আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং হুন্ডিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রাজধানী আবুধাবি, বাণিজ্যিক শহর দুবাই, শারজাহ এবং আজমানে অর্থ পাচার করেছেন বাংলাদেশের শতাধিক ব্যবসায়ী।
প্রাথমিক তদন্ত শেষে এসব ব্যবসায়ীর নামের তালিকা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) টাস্কফোর্স কমিটি। এ তালিকায় আরও আছেন শিল্পী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাবেক ও বর্তমান সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকে।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে আইনের আওতায় আনতে আরও বিস্তারিত তদন্তে নামছে এনবিআরের টাস্কফোর্স কমিটি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, বিশেষভাবে এসব এলাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল শহরে বাংলাদেশ থেকে কে বা কারা অর্থ পাচার করে অবৈধভাবে সম্পদ করেছে বা ব্যবসা করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে অর্থ পাচার এবং পাচারকৃত অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স কমিটি।
এ কমিটির সুপারিশে এনবিআর থেকে এই টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে তদন্তে নেমেছে। এ কমিটিতে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, ট্রান্সফার প্রাইজিং সেলের একাধিক কর্মকর্তা আছেন।
তদন্তের প্রয়োজনে এনবিআরের এ কমিটির সদস্যরা মধ্যপ্রাচ্যের ওই সব শহরেও যাবেন। তদন্তের কাজে যদি প্রয়োজন হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্র, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ওই দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা নেওয়া হবে। ইউএইর রাজস্ব প্রশাসন এবং ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তাও নেওয়া হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহায়তা নেওয়া হবে।
দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, তদন্ত প্রতিবেদন ও রিপোর্ট এবং এনবিআর টাস্কফোর্সের কর্মকর্তাদের সংগৃহীত তথ্যের সমন্বয়ে এ বিষয়ে এনবিআর প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থ পাচার করে বাংলাদেশিরা নিজস্ব ভিলা, ফ্ল্যাট, ছোট হোটেল, তারকা হোটেল, জমি, বাণিজ্যিক স্থাপনা, দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন। অনেকে ইউএইর কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ ‘পাম জুমেইরা’, জুমেইরা, সিলিকন ওয়েসিস, এমিরেটস হিল, দুবাই মেরিনা ও বিজনেস বের মতো অভিজাত এলাকাগুলোতেও নিজস্ব বাড়ি ও তারকা হোটেল গড়ে তুলেছেন। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী নিজেদের আড়ালে রেখেছেন।
এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যরা বছরে একাধিকবার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ বা আজমানে গিয়েছেন। অনেকে আবার অন্য দেশ হয়েও সেখানে গিয়েছেন। ওই সব শহরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠিয়ে বিনিয়োগের জন্য এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে কোন পথে অর্থ পাঠিয়ে এসব করা হয়েছে, তদন্তে তা খতিয়ে দেখা হবে। এসব ব্যক্তির বেশির ভাগ বাংলাদেশের পরিবর্তে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আলবেনিয়া, সাইপ্রাস, মিসর, ব্রাজিল, সিয়েরা লিওনসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব বা পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউএইর আবুধাবি, বাণিজ্যিক শহর দুবাই ও শারজাহতে বাংলাদেশিদের বসবাস বেশি। এনবিআরের এ তালিকায় অনেক আবাসন ব্যবসায়ী আছেন। বাংলাদেশের অনেক আবাসন ব্যবসায়ী এসব শহরে আবাসন ব্যবসা করছেন। বাংলাদেশে বসেই ওই সব শহরে ফ্ল্যাট, বাড়ি বা জমি কেনা যায়। উচ্চমূল্যের এসব সম্পদ বাংলাদেশের অনেকেই কিনেছেন।
এ ক্ষেত্রে ওই আবাসন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ক্রেতার সব তথ্য গোপন রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে হন্ডিতে পাঠিয়ে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। দুবাইয়ে তিন-চার কক্ষের ফ্ল্যাট কিনতে খরচ হয় ৩ থেকে ৪ লাখ দিরহাম। টাকার বিনিময় মূল্য হিসেবে ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোর চেয়ে দুবাইয়ে ফ্ল্যাটের মূল্য কিছুটা কম হয়। চাকরির জন্য দুবাইয়ে আসা অনেক বাংলাদেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন। অন্য দেশে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিও দুবাইয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন।
এ ছাড়া ফ্ল্যাট কিনে কিছু লাভ রেখে আবারও বিক্রি করছেন, এমন অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারাও আছেন। তবে নথিপত্রে তারা অন্য নাম ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ আরব আমিরাতে অবস্থান করলেও বেশির ভাগই দেশে থাকেন। তারা মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে থাকছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানির আড়ালেও অর্থ পাচার করেছেন। অনেকে ওই সব শহরে সন্তান পড়িয়ে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন এবং খাওয়া ও থাকার খরচ প্রকৃত হিসাবের চেয়ে বেশি পাঠিয়েও অর্থ পাচার করছেন। বাংলাদেশিদের নিজেদের হোটেলগুলোতে হুন্ডিতে দেশ থেকে টাকা আনার ব্যবস্থা করা আছে। এখানে এসব বাংলাদেশির দোকান আছে। দোকান কেনার অর্থ দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ দোকানে সোনা বেচাকেনা হয়।
এ ছাড়া পোশাক, প্রসাধনী, জুয়েলারি, প্রসাধনী, জুতা, স্যান্ডেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্রেরও দোকান আছে। এসব দোকানের কর্মচারীরা অধিকাংশই বাংলাদেশের। এসব কর্মচারী বাংলাদেশ থেকে দোকানের মালিকদের বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে কাজ করতে গিয়েছেন। এদের বেতনের অর্থও দেশে হুন্ডিতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশিদের বিলাসবহুল হোটেলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ধনী ব্যক্তিরা থাকেন। এখান থেকে আয় ভালো, যা এসব শহরেই ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে।
এনবিআর থেকে টাস্কফোর্স কমিটি চূড়ান্ত তদন্তকালে এসব পাচারকারীর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ নিশ্চিত হলে তা দেশে ফেরত আনতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে পাচারকৃত অর্থ থেকে হিসাব কষে রাজস্ব আদায় করা হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ বলেন, ‘সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনবিআর কঠোর থেকে তদন্ত করলে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। পাচারকারীদের রিটার্নে বিদেশে পাঠানো অর্থের বিষয়ে কিছু জানিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখারও সহায়তা নিতে হবে।’
বাংলাদেশের অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর একটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি। এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে অর্থ বেশি পাচার হয়েছে তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের শহরগুলো আছে। এসব জায়গায় বিনিয়োগ করা হলে অর্থের উৎস নিয়ে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। তাই বাংলাদেশ থেকে এখানে অর্থ পাচার বাড়ছে। এদের আইনের আওতায় নিয়ে গেলে পাচার কমবে।