মধ্য বৈশাখে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা যখন ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে। তখন তীব্র দাবদাহে প্রাণিকুলের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। এ সময় এক পশলা বৃষ্টির জন্য মানুষ আল্লাহর কাছে ইসতেসকারের নামাজ পড়েও ফরিয়াদ করে।
প্রাণ বাঁচানোর আকুতি নিয়ে পশু-পাখি যখন গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে বসে শান্তি খুঁজে ফিরছে তখনই চট্টগ্রামে স্বস্তির বৃষ্টির দেখা মিলে। শুধু কি বৃষ্টি। ২ মে বৃহ¯পতিবার সকালের দিকে হঠাৎ নামে বজ্রসহ বৃষ্টি। তবে সেই কাঙ্খিত বৃষ্টির স্থায়িত্ব ছিল ক্ষণিকের।
পরদিন সকালে মাথাচড়া দিয়ে উঠে কড়া রোদ। মধ্য দুপুরে তপ্ত কড়াইয়ের মতো হয়ে উঠে সূর্যের তাপ। এরপর ৬ মে সোমবার বিকেলে দ্বিতীয় দফায় বয়ে যায় বজ্রসহ কালবৈশাখী ঝড়। এতে চট্টগ্রাম মহানগরীর কাচা ঘরবাড়ি, বিদ্যুতের খুটি উপড়ে পড়ে। তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল ও যানবাহন চলাচলের সব সড়ক।
এরপর থেকে আর দেখা নেই বৃষ্টির। সেই থেকে পুনরায় তাপমাত্রা উঠে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যা এখন ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। এর মধ্যে সাগরে ঘনীভুত হচ্ছে লঘুচাপ। যার প্রভাবে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় বৃষ্টি হলেও সেই আগের চেয়েও বেশি খড়তাপে পুড়ছে চট্টগ্রামের মানুষ।
এ অবস্থায় গরমে হাঁসফাঁস করছে চারপাশ। জ্বর-ডায়রিয়াসহ নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তবে এখন নেই আর ইসতেসকারের নামাজ নিয়ে কোন দৌড়ঝাপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেই গরমে অতিষ্ঠ মানুষের হা-হুতাশ। সর্বত্রই যেন নিরুপায় মানুষ একেবারে চুপচাপ।
চট্টগ্রাম মহানগরীর দামপাড়া এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী জাকির হোসেন বলেন, সর্বশেষ গত ৬ মে মধ্যরাতে বৃষ্টির হাঁকডাক শোনা গেছে আকাশে। তারপর বিকেলে শুরু হয় স্বস্তির বজ্রসহ কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া। এতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের খুটি, গাছপালা ভেঙে পড়ে। উড়ে যায় কাচা বসতঘর। তলিয়ে যায় নগরীর সবকটি সড়ক।
এ সময় নগরবাসীর অনেকেই বাসার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংবা সড়কে গাড়ি থামিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করেন। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কেউ কেউ স্রষ্টার নিকট কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করেন। কিন্তু সেই বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই বৃষ্টি বিদায় নেয়। তারপর মেঘ কেটে গেলে তীর্যক সূর্য পুনরায় নিজের দাপট ছড়াতে শুরু করে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ সুমন সাহা বলেন, বৃহস্পতিবার ভোররাত তিনটায় বৃষ্টি শুরু হয়। ৭-৮মিনিট বৃষ্টির পর তা থেমে যায়। আবার ভোর ৫টায় শুরু হওয়া বৃষ্টি ৪-৫মিনিট স্থায়ী ছিল। সকাল ৯টায়ও একইভাবে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। এতে গরম কমার চেয়ে উত্তপ্ত থাকা ইট-পাথর থেকে বের হওয়া বাস্পে গরমের তীব্রতা আগের মতোই রয়ে যায়।
সুমন সাহা আরও বলেন, চট্টগ্রামে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রির উপরে ছিল। ওই বৃষ্টিতে সামান্য কমলেও তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রির আশেপাশেই থেকে যায়। তবে ৬ মে বৃষ্টির পর তাপমাত্রা নামে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর এ সময় আকাশে হালকা মেঘও ছিল। সাথে ছিল রোদের লুকোচুরি। কিন্তু একদিন পর ৮ মে থেকে আকাশে কাকফাটা রোদ। বর্তমানে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলিসিয়াস। সাগরে উঠেছে লঘুচাপ। এর প্রভাবে ঢাকায় বৃষ্টি হলেও চট্টগ্রামে বৃষ্টির দেখা নেই। বরং চট্টগ্রামে গরমের তীব্রতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জ্বর ও ডায়রিয়ার সঙ্গে হিট স্ট্রোকেও।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. মো. শাহেদ উদ্দিন বলেন, সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও তীব্র দাবদাহে দিশাহারা মানুষ। জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। হাসপাতালেও ভিড় বাড়ছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগে জ্বরের রোগী বাড়ছে। কিন্তু সেই জ্বরের রোগী ভাইরাল ফিভার ভেবে বাড়িতে কালক্ষেপণ করে হাসপাতালে আসছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন ওয়ার্ডে সরেজমিন দেখা গেছে, বহির্বিভাগে জ্বর নিয়ে রোগী আসার পর তাদের ১৩, ১৪, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ভাইরাল ফিভার নাকি হিট স্ট্রোক হয়েছে, তা জানতে পুরো দেড় থেকে দু‘দিন চলে যাচ্ছে। এছাড়া রোগীর শরীর থেকে লবণ বের হয়ে গেলেও তা জানতে ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা করাতেও দেরি হচ্ছে। ফলে রোগীর অবস্থা অবনতি হয়ে শকে চলে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের জ্বর ও পানিশূন্যতা নিয়ে একটা সমস্যা থাকে। সেটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। সাধারণ কিছু নির্ণায়কও থাকে। যা আমরা ডায়াগনোসিস রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হতে পারি।
বসন্তের শেষের দিকে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগ ছড়ানোর জন্য এসব অণুজীব দায়ী। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে অণুজীবগুলো বেশিরভাগ রোগ ছড়ায়। তাই খাবার ও পানীয়ের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানান, শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করলেও সেটিকে ভাইরাল ফিভার মনে করে প্যারাসিটামল খাচ্ছেন রোগীরা। হিট স্ট্রোকের জ্বরের লক্ষণ স¤পর্কে তারা বলেন, এই জ্বরে ঘাম থাকবে না। সাধারণ জ্বর ৬ ঘণ্টা পর কমে যাবে, তবে হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সেটি হবে না। জ্বরের অবস্থা দেখে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
জানা গেছে, হিট স্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্নক হিট র্ক্যা¤প বা হিট এক্সশন হতে পারে। এতে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচন্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট এক্সশনে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথাব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ দেখা দেয়। দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ ঠিক থাকে তবে শরীর প্রচন্ড ঘামতে থাকে।
এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এ সময় শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যাবে। ঘাম বন্ধ হয়ে যাবে, ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যাবে এবং নিঃশ্বাস স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হবে। নাড়ির ¯পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হবে, রক্তচাপ কমে যাবে, খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতাসহ প্রস্রাবের পরিমাণও কমে যাবে। রোগী তখন শকে চলে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়বে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ডিউটি ফোরকাস্টিং অফিসার মো আবদুল বারেক বলেন, চট্টগ্রামে গরমের মাত্রা বেড়েছে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টির পাশাপাশি কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিও হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।