বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর নিহতের জেরে টানা চতুর্থ দিনের মতো সড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৃহ¯পতিবার (২৫ এপ্রিল) বিকেল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি বৈঠকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে আজকের মধ্যেই ছেলেদের এবং আগামীকাল সকাল ১০টার মধ্যে মেয়েদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
চুয়েটের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চুয়েটের পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। বৃহ¯পতিবার বিকাল ৫টার মধ্যে ছাত্রদের এবং শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ত্যাগ করতে হবে।
এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ে তালা এবং তাদের কাছে জব্দ থাকা দুটি বাসের একটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।
এর আগে বৃহ¯পতিবার (২৫ এপ্রিল) দুপুর ১টার দিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুরকৌশল ভবন, আর্কিটেকচার ভবন, ক¤িপউটার সায়েন্স ভবন, প্রশাসনিক ভবনেও তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাকবিতন্ডার ঘটনাও ঘটে।
একইসঙ্গে চতুর্থদিনের মতো সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে। ফলে বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, বৃহ¯পতিবার সকাল ৮টা থেকে চতুর্থ দিনের মতো শিক্ষার্থীরা চুয়েট গেটে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে অবস্থান নিয়েছে। এর আগে বুধবার, মঙ্গলবার ও সোমবার বিকেলে একই ভাবে সড়কে অবস্থান নেন তারা। বিক্ষোভে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক ব্যবহারকারী রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাই উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে এ সড়কে যাতায়াতকারীরা।
সোমবার (২২ এপ্রিল) বিকেলে দুই সহপাঠী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক, দুই শিক্ষার্থী হত্যার বিচার দাবি, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা এক শিক্ষকের বহিষ্কারসহ ১০দফা দাবি পেশ করেন। প্লেকার্ডে লিখে শিক্ষার্থীরা তাদের ১০ দফা তুলে ধরেন। এ দাবি মেনে নিতে তারা ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেয়।
তবে ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও দাবি না মানা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ অব্যাহত রাখবে বলে জানায় শিক্ষার্থীরা। এর আগে মঙ্গলবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বিক্ষোভে নেমে পড়ে। এ সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এ সড়কে চলা শাহ আমানত লাইনের একটি গাড়ি। এ ছাড়া ভাঙচুর করা হয় আরও চারটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, চুয়েট গেটের দুই পাশে সড়কে ব্যারিকেড দেওয়ার ফলে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রীরা হেঁটে চুয়েট গেট অতিক্রম করছেন।
দুপুরে শহিদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা পুরকৌশল ভবনে তালা দেয়, এরপর ক¤িপউটার সায়েন্স ভবনে, আর্কিটেক্ট ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাকবিতন্ডা হতেও দেখা যায়। এর আগের দিন সন্ধ্যায় প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয় তারা।
শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন, আমাদের দুই ভাই নিহত হয়েছে। আমরা শান্তি থাকবো কিভাবে। আমাদের একটি দাবিও মেনে নেয়নি প্রশাসন। ফলে আমরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে।
চুয়েটের শিক্ষার্থী মিন্টু আজাদ বলেন, একজন শিক্ষক এ নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছেন ফলে আমরা সুমন দে নামের ওই শিক্ষকেরও বহিষ্কার দাবি করছি।
শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি আমাদের ১০ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের একটি দাবিও মেনে নেওয়ার আশ্বাস পাইনি। ফলে আমাদের আন্দোলন চলছে।
সোমবার (২২ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ-সংলগ্ন চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে শাহ আমানত বাসের ধাক্কায় চুয়েটের শিক্ষার্থী শান্ত সাহা ও তৌফিক হোসেন নিহত ও জাকারিয়া হিমু আহত হন।
শান্ত সাহা পুরকৌশল বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী (আইডি-২০০১১০০)। তিনি নরসিংদীর কাজল সাহার ছেলে। আর তৌফিক হোসেন একই বিভাগের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী (আইডি-২১০১০০৬)। তিনি নোয়াখালীর সুধারামের নিউ কলেজ রোডের মোহাম্মদ দেলোয়ারের ছেলে। আহত জাকারিয়া হিমু ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
এ ঘটনায় জড়িত বাসচালক মো. তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার বাসচালক রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার উত্তর ঘাটচেক এলাকার বাসিন্দা। তিনি শাহ আমানত বাসের চালক ছিলেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জেলা বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় বাসচালক ও সহযোগীকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। মূলত দুর্ঘটনার পরপরই বাসচালক ও সহযোগী পালিয়ে যায়। বুধবার দুপুরে বাসচালককে গ্রেপ্তারের পর তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সাথে চুয়েট কর্তৃপক্ষ, পরিবহন মালিক শ্রমিক প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে নিহতদের পাঁচ লাখ করে ও আহত শিক্ষার্থীকে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম গোলাম মোর্শেদ খানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা ১০ দফা ঘোষণা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তারা নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানায়। বুধবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা ফের বিক্ষোভ শুরু করলে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।