“রেলে খালাসি পদে ১৯ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক কোটি দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক আহমেদসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়”
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি তিন বছরেও। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে, সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তদন্তে কেন এত সময় লাগছে এরও কোনও সদুত্তর নেই কর্মকর্তাদের।
এ বিষয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর উপপরিচালক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতিকুল আলম বলেন, ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলাটির তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে মামলাটির তদন্তকাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আশা করছি দ্রুত মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলে খালাসি পদে ১৯ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক কোটি দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক আহমেদসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়।
মামলার বাকি আসামিরা হলো পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মিজানুর রহমান, তৎকালীন আরটিএর সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার জোবেদা আক্তার, টিএসও রফিকুল ইসলাম, জিএমের গাড়িচালক হারাদন দত্ত, শাহাজাহানপুর রেলওয়ে স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ সুরাইয়া সুলতানা, স্কুলের অফিস সহকারী আক্তার হোসেন, খালাসি আবুল বাশার খান, প্রধান সহকারী (সিপিও) খোন্দকার সাইফুল ইসলাম মামুন, টিকিট প্রিন্টিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাশ, রেলের ঠিকাদার আমিরুজ্জামান আশীষ ও পারভিন আক্তার।
৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিটির পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে দুই সদস্যের আলাদা মার্কশিট না থাকা, কম্বাইন্ড মার্কশিটে একজনের মূল্যায়ন মার্কশিট বানিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ১৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া, দুজন প্রার্থীকে চার জেলার প্রার্থী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া, বয়স্ক ও জাল সনদধারী লোকদের চাকরি দেওয়ার নামে লাভবান হওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে এই মামলা করা হয়।
সূত্র মতে, ২০২১ সালের ১ এপ্রিল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (সম্প্রতি চাকুরিচ্যুত) মো. শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ খালাসি পদে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, সচিব জোবেদা আক্তার ও সদস্য রফিকুল ইসলাম মামলার অপর আসামি তৎকালীন জিএম সৈয়দ ফারুক আহমদকে ছয় পাতার কার্যবিবরণীতে অনিয়মে নিয়োগ পাওয়াদের নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেন।
কিন্তু নিয়োগ অনুমোদনের জন্য ৪০ দিন সময় নিলেও সৈয়দ ফারুক আহমেদ নিয়োগবিধি মানা হয়েছে কি না যেমন, একজনের দুই চাকরি, এক পরিবারে দুজনের চাকরি, বয়স্ক লোককে চাকরি, এক স্কুল থেকে একাধিকজনকে চাকরি, জাল সনদে চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে কি না, এসব দেখেননি।
এ ছাড়া কোটা মানা হয়েছে কি না, নিয়োগ কমিটির কমপক্ষে চারজনের সুপারিশ নেই কেন, এসবের কিছুই যাচাই করেননি। পরবর্তীতে দুদকের তদন্তেও তিনি এর সদুত্তর দিতে পারেননি। তদন্তে দুদক দেখতে পায়, আসামিরা পরস্পরের সহযোগিতায় ২০১৩ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এসব অপরাধ ঘটান।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, রেলওয়ের জিএমসহ আসামিরা পরস্পরের যোগশাজসে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিয়োগ কমিটির সদস্য এম এ জিন্নাহর মূল্যায়ন নম্বর যোগ না করে, অন্য সদস্য খলিলুর রহমানের স্বাক্ষর না নিয়ে তাদের সুবিধামতো মার্কশিটে নম্বর বসানো হয়।
নিয়োগ পাওয়া এক পরিবারের দুই ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য পাঁচ দিন হওয়া, ১৯ জনকে জাল সনদে চাকরি দেওয়া এবং একজন বয়স্ক প্রার্থীকে জাল সনদে চাকরি দিয়েছেন। রেলের চার কর্মকর্তার এসব অপরাধের পাশাপাশি জিএমের চালক হারাধন দত্ত প্রভাব খাটিয়ে তার আত্মীয়ের বয়স্ক স্ত্রীকে জাল সনদে চাকরি দিয়েছেন।
ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সুরাইয়া সুলতানা জালিয়াতির মাধ্যমে ১২ জনকে অষ্টম শ্রেণির সনদ দেন। তাকে সহযোগিতা করেন বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী আক্তার হোসেন।
খালাসি আবুল বাশার খান তার নিকটাত্মীয় টিকিট প্রিন্টিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাশ ও প্রধান সহকারি (সিপিও) খোন্দকার সাইফুল ইসলাম মামুনের সহযোগিতায় জাল সনদ দিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। আর তাকে সহযোগিতা করায় মৃণাল ও মামুন তারাও একই অপরাধ করেছেন বলে তাদেরও আসামি করা হয় মামলায়।
এ ছাড়া রেলওয়ের ঠিকাদার ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের মালিক আমিরুজ্জামান আশীষ খালাসি পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এস এ পরিবহনের মাধ্যমে ১৩ প্রার্থীর কাছ থেকে ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। একই কায়দায় ঢাকার নাখালপাড়ার পারভীন আক্তার ৯ জনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। মোট আসামিরা এক কোটি দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন এই নিয়োগের মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৪ জুলাই ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের নাম দিয়ে দুই বছর পর সেই নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। এর আগে এ নিয়োগ কমিটিতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানকে। সদস্য সচিব ছিলেন আরটিএর সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার জোবেদা আক্তার। কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন রফিকুল ইসলাম, এম এ জিন্নাহ ও শেখ খলিলুর রহমান।
পরীক্ষার পর পরই কমিটির সদস্য এম এ জিন্নাহ মারা যান এবং শেখ খলিলুর রহমান দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে বদলি হন। কিন্তু তাদের স্থলে কাউকে সংযুক্তি না করেই ২০১৯ সালের ১১ মে ফলাফল ঘোষণা করেন কমিটির বাকি তিন সদস্য। এরপর থেকেই এই নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।