বাঁধে দেয়া হচ্ছে।
এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করলেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল পাউবো। পাউবো প্রকৌশলীদের আস্কারা পেয়ে ফসলি জমি নষ্টে বেপরোয়া ঠিকাদাররাও। অথচ ফসলি জমিতে কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প না নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সে আদেশ না মেনেই যত্রতত্রভাবে ফসলি জমি কেটে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পাউবো।
স্থানীয়রা জানান, পটিয়ায় জলাবদ্ধতা নিরসন ও সেচ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ১৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির ৪৫টি প্যাকেজের মধ্যে ১৪টি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। খাল খনন কাজগুলোই আগেভাগে শেষ করা হচ্ছে। কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনায় প্রকল্পটি নেয়া হলেও খাল খনন কাজের শুরুতেই প্রকল্পের উন্নয়ন চাপে হিমশিম খাচ্ছে কৃষকরা। অর্থাৎ সুফল পাওয়ার আগেই জমি হারাতে হচ্ছে কৃষকদের। ক্ষতিপূরণ কিংবা অধিগ্রহণ না করেই স্কেভেটর দিয়ে কাটা হচ্ছে কৃষিজমির মাটি। এতে ফসলি জমি হারিয়ে ফুঁসছে ভাটিখাইন ইউনিয়নের মাঝেরঘাটার কৃষকরা।
ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক ও কৃষকরা জানান, খাল খননের সময় কৃষকদের জায়গা ২০ থেকে ৩০ফুট ভেতর পর্যন্ত কেটে ফেলছে। পাউবো কর্মকর্তারা নিজেরাই পরিমাপ করার পর সেটি নিশ্চিত হয়েছেন। পরে ভরাট করে দিবেন বলেছেন। কিন্তু কৃষি জমিতো কাটার কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষকদের প্রতিবাদের মুখে পাঁচজন কৃষক ক্ষতিপূরণও পেয়েছে। এমন একজন জমির মালিক আছেন যার ১০টি দাগে প্রায় দশ কানি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খালের আশপাশে জমি নিয়ে বড় আকারে খাল খনন করা হয়েছে। আবার খাল খননের মাটি কৃষি জমিতে ফেলেও অনেক ফসলি জমি নষ্ট করা হয়েছে। এসব জমির মধ্যে অলরেডি ক্ষেত আছে, বাগানও আছে। কৃষকের ক্ষেত ও বাগান প্রকল্পের আওতায় খালে নিয়ে গেছে। পাউবো কর্মকর্তারা পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে এমন ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না কৃষকদের। উল্টো এসব নিয়ে প্রতিবাদ করায় কয়েকজন কৃষকের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয়েছে বলে জানান। যে কারণে কেউ মুখ খুলতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জমির মালিক বলেন, এগুলো নিয়ে অনেক প্রতিবাদ করেছি। প্রতিবাদ করার কারণে পাউবো পরিমাপ করে দিয়েছে। এসময কৃষি জমি নষ্ট করার সত্যতাও মিলেছে। এগুলো নিয়ে এখন লেখালেখি করবেন না। লেখালেখি করলে উনারা আমার বিরুদ্ধে লাগবে। পাউবো কর্মকর্তারাও বলবে সমাধান হওয়ার পর এসব নিয়ে আবার লেখালেখি কেন?
একইভাবে বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের রাতাখোর্দ্দ গ্রামে পাউবোর দেড় কোটি টাকার ব্লক ও মাটির কাজ চলছে। আরাধনা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পেলেও কাজ করছেন অন্য একজন। ভাঙন প্রতিরোধে প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯ হাজার পাথর ব্লক ও ৩৮৯ মিটার মাটির কাজ করা হবে। এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। বাঁধের কাজের জন্য শঙ্খ নদী থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফসলি জমির মাটি কেটে বেড়িবাঁধের কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকার একদিকে কাজ চললেও অল্পদূরেই শঙ্খের ভাঙন অব্যাহত আছে।
সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কেএম সালাউদ্দিন কামাল বলেন, ‘আমি চাইবো আমার এলাকার বেড়িবাঁধের কাজ যাতে মানসম্মত হয়। কোন অনিয়ম হলে সেটি দেখার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের।’
বাঁশখালীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘সাধনপুরে ফসলি জমির মাটি কাটার বিষয়টি আমি জানতাম না। এখনই খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
সাধনপুর এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘ফসলি জমির মাটি নিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। মাছের প্রজেক্ট করার নামে ফসলি জমি নষ্ট করে বাঁধে মাটি বিক্রি করেছে জমির মালিক। চুনতি পুলিশ ফাঁড়ির সামনে লোকাল বালু দিয়ে ব্লক বানানো হচ্ছে। পাউবোর কর্মকর্তারা ব্লক বানানোর সময় না থাকার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ঠিকাদার। শঙ্খ নদী থেকে নিয়মিত বালু তোলা হচ্ছে। ঠিকাদার বাইরের হলেও এই ব্যক্তির সাথে স্থানীয় কিছু লোক যুক্ত আছে। তারা প্রকল্পের কাজ তদারকি না করে উল্টো সুবিধা ভোগ করছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা বলেন, ‘সাধনপুরের রাতাখোর্দ্দ এলাকায় দেড় কোটি টাকার কাজ চলছে। সেখানে ব্লক ও মাটির কাজ হবে। ফসলি জমির মাটি দিচ্ছে বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ব্লক বানানোর সময় আমাদের লোক থাকে। নিয়মমাফিক বালুও দেয়া হচ্ছে। এরপরেও কোন অনিয়ম হচ্ছে কিনা আমরা নজরদারি করবো।’
আরাধনা এন্টারপ্রাইজ নাম প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে কাজ করছেন জানিয়ে ঠিকাদার আবু সাঈদ সুমন বলেন, ‘একজন ব্যক্তি প্রজেক্ট করেছে উনি বললো মাটি আমার কাছ থেকে নিয়ে যান। এগুলো ফসলি জমির মাটি না। প্রজেক্টটা ফসলি জমিতে কিনা জানি না, তবে আগে থেকেই প্রজেক্ট ছিল। মাটি কম কাটছিল। ব্লক বানানোর সময় পাউবোর কর্মকর্তারা থাকে। সিলেটি বালু দিয়ে ব্লক বানানো হচ্ছে। টেস্ট রিপোর্ট ভালো না হলে আমাকে তো বিল দিবে না। এই কাজটি করতে গিয়ে এলাকাবাসী আমাকে অনেক ঝামেলা করছে। চেয়ারম্যান নিজেও কাজটি পেতে চেয়েছিল, উনি না পাওয়ায় আমার সাথে ঝামেলা করছে।’
এর আগে ২০২১ সালে সাতকানিয়ার চরতিতে সাঙ্গু নদী ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় বালু উত্তোলন করে কৃষি জমিতে রাখা নিয়ে কৃষকদের উপর গুলিবর্ষনের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় কৃষি জমিতে বালু স্তুপ করে রাখায় কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে প্রতিবাদ করলে ঠিকাদারের পক্ষের লোকজন কৃষকদের উপর হামলা চালায়।