বুধবার- ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার কোষাগার কার হাতে?

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার আয়ের কোষাগার কার হাতে?
print news

১৯০৯ সাল থেকে চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে শুরু হওয়া ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর গর্বের শেষ নেই। দেশজুড়ে উচ্ছ্বাস! গণমাধ্যমের উত্তাপ- এসব ঘিরে করপোরেট হাউসগুলোর রঙছটা বিজ্ঞাপনসহ আরো কত কী! কিন্তু যাঁদের ঘিরে এত আয়োজন, সেই বলীরা বরাবরই রয়ে যান উপেক্ষিত। তারা কি পান প্রাপ্য সম্মান?

সম্প্রতি বলীখেলার ১১৫তম আয়োজন শেষে এমন প্রশ্ন ওঠেছে বিভিন্ন মহলে। প্রশ্ন উঠেছে এখানে খেলাটি কি মুখ্য, নাকি নেপথ্যে অন্য কিছু? এ নিয়ে ট্রল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

দর্শকরা বলছেন, এবারের আসরে চ্যাম্পিয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল ট্রফিসহ ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকারীরা ট্রফির সঙ্গে পেয়েছেন যথাক্রমে ২০ হাজার, ১০ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। অংশগ্রহণকারী ১০০ জনের মধ্যে ৫০ রাউন্ড খেলা হয়। সেই ৫০ রাউন্ডে বিজয়ীদের দুই হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়। আর পুরস্কারের এই অর্থ কি মানসম্মত।

পাড়ার ছোট ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও যেখানে চ্যাম্পিয়নকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়, সেখানে বলীখেলার মতো ঐতিহ্যবাহী একটি আয়োজনে মাত্র ৩০ হাজার টাকা পুরস্কার খুবই নগণ্য। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়ারও কষ্ট পেতে হয়। যে আয়োজনে চট্টগ্রামের এত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকেন; সেই আয়োজনে পুরস্কারের মানি কীভাবে এত কম হয়—এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।

তবে আয়োজক কমিটির দাবি—প্রাইজমানি এবং আনুসাঙ্গিক খরচের বিষয় পুরোটাই দেখে মরহুম আবদুল জব্বারের পরিবার। তাদের হাতে এ সংক্রান্ত কোনো দায়িত্বই নেই। এছাড়া ব্যবস্থাপনায় যারা থাকেন; তারা চাইলেই খেলোয়াড়দের প্রাইজমানি বাড়াতে পারেন। তবে, বলীখেলার জনপ্রিয়তার তুলনায় প্রাইজমানির পরিমাণ অপ্রতুল—সেটি স্বীকার করেছেন তারাও।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বকশিরহাটের স্থানীয় ধনী বণিক বদরপাতি এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার সওদাগর এই কুস্তি প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। পরে তাঁর নাম অনুসারে এই আয়োজনের নামকরণ হয়েছে। মহামারি করোনায় দুই বছর (২০২০-২০২১) বাদে প্রতিবছরই নগরের লালদিঘী মাঠে আয়োজন হয় এই খেলার। যা এখন দেশের বৃহত্তম বার্ষিক লোক উৎসব হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়।

এবারের ১১৫তম আসরে চ্যাম্পিয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল ট্রফিসহ ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকারীরা ট্রফির সঙ্গে পেয়েছেন যথাক্রমে ২০ হাজার, ১০ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। অংশগ্রহণকারী ১০০ জনের মধ্যে ৫০ রাউন্ড খেলা হয়। সেই ৫০ রাউন্ডে বিজয়ীদের দুই হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালে বলীখেলার ১১৪তম আসরেও চ্যাম্পিয়নকে ক্রেস্ট ও নগদ ৩০ হাজার টাকা এবং রানার্সআপকে ক্রেস্ট ও নগদ ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। এর আগে ২০২২ সালের ১১৩তম আয়োজনে চ্যাম্পিয়নকে ২৫ হাজার টাকা ও ট্রফি; আর রানার্সআপ বলীকে দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। যদিও, ২০১৭ সালে অর্থাৎ ১০৮ তম আসরে এবং তার আগের সব আয়োজনে চ্যাম্পিয়নকে ট্রফি-ক্রেস্টসহ ২০ হাজার টাকা এবং রানার্সআপ বলীকে দেওয়া হতো ১৫ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট।

যা ২০২৩ ও ২০২৪ বেড়ে সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন মানি ৩০ হাজার টাকা করা হয়েছে। কিন্তু ১১৫তম আসরের পর চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপের উপহার হিসেবে দেওয়া এই প্রাইজমানি নিয়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের দর্শকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এত পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী একটি আয়োজনে এই নগণ্য পুরস্কার দেওয়ায় বলীখেলার মতো বড় একটি আয়োজন জৌলুস হারাচ্ছে— এমন দাবি অনেকের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও হচ্ছে এ নিয়ে নানা ট্রল।

প্রাইজমানির সমালোচনা করে কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল বলেন, লজ্জা লাগে আয়োজনকারীদের দেখে। অথচ, এই খেলাকে কেন্দ্র করে যেখানে কোটি টাকার মেলা বসে। আফসোস সেখানে খেলোয়াড়দের কোনো দাম নেই। প্রাইজমানি ৩ লাখ আর ২ লাখ দেয়া যেতো। এখানের হাস্যকর এমাউন্টের প্রতিবাদ স্বরুপ বিখ্যাত সেই দিদার বলী এখন আর অংশ নেন না।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সালাউদ্দিন বলেন, অন্তত এক লাখ টাকাও দিতে পারলো না? যে খেলার জন্য চট্টগ্রাম এই দুদিনে সারাদেশে সুনাম অর্জন করেছে। এখন প্রাইজমানি দেখলে বলবে যে আমাদের পাড়ার খেলাতেও আরো বেশি প্রাইজমানি দেওয়া হয়। এটি হাস্যকর।

আরও পড়ুন :  সেনাবাহিনীকে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত করার প্রত্যয় সেনাপ্রধানের

কুমিল্লার আরেক বাসিন্দা সুমন রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, খেলায় জিতলে প্রাইজমানি যা দেয়, আমাদের কুমিল্লার খেলোয়াড়দের চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া, দুদিন থাকা খাওয়াসহ আরো বেশি খরচ হয়। এত বড় একটা আয়োজনে এই নামমাত্র প্রাইজমানি দিয়ে প্লেয়ারদের হাস্যকর বানানোর দরকার ছিলো না।

খাইরুল আলম তাঁর একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, সারা দেশের সবচেয়ে আইকনিক, উৎসবমুখর, পুরাতন, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলায় চ্যাম্পিয়ন মানি কত জানেন? ৩০ হাজার ট্যাকা। যে স্পন্সরগুলো এই মেলায় থাকে, যে বেচাবিক্রি এই মেলায় হয় ৬-৭ কোটি টাকা খুবই নরমাল ব্যাপার। আর যে ভারী ভারী রাজনীতিবিদরা উপস্থিত থাকে, তাদের গাড়ির ড্রাইভারের বেতনও এর চেয়ে বেশি। লজ্জা শরমও নাই যারা এই টাকা তুলে দেয় তাদের।

বলীখেলার দিন (২৫ এপ্রিল) প্রাইজমানি নিয়ে কথা হয় চারবারের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিচিতি ও আনন্দের জন্যই মূলত বলীখেলা। আমার মনে হয় না, জব্বারের বলীখেলার মতো এত বড় আয়োজন দেশের অন্য কোথাও হয়। সেজন্য আমরাও চাই এই খেলা আরও বড় মাপের এবং বড় মানের হোক। যাতে সারাদেশ থেকে খেলোয়াড়রা এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এখানে অংশ নেয়। তবে এটি ঠিক যে, খেলাটি যত বেশি জনপ্রিয় তার তুলনায় প্রাইজমানিটা খুব কম।

আয়োজক কমিটি ও জব্বারের পরিবারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য:

বলীখেলার আয়োজনে আয়োজক কমিটির সাথে টাকা-পয়সা সংক্রান্ত কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই— এমন দাবি আয়োজক কমিটির। তবে স্পন্সরের টাকার একাংশ রয়্যালিটি (স্বত্ব ভাড়া) হিসেবে আবদুল জব্বারের পরিবারের সদস্যরা পান বলে জানিয়েছেন তারা। যদিও আবদুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদলের দাবি— তারা কোনো রয়্যালিটি পান না।

মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বলেন, ১১৫ বছর ধরে এ আয়োজন হয়ে আসছে। বলীখেলার সব খরচ পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানগুলো দেয়। আমরা শুধু ব্র্যান্ডিংটা ওদের থেকে নেই। আর মাঠের সাজ-সজ্জা, মাইকিং, জার্সি, প্রাইজমানি— এগুলো যারা পৃষ্ঠপোষক তারা দেন। তবে, আমরা এ কমিটিতে থাকলেও আনুষাঙ্গিক সবকিছু দেখভাল অর্থাৎ দায়ভার-ব্যয়ভার এগুলো সব করেন জব্বারের পরিবারের সদস্যরা। তারা প্রতিবারই পৃষ্ঠপোষকদের টাকার একটি অংশ নিজেরা নিয়ে থাকেন রয়্যালিটি হিসেবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু খেলাটাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। তাদের সহযোগিতা করি। তবে, পৃষ্ঠপোষক থেকে শুরু করে টাকা লেনদেন সবকিছু করেন ওনারা (জব্বারের পরিবার)। যারা কমিটিতে আছে; তাদের কোনো অর্থের অংশীদারিত্ব নেই। আগামী বছর মেলা কমিটির বৈঠকে চ্যাম্পিয়ন-রানার্স আপদের প্রাইজমানি আরও বাড়ানো যায় কিনা— সেই বিষয়ে অবশ্যই প্রস্তাব রাখা হবে।

চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপরা প্রাইজমানি ছাড়া কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, তারা প্রাইজমানি ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা পান না। তারা (বলী) মূলত প্রাণের টানে, খেলা উপভোগ করতে আসে; টাকার জন্য আসে না। তারা (বলী) এটাকে উপভোগ করে।’

এদিকে জব্বারের বলীখেলায় অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে বলীরা আসেন চট্টগ্রামে। এরপর আয়োজনে অংশ নেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে লালদিঘী মাহবুব উল আলম চৌধুরী সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির ভবনে দূর থেকে আসা খেলোয়াড়দের জন্য থাকার সুব্যবস্থা করার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি ১১৫তম আসরে।

গত ২৫ এপ্রিল বলীখেলার দিন সরেজমিনে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দেখা যায়, লাইব্রেরি ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষকে বানানো হয়েছে ‘রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক’। সেখানে রাখা ছিল একটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার। সেসব চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় একাধিক বলীকে। দুপুর নাগাদ দূর দূরান্ত থেকে বলীরা এসে বসে থাকলেও তখনও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আসেননি কেউই।

দেখা যায়, অনেক বলী বিরক্ত হচ্ছিলেন এবং খুঁজছিলেন আয়োজন সংশ্লিষ্টদের। এ সময় কথা হয় খাগড়াছড়ির বলী সৃজন চাকমার সাথে। তিনি বলেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি রেজিস্ট্রেশনের জন্য। খাগড়াছড়ি থেকে রওয়ানা দিয়ে সোজা এখানেই এসেছি। এখনো রেস্ট করিনি। কিন্তু এসে কাউকে দেখছি না।’

পাশের চেয়ারেই বসে থাকা সৃজন চাকমার ছোট ভাই সমর বিজয় বলেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে এসে বসে আছি রেজিস্ট্রেশনের জন্য। কিন্তু কারো দেখা পাচ্ছি না। মনে করেছিলাম দ্রুত রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পারলে আমার দাদা রেস্ট করতে পারবেন। ৪টায় খেলা শুরু হবে এখন দুপুর ১২টা বাজতে চললো।’

আরও পড়ুন :  আইনজীবী না থাকায় চিন্ময়ের জামিন শুনানি পিছিয়ে ২ জানুয়ারি

ওই ভবনের ৭ম তলার একটি কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকটি জীর্ণশীর্ণ চৌকি পাতা। যার ওপরে নেই পরিচ্ছন্ন তোষকও। সেখানে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কুমিল্লার হোমনা থানা থেকে আসা চারবারের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল বলী এবং ১১৫তম আসরের চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ। এ সময় অনেককে ফ্লোরে বসেই ঝিমোতে দেখা যায়।

তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, থাকার সুব্যবস্থার কথা বলা হলেও এত দূর থেকে আসা বলীদের বিশ্রামের জন্য নেওয়া হয়নি যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা। ফলে, জীর্ণশীর্ণ এই চৌকিতেই কোনোমতে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে তাদের। এটি আয়োজকদের গাফিলতির ফল— এমন দাবি এসব খেলোয়াড়দের। দূর থেকে আসা খেলোয়াড়দের জন্য এবারের আসরে থাকার সুব্যবস্থা না থাকার কথা স্বীকার করেছেন খোদ আয়োজকরাও।

এ প্রসঙ্গে আয়োজক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, ‘এবার দূর থেকে আসা খেলোয়াড়দের জন্য লালদিঘীর লাইব্রেরিতে থাকার সুব্যবস্থা করার কথা ম্যানেজমেন্টের। এটি আমরা দেখি না। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় যারা ছিলেন তারা সেটি করেননি। এদিক দিয়ে তারা ব্যর্থ। খেলোয়াড়দের বিশ্রামের বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।’

এ প্রসঙ্গে চসিকের সাবেক কাউন্সিলর এবং আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা আয়োজক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, ‘জনপ্রিয়তার হিসেবে খেলোয়াড়দের দেওয়া প্রাইজমানির টাকা পর্যাপ্ত নয়।’

তিনি বলেন, জব্বার সাহেবের পরিবার চাইলে প্রাইজমানি বাড়াতে পারে। তবে বাড়ানো উচিত। তাছাড়া এই আয়োজন এখনো পর্যন্ত একটি গণ্ডির মধ্যে রয়ে গেছে। এই খেলার আয়োজনকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আনা উচিৎ। এবার দর্শকদের আগ্রহের কমতি না থাকলেও ম্যানেজমেন্ট খুবই বাজে ছিল। আসলে এই খেলাকে আরও সমাদৃত করার জন্য আগ্রহ তেমন একটা নেই কারও।

জামাল হোসেন বলেন, বলীখেলার সব খরচ পৃষ্ঠপোষকরাই বহন করে থাকেন। আর খরচের বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই। ম্যানেজমেন্ট এটা যেভাবে পারে খরচ করে। মূলত খেলোয়াড়দের প্রাইজমানি, ডেকোরেশন এবং জব্বার মিয়ার পরিবারকে রয়্যালিটি দেওয়া— এসব খাতে খরচ হয় পৃষ্ঠপোষকদের টাকা।’

তবে, বলীখেলায় পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে রয়্যালিটি নেন না বলে দাবি করে আবদুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমরা কোনো রয়্যালিটি পাই না। তারা (পৃষ্ঠপোষক) তাদের মতো খরচ করে। আমাদের কাছে তাদের কোনো অর্থ আসে না।’

প্রাইজমানি বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, পরিকল্পনা আছে প্রাইজমানি বাড়ানোর। তবে একসঙ্গে বাড়ালে টাকার লোভে খেলোয়াড়রা নিজেদের হাত-পা ভেঙে ফেলবে। আমরা আগামী বছর থেকে ধাপে ধাপে বাড়াবো।’

ঐতিহাসিক এই বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা ঘিরে কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। নেই কিছু লিখিতও। সব হিসাব-নিকাশ যেন অদৃশ্য। সংশ্লিষ্ট সবার কাছেই অজানা। যে যার মতো করেন আয়, আবার খরচও করেন নিজের মতো। এভাবেই চলে আসছে দীর্ঘ বছর।

মেলা ঘিরে চাঁদাবাজি, পণ্যের দামে প্রভাব:

এদিকে প্রতিবছরই বলীখেলাকে ঘিরে বসে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। যে মেলায় লালদিঘী-কোতোয়ালীর আশেপাশের চার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অস্থায়ী দোকান বসান দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ পণ্যের মেলাও এটি। কিন্তু এই মেলা ঘিরে চলে নানা ধরনের টানা চাঁদাবাজি।

অনুসন্ধান বলছে— প্রতি দোকান থেকে ‘ভাগের টাকা’ নেয় পুলিশও। যদিও মেলা শুরুর আগে এবং চলাকালীন সময়ে মাইকে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে কাউকে চাঁদা না দেওয়ার ‘হাঁকডাক’ কানে আসে। কিন্তু দোকানিরা আসা শুরু করতেই পুরোপুরি পাল্টে যায় বাস্তব চিত্র। ফলে, ঐতিহ্যবাহী এই মেলা এবং খেলা— দুটোর আয়োজনই হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ।

এ প্রসঙ্গে আলিম উদ্দিন নামে একজন বলেন, ‘ওরা (টুর্নামেন্ট আয়োজক) চাঁদাবাজি করে। আমরা চাঁদাবাজি করি না। যারা টুর্নামেন্ট দেয় তারা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে টাকা তুলে। আমরা পুরো বৈশাখী মেলা থেকে টাকা তুললে এক লাখ টাকা দিতে পারবো।’

তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার ১১৫তম আয়োজন শেষ হয়েছে এবার। আয়োজন ঘিরে চাঁদাবাজি রুখতে প্রশাসন এবং আয়োজকদের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের ‘আষাঢ়ে গল্প’ শোনালেও চাঁদাবাজি ঠেকানো যায়নি।

আরও পড়ুন :  শান্তিচুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে অশান্তি, চুক্তির মুলে নোবেল পুরুস্কারের লোভ

মেলা শুরুর আগে কোতোয়ালী মোড়, সিনেমা প্যালেস, লালদিঘী ও আন্দরকিল্লাসহ আশেপাশের এলাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে বসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের এই মেলা প্রাঙ্গণে আসা পর্যন্ত কয়েক দফায় চাঁদা দিতে হয় তাদের। পথিমধ্যে চাঁদা দিয়ে এলেও চট্টগ্রাম পৌঁছে পুলিশ ও স্থানীয় কয়েকটি সিন্ডিকেটকে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। অনেকটা হয়রানি এবং নির্যাতনের ভয়ে বাধ্য হয়েই চাঁদা দেন তারা। প্রায়ই অমুক-তমুক ভাইয়ের নাম বলে এসে চাঁদা দাবি করায় কাউকে চিনতেও পারেন না তারা।

জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে রাজশাহী থেকে আসা এক দোকানি বলেন, ‘হঠাৎ জেলা পরিষদের লোক পরিচয় দিয়ে চা-নাস্তার টাকা চায়। আমি বলেছি একটা সিগারেটও খাওয়াবো না। তারা আমার সাথে ধাক্কাধাক্কিও করেছে।’

ফেনী থেকে আসা মো. শাহেদ আকবর বলেন, ‘জেলা পরিষদ মার্কেটের লোক পরিচয় দিয়ে আমাদের এখানে বসিয়ে দিয়েছে। আমার ভাই মূলত দোকানের মালিক তাই কত টাকা দিতে হয়েছে তা বলতে পারবো না। তবে টাকা দিয়েই আমরা বসেছি।

ব্যাপক চাঁদাবাজির ফলে পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব পরে— এমনটা জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। চাঁদাবাজির ফলে উৎপাদন মূল্য এবং যাতায়াত খরচের সাথে পণ্যমূল্যের অন্তত ২০ শতাংশ বাড়তি যোগ করতে হয় ব্যবসায়ীদের।

সুনামগঞ্জ থেকে আসা কুটিরশিল্প সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মো. আয়মান সোহেল বলেন, ‘চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রতিবারই মেলা কমিটির পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। বলে, কেউ চাঁদা নিলে যেন পুলিশকে জানাই। এখন পুলিশই এসে যদি চাঁদা নেয় তাহলে আমরা কীভাবে কাকে জানাবো? কয়েকদিনের জন্য উৎসব করে আমরা কিছু পণ্য বিক্রি করতে আসি। কিন্তু স্থানীয় কয়েকটি সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে দিতে আমরা উৎসবের আনন্দ হারিয়ে ফেলি। আপনারা যাই লিখেন এগুলোর প্রতিকার নেই।’

তিনি বলেন, ‘একটা পণ্য যদি আমি ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে চাই; তবে থাকা খরচ এবং চাঁদার টাকা মিলিয়ে সেই পণ্যের সাথে আরও অন্তত ২০ শতাংশ বাড়তি দাম যোগ করতে হয়। এখন ক্রেতারা সেটা বুঝে না। বলে মেলায় জিনিসের দাম বেশি। দাম তো এসবের কারণেই বাড়ে। এখানে আমাদের তো কিছুই করার নেই আসলে।’

চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি জহর লাল হাজারী বলেন, ‘অনেকে ৫, ১০ হাজার টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে জায়গাগুলো কিনে নেয়। তবে আগে ১শ টাকা নিলেও এখন এক হাজার টাকা, দুই হাজার টাকা নেয়। নগর পুলিশ যদি একটু মানবিক হয়, র‌্যাবকে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। গুটি কয়েক মানুষ; মানে মিনিমাম হাতেগোনা ১০-১৫ জন মানুষ চাঁদার কাজগুলো করে। আমরা যদি তাদের একটু নজরদারিতে রাখি; তাহলে একটা মানুষও এসে টাকা নিতে পারবে না।’

মেলায় চাঁদাবাজির বিষয়ে গত ২২ এপ্রিল নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) আশরাফুল করিম সিভয়েস২৪-কে বলেছিলেন, ‘কে বা কারা চাঁদাবাজি করছে এ বিষয়ে আমাদের তথ্যপ্রমাণ দিলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। মেলায় ব্যবসা করতে আসা সবাই অতিথি। যেহেতু বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার ১১৫তম আসর এটি, তাই চট্টগ্রামের জন্য এটি ব্র্যান্ডিং। এই আয়োজন যেন সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে হয়; সেজন্য আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করার দরকার আমরা করবো।’

তবে সরেজমিন দেখা গেছে, মেলা ঘিরে দফায় দফায় চাঁদাবাজি হয়েছে। এমনকি পুলিশের কিছু সদস্যও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়েছেন চাঁদা। যার তথ্যপ্রমাণ সমৃদ্ধ ভিডিও রয়েছে।

উল্লেখ্য, এবারের ১১৫তম আসরের ফাইনালে লড়াই করেন চারবারের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলীর দুই শিষ্য মোহাম্মদ রাশেদ বলী ও ‘বাঘা’ শরীফ বলী। টানা ১১ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ের পর বাঘা শরীফের হাত উঁচিয়ে তাকে বিজয়ী ঘোষণা দেন রাশেদ বলী। খেলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন খাগড়াছড়ির সৃজন বলী। গতবারও তৃতীয় স্থান দখল করেছিলেন তিনি। চতুর্থ হয়েছেন সীতাকুণ্ডের মো. রাসেল।

খেলা শেষে চ্যাম্পিয়নকে ৩০ হাজার, রানার্সআপকে ২০ হাজার, তৃতীয় বলীকে ১০ হাজার ও চতুর্থ বলীকে ৫ হাজার টাকাসহ ট্রফি তুলে দেন অতিথিরা। পাশাপাশি প্রথম রাউন্ডে বিজয়ী ৩৫ জনের প্রত্যেককে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা করে।   (সিভয়েস থেকে প্রান্ত তথ্যে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে)

ঈশান/মখ/সুপ

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page