চুনাপাথর নিয়ে দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়া চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। সাথে ফিরছেন জাহাজটির ২৩ নাবিকও। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামি ১২ বা ১৩ মে জাহাজটি কুতুবদিয়ায় পৌঁছাবে।
মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) এ তথ্য জানান কবির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম। তিনি বলেন, মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিকটন চুনাপাথর বোঝাই শেষ হওয়ার পর সোমবার (২৯ এপ্রিল) মধ্যরাতে এমভি আবদুল্লাহ দেশের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা। ১২ বা ১৩ মে জাহাজটি কুতুবদিয়ার কাছাকাছি গভীর সমুদ্রবন্দরে নোঙর করতে পারে। সেখানেই চুনাপাথর খালাস করা হবে। ২৩ জন নাবিক জাহাজেই দেশে ফিরছেন।
এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে কয়লা খালাস করে গত শনিবার সকালে মিনা সাকার বন্দরে যায় এমভি আবদুল্লাহ। সেখান থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন চুনাপাথর লোড করা হয় জাহাজে। তবে কোন আমদানিকারক চুনাপাথরের চালানটি দেশে আনছেন, তা জানা যায়নি।
এদিকে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তির পর নাবিকদের রিসিভ করতে দুবাই ছুটে যান জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাতের নেতৃত্বে একটি দল। সেই দলে রয়েছেন মেহেরুল করিমও।
তিনি বলেন, এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা বর্তমানে খোশমেজাজে রয়েছেন। নাবিকদের স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা ভালো রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের জেটিতে থাকা এমভি আবদুল্লাহ থেকে কয়লা খালাস কার্যক্রম চলার ফাঁকে নাবিকেরা দুবাইয়ের অভিজাত বিপণি কেন্দ্রগুলোয় কেনাকাটা করেছেন। নাবিকেরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কেনাকাটা করেন।
গত শুক্রবার বিকেলে দেশটির আজমান সিটি সেন্টারে জাহাজের চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খানসহ কয়েকজন নাবিক কেনাকাটা করেন। কেনাকাটার এক ফাঁকে নাবিকদের সঙ্গে দেখা হয় দুবাইয়ে কর্মরত চট্টগ্রামের চন্দনাইশের সন্তান সাংবাদিক মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ারের সঙ্গে। মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খানের বাড়িও চন্দনাইশ উপজেলায়। সেই হিসেবে দুইজনকে বেশ উৎফুল্ল দেখা যায়। এ সময় মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ারের মোবাইলে তোলা নাবিকদের কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়।
মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খান বলেন, জাহাজ থেকে নামতে হলে আমিরাত সরকারের অনুমতি লাগে। গত বৃহ¯পতিবার ৩ জন ও শুক্রবার ২০ জন আমরা জাহাজ থেকে নামার অনুমতি পেয়েছি। সেই হিসেবে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভিন্ন মার্কেট থেকে কেনাকাটা করেছি আমরা। অনেকদিন পর যেন মাটির গন্ধ পেলাম আমরা।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ বলেন, জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামিরিয়া বন্দরে ফেরার পর দুই নাবিক বিমানে দেশে ফেরার কথা ছিল। পরে মত পাল্টে অপর ২১ নাবিকের সাথে দেশে ফেরার মত প্রকাশ করেন তারা। ফেরার পথে একটি বন্দর থেকে তেল ও খাবার সংগ্রহ করা হবে। আশা করছি আগামী ১২ বা ১৩ মে দেশে পৌঁছাব। কুতুবদিয়ায় জাহাজের কার্গো খালাস করে চট্টগ্রাম বিচে নোঙর করব। তখন নাবিকরা পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন বা বাড়িতে যাবেন।
গত ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে ৫৮ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে যাওয়ার পথে ১২ মার্চ সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়।
জাহাজটির নাবিকেরা হলেন-জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুরুদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
৩২ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তিপণের বিনিময়ে গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা ৮ মিনিটে জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জলদস্যুরা নেমে যাবার পরই জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রিত উপকূল থেকে সোমালিয়ার সীমানা পার করে দেয়।
জাহাজটি ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে চারটায় আল হামরিয়া বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছে। পরদিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় নোঙর করে জেটিতে। সেখানে ৫৫ হাজার মেট্রিকটন কয়লা খালাসের পর ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সেটি চুনাপাথর বোঝাই করার জন্য মিনা সাকার বন্দরে যায়। পরদিনই জাহাজটি দেশের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা থাকলেও চুনাপাথর বোঝাইয়ে বাড়তি সময় লাগার কারণে সেটি পিছিয়ে যায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কেএসআরএম গ্রুপের এস আর শিপিং লিমিটেডের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তবে এবার মাত্র ৩৩ দিনেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটিকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করা হয়েছে।
কেএসআরএমের তথ্যমতে, এস আর শিপিংয়ের অধীনে মোট ২৪টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয় এমভি আবদুল্লাহ। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক ক্যারিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। ড্রাফট ১১ মিটারের কিছু বেশি। গত বছর জাহাজটি এস আর শিপিং কিনে নেওয়ার আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক। মালিকানা পরিবর্তনের পর জাহাজের নামও পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম রাখা হয় এমভি আবদুল্লাহ।