চট্টগ্রামে ভ্যাপসা গরমে হাসফাঁস করছে কর্মজীবী মানুষ। একই অবস্থা পশুকুলেরও। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে হিটস্ট্রোকে মারা গেছে শিশুসহ দু‘জন। মারা গেছে শত শত মুরগিও। গরমের তীব্রতায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে মানুষ ও যানবাহন চলাচল কমে গেছে।
তবে নগরীর হাসপাতালগুলোতে জ্বর, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত মানুষ ভর্তি হচ্ছে। যাদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা বেশি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. মো. শাহেদ উদ্দিন এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া শুরু করেছে কর্মজীবি মানুষ। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে হিটস্ট্রোকে ছয় মাস বয়সী এক শিশুসহ ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। নিহত বৃদ্ধের নাম ছালেহ আহমদ শাহ (৭০)। ছালেহ আহমদের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের উত্তর পরুয়াপাড়া এলাকায়।
ছালেহ আহমদের ছেলে নজরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে তাঁর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর তাকে আনোয়ারা হলি হেলথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আনোয়ারা হলি হেলথের পরিচালক সাইফুল ইসলাম শামীম বলেন, হাসপাতালে আসার আগেই ছালেহ আহমদের মৃত্যু হয়েছে। তিনি হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। এদিকে একই জেলার বোয়ালখালী উপজেলায় সাফা নামের ছয় মাস বয়সী এক কন্যা শিশুর মৃত্যু ঘটে। শুক্রবার বিকেলে উপজেলার পশ্চিম শাকপুরা ২নং ওয়ার্ড আনজিরমারটেক সৈয়দ আলমের নতুন বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। তার বাবার নাম মো. নিজাম উদ্দীন।
নিহতের বাবা নিজাম উদ্দীন বলেন, ভোরে মায়ের বুকের দুধ পান করার কিছুক্ষণ পর সাফা ঘুমিয়ে যায়। সে সময় ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। সকাল সাতটায় মেয়েকে কোলে নেওয়ার পর তার শরীর ঠান্ডা অনুভব হলে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডাক্তার সাবরিনা আকতার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের ধারণা বিদ্যুৎ না থাকায় সে হিট স্ট্রোকে মারা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে হিটস্ট্রোকের রোগী আসার পর ১৩, ১৪, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি দেওয়া হচ্ছে। শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুর পর্যন্ত তিনটি ওয়ার্ডে পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি রয়েছে। যাদের প্রত্যেকে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়।
তিনি বলেন, গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে, যার কারণে মৃত্যুও হতে পারে। এ জন্য তীব্র রোদে পারতপক্ষে বাইরে বের না হওয়া কিংবা বেশিক্ষণ অবস্থান না করাই ভালো। এছাড়া গরমের প্রভাব থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় সূতি কাপড়ের পোশাক পরিধান, তরল জাতীয় খাবার ও ফলমূল খেতে হবে।
এদিকে তীব্র গরমে মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলেও হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। রোদের খরতাপে অতিষ্ঠ হয়ে বারবার পুকুর, ডোবা, খাল, নদীসহ বিভিন্ন জলাধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শরীর ডুবিয়ে একটু স্বস্তি নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরপর ছুটে যাচ্ছে হালকা শীতল পরিবেশের খোঁজে, গাছের ছায়ায়। অনেক প্রাণী আবার গরমে অসহ্য হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পিপাসায় কাতর হয়ে পানির সন্ধানে উড়ছে পাখির দল। এসব কারণে চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন খামার মালিকদের নিতে হচ্ছে বাড়তি যত্ন।
শনিবার চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় দেখা যায়, বাঘ, সিংহ, ভালুক খাঁচার ভেতরে জলাধারে শরীর ডুবিয়ে রেখেছে। সিংহগুলো বারবার পানিতে ডুব দিয়ে খাঁচার ভেতরের অপেক্ষাকৃত ছায়াযুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। একইভাবে বাঘ দ¤পতি তার সন্তানদের নিয়ে পানিতে ডুবে আছে।
চিড়িয়াখানার জলহস্তি দুটি জলাধারে ডুবে আছে, মুখের সামনের অংশ উঁচু করে কিছুক্ষণ পরপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। একই অবস্থা ভালুক ও কুমিরেরও। হরিণের দল গাছের ছায়ায় জড়ো হয়ে আছে। পাখিগুলো পিপাসায় কাতর হয়ে পানি পান করছে। গুইসাপটি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে গরমে। বানর, মুখপোড়া হনুমান, মদনটাক, টিয়া পাখিগুলো নীরব হয়ে আছে। কোনো চঞ্চলতা নেই তাদের মাঝে।
সিভাসু হাসপাতালের পরিচালক এবং ফিজিওলজি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুদ্দিন জানান, গত তিন দিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকায় কয়েকটি পোলট্রি ফার্মে শত শত মুরগির মৃত্যু হয়েছে। ঘটনা তদন্তে গিয়ে দেখা গেছে, সবগুলো মুরগিই হিট স্ট্রোকে মারা গেছে।
সাইফুদ্দিন বলেন, ফার্মের মালিক কিন্তু গরম থেকে মুরগিগুলোকে রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেননি। ফার্মের মুরগিগুলো ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এর বেশি হলে সেগুলো দুর্বল হতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে মারা যায়।
এদিকে চট্টগ্রামের প্রধান আবহাওয়া কার্যালয়ের পূর্বাভাস কর্মকর্তা এম এইচ এম মোছাদ্দেক জানান, গত কয়েকদিনের মতো চট্টগ্রামে শনিবারও ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী পাঁচ দিনের আবহাওয়াতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, তিন দিনের হিট অ্যালার্ট তথা তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই সময়ে ঘর থেকে তেমন বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম মহানগরীতে মানুষ ও যানবাহন চলাচল কমে গেছে। এতে নগরীর কিছুটা ফাঁকা হয়ে পড়েছে। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ৭ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সারা দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাপদাহ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কতা জারির পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি অধিদপ্তরের আওতাধীন সকল সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ২৮ এপ্রিল খুলবে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের ছুটি শেষে ২১ এপ্রিল খোলার কথা ছিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিবাবকরা। এর আগে অভিবাবকদের পক্ষে ৭ দিনের জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে রোদে গেলে হিট স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। সে জন্য মাথায় ছাতা ও পর্যাপ্ত পানীয় জল বা যেকোনো বিশুদ্ধ তরল পান করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা রাখতে হবে, বিশেষ করে যাত্রী ছাউনির পাশে। গণপরিবহণের ছাদ তাপ নিরোধী করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে বিআরটিএ।