রাজধানীর মিরপুরে একটি বাড়ির মালিক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) প্রধান মো. জহিরুল ইসলাম। ঢাকার শহীদবাগ ও উত্তরায়ও কিনেছেন দুটি ফ্ল্যাট। চলাফেরা করেন ৩৫ লাখ টাকায় কেনা ব্যক্তিগত গাড়িতে।
স্ত্রীর নামেও কুমিল্লার ঝাউতলা মৌজায় রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। ঢাকার কাকরাইলেও রয়েছে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে এই দ¤পতির প্রায় সোয়া ৪ কোটি টাকার স¤পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যা ইতিমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
এরপরও বেপরোয়াভাবে অর্থ হাতাচ্ছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) প্রধান মো. জহিরুল ইসলাম। এর আগেও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে অঢেল সম্পদ গড়ার অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি হয়েছিলেন তিনি। যেখান থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খারিজ পাওয়ার গুঞ্জনও রয়েছে।
ভুক্তভোগীদের মতে, কমিশন বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, রেলেওয়ের যন্ত্রাংশ ও তেল চুরি, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, রেলওয়ের জমি অবৈধভাবে ভাড়ায় খাটিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ নানা অপকর্ম চালাতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে ও স্টেশনে এই কর্মকর্তার অনুসারি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। যেখানে আরএনবির পরিদর্শক ও সদস্যের সংখ্যা বেশি। যারা যন্ত্রাংশ ও তেল চুরির ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়ার পরও জহিরুলের কারসাজিতে পেয়েছেন রক্ষা।
ভুক্তভোগীরা জানান, চলতি বছরের ৩ জুন রাতে রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির (আরটিএ) মডেল রুমে চুরির ঘটনা ঘটে। মডেল রুমে থাকা পিতলের রেললাইন, ট্র্যাক সার্কিটে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার (সুপার অ্যানামেল কপার ওয়্যার), পয়েন্ট মেশিনের রডসহ অন্তত ২০-২৫ লাখ টাকার বিভিন্ন দামি সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে আরএনবির এক সদস্য।
কিন্তু চুরির তিনদিন পর এসব মালামালের মূল্য ২৫ হাজার টাকা দেখিয়ে অভিযোগ দেওয়া হয় নগরীর বন্দর থানায়। আর এই কারসাজিতে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আরএনবির চিফ মো. জহিরুল। যিনি দেড় লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে এই কারসাজি করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছে খোদ রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির মডেল রুমটি দেখভালের দায়িত্ব ছিল সংকেত ও টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশল বিভাগের হাতে। রাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল আরএনবি। চুরির ঘটনার পর আরএনবির প্রধান জহিরুল বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি। একাডেমির রেক্টর ওই সময় ছুটিতে থাকায় তাকে ফোনে জানানো হলে তিনি মামলার পরামর্শ দেন। বাকি কারসাজি করেন জহিরুল।
একইভাবে চলতি বছরের জুনে বন্দরের সিজিপিওয়াইতে (গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) নতুন গাড়ি পরিবহনের জন্য আনা প্রায় ৫ লাখ টাকার লোহা চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার সাথেও জড়িত আরএনবির সদস্যরা। যারা জহিরুল ইসলামের সিন্ডিকেটে জড়িত।
চলতি বছরের ২৩ মে পাহাড়তলী লোকোশেড থেকে ভুয়া ভাউচারে ট্রাকভর্তি স্লিপার ও রাবার চুরি করে বিক্রি করতে গেলে পুলিশের হাতে চালক ও হেলপার ধরা পড়ে সাগরিকা মোড়ে। ওই ঘটনার পর কোনো তদন্ত হয়নি। এর কিছুদিন পর ইঞ্জিনের ৬টি ব্রাশ বার (দামি তামার তার) চুরি হয়।
এছাড়া লোহা ও যন্ত্রাংশ মিলে ৩ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয় মে মাসেই। অথচ এক মাসে কয়েকটি চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটি করলেও কেউ শাস্তির সম্মুখীন হয়নি। মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও ইঞ্জিনের নিরাপত্তায় রয়েছে মাত্র তিনজন আরএনবি সদস্য। এর মধ্যে অনেকেই ডিউটি ফাঁকি দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শুরুতেও ২০০০ সিরিজের একটি ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরির ঘটনা ঘটে এ ইয়ার্ডে। যেটির আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকা থেকে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর টুল ভ্যানের প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে।
রেলের এক কর্মচারী ট্রেনের কোচ মেরামতের জন্য মালামাল আনতে গেলে চুরির বিষয়টি নজরে আসে। অথচ টুল ভ্যানটি রেলওয়ে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর ইনচার্জ ট্রেন এক্সামিনার (হেড টিএক্সআর) এবং ওই বিভাগের স্টোর মুন্সির দায়িত্বে থাকে। টুল ভ্যানটি প্রতিদিন সকাল ৯টায় ও বিকেল ৫টায় দুইবার পরীক্ষণ করার নিয়ম রয়েছে হেড টিএক্সআর ও স্টোর মুন্সির।
চুরির ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে রহস্যজনকভাবে রেলওয়ে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর ইনচার্জ ট্রেন এক্সামিনার, মুন্সি বা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
এরপর লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশের পাইকপাড়া গ্রামের আফসারুল ইসলাম (২২), একই গ্রামের সাগর (২৩) নামের দুই ভবঘুরে এবং উপজেলার পাশাপুর গ্রামের ভাঙারি ব্যবসায়ী নূরে আলমকে (৩০) ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এছাড়া ২০২৩ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা তিনটি ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরি হয় সিজিপিওয়াই থেকে। কবে চুরি হয়েছে সেটি রেলওয়ে জানতে না পারলেও ৯ জুলাই বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ঘটনায় আরএনবির পক্ষ থেকে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করে।
সরকার ও এডিবির যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন (রোলিং স্টক সংগ্রহ) প্রকল্পের আওতায় ৪০টি ব্রডগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয় করে রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ৩০টি লোকোমোটিভ দেশে চলে আসে।
এছাড়া চট্টগ্রামে তেলবাহী ওয়াগন ও ট্রেনের ইঞ্জিন থেকেও প্রতিদিনই চুরি হয় তেল। সিজিপিওয়াই থেকে তেলবাহী ওয়াগন বের হলে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার পথেই চুরি করা হয় তেল। একইসঙ্গে পণ্যবাহী ট্রেন থেকে তেল চুরি করা হয় ফেনীর শর্শদী স্টেশনে থামিয়ে।
এমন একটি তেল চুরির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের টাইগারপাসের মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে রেলের বগি (কোচ) পরিষ্কার শেষে রেল স্টেশনে আনার পথে। ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ দুপুরে মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি পরিষ্কার শেষে স্টেশন আনার পর ৩০ লিটারের এক গ্যালন মবিলসহ ধরা খায় আরএনবির এক সদস্য। পরে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তখন বগিটি ইয়ার্ড থেকে আনার পথে কদমতলী এলাকার ফ্লাইওভারের নিচে (কোচ নম্বর ৬৩০৭) এই রকম আরও ছয় গ্যালন মবিল নামিয়ে নেয় বলে জানা গেছে।
এছাড়া ফেনীর শর্শদী স্টেশনে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার লিটার তেল চুরি হয়। ট্রেনটি এ স্টেশনে প্রায় ২০ মিনিট বিরতি দেয়। চুরি হওয়া এসব তেলের বাজার মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা, মাসে যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৪ লাখ টাকা।
এভাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগে গত এক বছরে প্রায় চার কোটি টাকার স¤পদ চুরি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলা ও তদন্ত কমিটি হয়েছে। দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে কর্তৃপক্ষ পার পেলেও উদ্ধার হয়নি রেলের কোনো চুরি যাওয়া জিনিস ও টাকা। মূলত চুরির ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের সাজা না হওয়ায় বার বার রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
অভিযোগ রয়েছে, চুরির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক সময় রাস্তার ভবঘুরে ও টোকাইদের আসামি করে দায়সারা রিপোর্টও দেওয়া হয়। ফলে আসল অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
শুধু তাই নয়, অরপাধ সিন্ডিকেট সক্রিয় রাখতে বদলি বাণিজ্য ও কমিশন বাণিজ্যে লিপ্ত আরএনবির প্রধান মো. জহিরুল ইসলাম। এমনকি রেলে চাকরি দেওয়ার নামে শত শত চাকরি প্রত্যাশীর একেক জনের কাছ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন। কদমতলি স্টেশনে কর্মরত রাকিব নামে আরএনবির এক সদস্য এমন প্রতারণার মাধ্যমে এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। এর এই রাকিব আরএনবি প্রধান জহিরুল ইসলামের খুবই পছন্দের লোক বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সিজিপিওয়াইয়ের এসএসএই (ইনচার্জ) মো. আবদুল মালেক বলেন, সিজিপিওয়াইয়ের রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিভিন্ন জেলায় পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে ট্রেন ফেনীর শর্শদী স্টেশনে এক সময় তেল চুরির ঘটনা শুনেছি। তবে এখন মনে হয় চুরি হয় না, হলেও এটি আমার জানা নেই। চুরির বিষয় আমরা বিভিন্ন সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে থাকি। চুরি বন্ধে ব্যবস্থা ওনাদের হাতেই। আর ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরির পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্তে কি উঠে এসেছিল, তা আমার মনে নেই।
পাহাড়তলী লোকেশেড ইনচার্জ আবু জাফর বলেন, লোকোশেডের চুরির প্রধান কারণ হলো নিরাপত্তার অভাব। মাত্র তিনজন আরএনবি সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। রেলের স¤পদ পাহারাদার দায়িত্ব আরএনবির। চুরির বিষয়ে আমরা মামলা করি। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া হয়।
লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের আরএনবির চিফ ইন্সপেক্টর মো. সালামত উল্লাহ বলেন, এ রকম কোনো তেল চুরির বিষয়ে আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জহিরুল ইসলাম ১৯৯০ সালে সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম টাইপিস্ট পদে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) যোগদান করেন। ২০০০ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পদে পদোন্নতি পান। ২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিসিএস নন-ক্যাডারে (২১তম ব্যাচ) সহকারী কমান্ড্যান্ট পদে, ২০০৬ সালে কমান্ড্যান্ট এবং ২০২০ সালে চিফ কমান্ড্যান্ট পদে বাংলাদেশ রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন।
জহিরুল ইসলামের স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহার বর্তমানে একজন গৃহিণী। তবে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বাতাবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে চলে যান। দুদক জানায়, ২০১৭ সালে রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীতে ১৮৫ জন সিপাহি নিয়োগে অনিয়ম হওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
অনুসন্ধান শেষে নিয়োগে অনিয়ম হওয়ায় ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। এর মধ্যে জহিরুল ইসলামের স¤পদের অনুসন্ধানও শুরু হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে অস্বাভাবিক স¤পদের তথ্য পায় দুদক। জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি-বাণিজ্যসহ নানান অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ স¤পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে যা মিলল জহিরুলের সম্পদ
২০১৪ সালের ২৯ মে ঢাকার মিরপুরের সেনপাড়া মৌজায় জহিরুল ইসলামসহ ৩৫ জন একটি বাড়ি ক্রয় করেন। ওই বাড়ির দলিলমূল্য ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৮৮৮ টাকা। এর মধ্যে ২ কোটি টাকাই দেন জহিরুল ইসলাম। এ ছাড়া ঢাকার শহীদবাগে এ এন জেড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নয়তলাবিশিষ্ট সিপ্রিং ডেল নামে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় ১ হাজার ৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন জহিরুল ইসলাম। ফ্ল্যাটটি তিনি প্রায় ৮০ লাখ টাকা দামে কিনলেও বর্তমানে এটির বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা।
ঢাকার উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের এ ব্লকে রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পেও ১ হাজার ৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট আছে জহিরুল ইসলামের নামে। এটির দাম প্রায় ৬৫ লাখ টাকা। রেলওয়েতে চিফ কমান্ড্যান্ট পদে পদোন্নতি পাওয়ার পরপরই প্রায় ৩৫ লাখ টাকা মূল্যে একটি গাড়িও (ঢাকা-মেট্রো-গ-৪২-০৮৭১) ক্রয় করেন জহিরুল।
তাঁর স্ত্রীর নামে যে স¤পদ আছে জহিরুলের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহারের স¤পদের খোঁজও নিয়েছে দুদক। এতে উঠে আসে, ২০১২ সালে কুমিল্লার আদর্শ সদর থানাধীন কান্দিরপাড় প্রকাশ্য ঝাউতলা মৌজায় রহমান লজ নামে পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলায় প্রায় ২০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট এবং ২০১৮ সালে একই মৌজায় জয়েন্ট লাইফ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের জয়েন্ট লাইফ এস এস গার্ডেন নামের ১০তলা ভবনের চতুর্থ তলায় প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট কিনেছেন কাজী জিন্নাতুন নাহার।
এ ছাড়াও ঢাকার রমনা থানার কাকরাইলের সার্কিট হাউস রোডের কনকর্ড র্গ্যান্ড রুবি নামীয় ১৪ তলা আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের চতুর্থ তলায় ১ হাজার ৭৫০ বর্গফুট আয়তনের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে তাঁর। এই ফ্ল্যাটটি প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যে ক্রয় করেন তিনি, যেখানে বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আরএনবির প্রধান জহিরুল ইসলাম বলেন, আমার অবৈধ কোন সম্পদ নেই। ২৩-২৪ বছর চাকরি করে ২-৩ কোটি টাকার সম্পদ থাকা অবৈধ হতে পারে না। সাংবাদিক ও দুদককে এসব অভিযোগ দিয়ে আমাকে শুধু হয়রানি করছে। আমার অফিসের সহকারি চিফ কমান্ড্যাট রেজুয়ান এসব করছে। তার লক্ষ্য আমাকে এখান থেকে সরানো। আমি সরে গেলে তিনি চিফ হতে পারবেন। আর লুটপাট চালাতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমি সৎ আছি এটা সহ্য হচ্ছে না রেজুয়ানের। বিষয়টি আমি আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে এ পদে রেখেছেন। তাই আমাকে নিয়ে যে যা পারে লিখুক, অভিযোগ করুক, আমার কিছুই যায় আসে না। দুদকও তো ভালো না। ২০১৮ সালে দুদকের এক কর্মকর্তা বেনামি এক অভিযোগের তদন্তের নামে ধান্ধা করতে চেয়েছিল। সুযোগ না পেয়ে আমাকে এক নম্বর আসামি করে মামলা করেছিল। অথচ এই অভিযোগটিই আমার বিরুদ্ধে ছিল না। আমার আগের চিফ কমান্ড্যাট ইকবাল হোসেন সাহেবের বিরুদ্ধে ছিল। সম্প্রতি আমার সম্পত্তির হিসাব চেয়ে দুদক চিঠি দিয়েছিল। গত মাস দেড়েক আগে আমি হিসাব দিয়েছি। তাতে কি হবে আমি জানি।
সাংবাদিকদের করা প্রতিবেদন নিয়েও কড়া সমালেচনা করেন তিনি। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা খুবই খারাপ। আমার ২৩-২৪ বছর চাকরি জীবনে ঢাকায় অনেক বছর চাকরি করেছি। কোন সাংবাদিককে দাওয়াত দিয়েও অফিসে আনতে পারিনি। আর চট্টগ্রামে এত সাংবাদিক, যারা শুধু এগুলো নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে। কেউ একটা নিউজ করলে সবাই এটার পেছনে লাইন ধরে। এর মধ্যে তিনি চট্টগ্রামের কয়েকজন প্রতিথযশা সাংবাদিকের সমালোচনাও করেন।
এর মাঝে যন্ত্রাংশ ও তেল চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম বলেন, যন্ত্রাংশ চুরি হলে এ বিষয়ে মামলা করার দায়িত্ব মেকানিক্যাল বিভাগের। এখানে আরএনবির করণীয় কিছুই নেই। মেকানিক্যাল বিভাগ এ পর্যন্ত কোন মামলা করেছে কি না আমার জানা নেই। সেই হিসেবে কোন যন্ত্রাংশ চুরি হয়েছে কি না তাও আমি নিশ্চিত নই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যন্ত্রাংশ ও তেল চুরির ঘটনা কিছু ঘটেছে। এসব চুরির সাথে হয়তো আরএনবির কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে। আরএনবিতে সবাই যে ভাল আমি তা বলছি না। তবে তদন্ত করে চুরির ঘটনায় জড়িত প্রমাণ হলে তারা শাস্তি পাবে।
সম্প্রতি সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডে চুরির ঘটনায় জড়িত আরএনবির সদস্যকে বাচাতে দেড় লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে মামলায় কারসাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কি বলেন, ২৫ হাজার টাকার মালের জন্য তিনি আমাকে দেড় লাখ টাকা ঘুষ কেন দিবেন।
চাকরি নেওয়ার নামে প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম বলেন, রাকিব টাকা নিয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু আমার প্রশ্ন, মানুষ টাকা দিবে কেন? এ নিয়ে রেলের কি করার আছে। যারা ভুক্তভোগী তারা মামলা করুক। মামলায় দোষি সাব্যস্ত হলে চাকরি এমনিতেই চলে যাবে। প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হওয়ার আইনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হলে তিনি নিরবতা পালন করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ের বিভাগীয় কর্মব্যবস্থাপক (পূর্ব) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যেকোনো দুর্নীতি ও চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে দোষীদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
জহিরুল ইসলামের বিপুল স¤পদ ও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চাইলে রেলপথ সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, আরএনবির বিষয়ে দেখভাল করে মহাপরিচালক দপ্তর। তাই এই বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। পরে রেলের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের স¤পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, নিরাপদ ও সাশ্রয় হিসেবে জনপ্রিয় হলেও দুর্নীতির কারণে রেলখাত পিছিয়ে যাচ্ছে। হাতগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত। জবাবদিহিতা না থাকায় চুরি বন্ধ হচ্ছে না।