কেনাকাটার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন রেলওয়ের পাহাড়তলী পার্বতীপুর ও সৈয়দপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। যার পরিমাণ শত কোটি টাকার মতো। তবে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ের অডিট প্রতিবেদনে গত ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে উঠে এসেছে মাত্র ৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য। যা অনিয়ম-দুর্নীতির অংশ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে একের পর এক যন্ত্রপাতি কেনা; সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঠিকাদারের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি মেরামতের মাধ্যমে এই লোপাট চালানো হয়েছে বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক উচ্চদরে মালামাল কেনায় রেলওয়ের ক্ষতি হয় ৮২ লাখ ৯৮ হাজার ১৪ টাকা। কমলাপুর কার্যালয়ের কর্মব্যবস্থাপক ও তার অধীনে থাকা প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো); বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী, পশ্চিম বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো-লালমনিরহাট) ও বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (সৈয়দপুর); প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলীর (পূর্ব) অধীন বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো-পাহাড়তলী), সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন, পাহাড়তলী); বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলীর (লোকো ও ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন, কমলাপুর) বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়।
নিরীক্ষায় বিল বই, দাপ্তরিক প্রাক্কলন, বিল চালান ও চুক্তিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কেনা মালামালের দাম স্থানীয় বাজারদরের চেয়ে বেশি এবং একই মালামাল অন্য দপ্তর অপেক্ষাকৃত কম দামে কিনেছে। রেলওয়ের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল সেগুলো হলো- বিয়ারিং পুলার, স্ট্যান্ডার্ড পিভিসি বোর্ড, সিসি ক্যামেরা, সালফিউরিক অ্যাসিড, হাইড্রো মিথানল, কেব্ল, সাদা টুইল কাপড়, গ্যাস ব্রেক সিলিন্ডার, গ্যাস ভ্যাকুয়াম।
এসব পণ্যের স্থানীয় বাজারমূল্যের সঙ্গে সরবরাহকারী বা ঠিকাদারের মুনাফা, আয়কর ভ্যাট, পরিবহন খরচ যোগ করে মূল্য হয় ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৬ টাকা। কিন্তু এসব মালামালের দাপ্তরিক প্রাক্কলন প্রস্তুত করে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৯৫০ টাকার চুক্তি সম্পাদন করেন রেলওয়ের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। এতে বাজারদরের চেয়ে উচ্চদরে দাপ্তরিক প্রাক্কলন প্রস্তুত করে মালামাল কেনায় সরকারের ৮২ লাখ ৯৮ হাজার ১৪ টাকা ক্ষতি হয়।
এসব কেনাকাটায় সাধারণ ভবিষ্য তহবিল বিধিমালা (জিএফআর), রেলওয়ে জেনারেল কোড, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার (পিপিআর) তোয়াক্কা করেননি রেলওয়ে কর্মকর্তারা। কেনাকাটার ক্ষেত্রে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। পাশাপাশি প্রাক্কলন ব্যয় প্রস্তুত করার সময় পরিবহন ব্যয়, মুনাফা, ঝুঁকি, জটিলতা অনগ্রসর, মূল্য সংযোজন কর যুক্ত করার নিয়ম থাকলেও তা করেননি রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
জরুরি অবস্থার উদ্ভব না হলেও রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (সৈয়দপুর কার্যালয়) সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে (এলটিএম) ১৫ লাখ ৭২ হাজার টাকায় বিভিন্ন প্রকারের রং কিনেছেন। বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে ফোম কেনায় দুই দফায় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ কোটি ৮২ লাখ ৯৬ হাজার ৫৯৯ টাকা লোপাট করে নিয়েছেন সৈয়দপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
রেল ভবনের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী, পাহাড়তলীর কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল) পাহাড়তলী, পার্বতীপুরের লোকোর প্রধান নির্বাহী ও প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী; পশ্চিম রাজশাহীর অধীনে সৈয়দপুর কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে।
কারখানায় লোকো, কোচ ও ওয়াগন না থাকলেও এসবের বিপরীতে ব্যয় দেখানোর কারণে ৮১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৬ টাকা ক্ষতি হয়েছে রেলওয়ের। নিরীক্ষাযোগ্য সময়ে লোকমোটিভগুলোর কোনো ইন বা আউট টার্ন না হলেও শিডিউলসংক্রান্ত মেরামত করতে লোকোমোটিভের বিপরীতে স্টোর থেকে মালামাল উত্তোলন করেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। অডিট প্রতিষ্ঠান প্রমাণ পায়, এতে কাল্পনিকভাবে লোকোর ইন টার্ন দেখানো হয়েছে। অডিট প্রতিষ্ঠান রেলওয়ে সচিবকে দুই দফায় চিঠি দিলেও তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
২০২০-২১ অর্থবছরে মেরামতযোগ্য যন্ত্রপাতি না থাকা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয়ভাবে মেরামতের মালামাল কেনে পার্বতীপুরের লোকোর ডব্লিউএমআর এবং ডব্লিউএমপি কার্যালয়। এতে ২৮ লাখ ৯৪ হাজার ৯০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে কারখানার কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চুক্তি করে ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করা হয়েছে বলে জানায় পাহাড়তলীর কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ) ও কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল) কার্যালয়। নতুন কোচ উৎপাদন, ওয়াগন তৈরি বা সংযোজন করার সক্ষমতা পাহাড়তলী কার্যালয়ের ওয়ার্কশপে রয়েছে। এ ছাড়া ক্যারেজ শপ, মেশিন শপ, পেইন্ট শপের সক্ষমতা থাকলেও যন্ত্রাংশ মেরামতের জন্য ঠিকাদারের শরণাপন্ন হয় পাহাড়তলীর দুই বিভাগ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঠিকাদার থেকে কিনে নিয়ে আসা যন্ত্রাংশের মান কারখানায় উৎপাদিত যন্ত্রের চেয়ে উন্নত নয়। অথচ ঠিকাদারের মাধ্যমে কর্মসম্পাদন দেখিয়ে রেলওয়েকে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৯৩ টাকার ক্ষতির মুখে ফেলে দেয় দুই বিভাগ। রেলওয়ের আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি অডিট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিষ্পত্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সচিব হুমায়ূন কবীর অডিট রিপোর্টের বিষয়টি বরাবর এড়িয়ে গেছেন। সাবেক রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর রেলপথ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় অডিট প্রতিবেদনের বিষয়টি বারবার উঠে আসে। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও আসে। কিন্তু অভিযুক্ত কর্মকর্তারা রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে বারবার রেহাই পেয়ে গেছেন বলে জানান রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে সাবেক সচিব হুমায়ূন কবীরকে রেলওয়ের অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক চেষ্টার পরও রেলপথ সচিব আবদুল বাকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে ফোন মেসেজে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
পরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যেসব অনিয়ম হয়েছে তা হয়েছে মন্ত্রী বা সচিবের প্রশ্রয়ে, ওপর মহলের প্রশ্রয়ে। এখন আমরা এসেছি, এসব আর প্রশ্রয় দেব না। দুর্নীতি কমে আসবে বলে আশা করছি আমরা।’
অডিট প্রতিবেদনের আপত্তির বিষয়ে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, অডিট রিপোর্টের একটা পদ্ধতি আছে। সব অডিট আপত্তি কিন্তু ভ্যালিড না। কোনোটা আবার বোঝার ভুলের জন্যও হয়ে থাকে। অডিট আপত্তি এলে সেটা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে জবাব দেওয়া হয়। অডিট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসে এই আপত্তি নিষ্পত্তি করতে হয়। এখন যদি সত্যিই কেউ আপত্তির জবাব না দেয়, আমরা তা দেখব।’
যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেল নেটওয়ার্ক বা রেল সেবা বিস্তৃত করতে সরকার প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে। সেখানে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণে লুটপাট চলে তা বন্ধ করতে হলে নীতিনির্ধারকদের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। পার্বতীপুর, সৈয়দপুর বা পাহাড়তলী কার্যালয়সহ রেলওয়ের সব কারখানাকে অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। কারখানাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন দক্ষ করতে হবে, পাশাপাশি প্রতিটি কারখানাকে আধুনিকায়ন করতে হবে।
এছাড়া আমাদের যে জনবল রয়েছে, তাদের স্মার্ট হিউম্যান রিসোর্স হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রেলের নিজস্ব জনবল যখন তাদের দক্ষতা দেখাতে শুরু করবে, তখন রেলকে আর মেরামত কার্যক্রমের জন্য ঠিকাদার খুঁজতে হবে না। তখন টাকা নয়ছয় করা বা বিনা প্রয়োজনে কেনাকাটার পরিমাণ এমনিতেই কমে আসবে।