রেলের সরঞ্জাম ক্রয়ে ফাইভ পারসেন্ট কমিশনে কন্টাক্ট সই, স্বজনদের নামে করা লাইসেন্স দিয়ে সাপ্লাই কাজ হাতিয়ে নেওয়া, ভুয়া লাইসেন্সে বিল তুলে সরকারি অর্থ আত্নসাৎ, কাজের টোপ দিয়ে ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারদের নিয়ে সিন্ডিকেট করা, তাদের দিয়ে স্ক্র্যাপ চুরি ও চাঁদা আদায়সহ সব রকম অপকর্মের মূল হোতা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিন।
এ নিয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ঈশানের প্রিন্ট ও ছাপা ভার্সনে ধারাবাহিক চার পর্ব প্রতিবেদন প্রকাশের পর দম্ভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি যা করি উর্ধ্বতন স্যারদের ম্যানেজ করেই করি। সুতরাং আমার বিরুদ্ধে যতই লেখালেখি করুক, কিছুই হবে না। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ছাত্রলীগ করেই আমি এখানে এসেছি। রাষ্ট্রপতি আমার এলাকার লোক, আমার আত্নীয়ও। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বহু সচিব-যুগ্ম সচিব আমার আত্নীয়। আমার কেউ কিছুই করতে পারবে না।
এসব কথা বলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের পাহাড়তলি প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা। তাদের মতে, এসিওএস শরীফ উদ্দিনের নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে গণমাধ্যমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশের পরও রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে তিনি এখন চরম বেপরোয়া হয়ে গেছেন। তার কমিশনের হার আরও বেড়ে গেছে। অনেকের ফাইল আটকে রেখে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছেন।
তিনি আগে যেখানে প্রতিসপ্তাহে রবিবার দুপুরে অফিসে আসতেন, বুধবার দুপুরের পর ঢাকায় চলে যেতেন, সেখানে এখন সপ্তাহে একদিন অফিসও করেন না। গত দুর্গাপুজার বন্ধের দিন থেকে পরবর্তি দুই সপ্তাহে তিনি অফিস করেছেন মাত্র দু‘দিন। এ নিয়ে সিসিএস দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে ভয়ে কিছুই বলেন না।
সিসিএস দপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসিওএস শরীফ উদ্দিন প্রায় সময় সিসিএস দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি দেন, তার অফিস করা নিয়ে কিছু বললে তিনি সিসিএস দপ্তরে চাকরি করবেন না। সিসিএস দপ্তরে অফিসার সংকটের সুযোগ নিয়ে তিনি এই হুমকি দেন।
তিনি বলেন, এসিওএস শরীফ উদ্দিনকে দেখতে বা আচরণ শুনলে মনেই হবে না তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। ছাত্রলীগের ক্যাডারের মতো তার আচরণ ও হাবভাব। একই কথা বলেছেন একই দপ্তরের আরেকজন কর্মকর্তাও। তিনি বলেন, দুঃখের কথা আর কী বলব, তার ব্যবহার খুবই খারাপ।
এমনভাবে কথা বলেন, যেন তিনি এদেশের প্রেসিডেন্ট। এরপরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এই দপ্তরে অফিসার সংকট। দপ্তরের সরঞ্জাম কেনাকাটায় অফিসাররা একে অন্যের সাথে সংযুক্ত। একজন অফিসারের স্বাক্ষর না হলেও সরঞ্জাম কেনাকাটা অচল হয়ে পড়বে। এই সুযোগ নিয়ে এসিওএস শরীফ উদ্দিন যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছেন।
সূত্র মতে, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কমিশন ছাড়া কোন কাজের ফাইল নড়ে না। তম্মধ্যে এসিওএস শরীফ উদ্দিন যে লেবেলের কর্মকর্তা, সেই লেবেলে ১% থেকে ২% কমিশন পাওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ছাত্রলীগের ক্যাডার পরিচয়ে বিগত সময়ে ৫% কমিশন আদায় করেন তিনি। না দিলে ফাইলে স্বাক্ষরও করেননি। ৫% কমিশন আদায়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ পরিচয়ে কতিপয় বখাটে যুবক-কিশোর দিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলেছেন। যাদের ভয়ে ৫% কমিশন দিতে বাধ্য হয়েছেন ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা।
এতে সরঞ্জাম কেনাকাটায় জড়িত ঠিকাদাররা একদিকে ভাল মানের পণ্য কিনতে পারছেন না, অন্যদিকে নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিপরীতে ঘুষের টাকায় এসিওএস শরীফ উদ্দিন গড়েছেন অঢেল স¤পদ। দেশের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে করেছেন বহুতল বাড়ি। কিনেছেন জমি। ঢাকায় কিনেছেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট। বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে জমিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা।
ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা জানান, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে এসিওএস শরীফ উদ্দিন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে পাহাড়তলি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারদের অনৈতিক সুবিধা দিতেন। তাদের নিয়ে তিনি তিন স্তরে চোরচক্র গড়ে তোলেন। তাদের ভয়ে সিসিএস দপ্তরের প্রকৃত ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা আতঙ্কিত সময় পার করছেন। এমনকি সিসিএস নিয়ন্ত্রক দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারাও তাদের ভয়ে তটস্থ। তাদের কারও কথা কোন সময় মানতেন না শরীফ উদ্দিন।
এ নিয়ে পাঠকপ্রিয় দৈনিক ঈশানের অনলাইন ও ছাপা ভার্সনে এ পর্যন্ত ধারাবাহিক চারটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক ঈশানের ফেসবুক পেইজে শেয়ার করা প্রতিবেদনগুলোতে শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে চরম ঘৃণা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন হাজারো পাঠক।
এর মধ্যে পাবনা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নামক একটি পেইজ থেকে দাবি করা হয়, এসিওএস শরীফ উদ্দিনের পিতা নায়েব আলী বিশ্বাস কখনই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। শরীফ উদ্দিন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন। এ কারনে তার পিতা রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। তার পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদও ভুয়া। যা দিয়ে শরীফ উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে। বিষয়টি তদন্ত করলে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এদিকে ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো সরাতে এসিওএস শরীফ উদ্দিন অনৈতিকভাবে সাপ্লাই কাজের অফারও করেন দৈনিক ঈশানের এই প্রতিবেদককে। তাতে থামাতে না পেরে এই প্রতিবেদককে একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন শরীফ উদ্দিন সিন্ডিকেটের দুর্বৃত্তরা। একই সাথে আছে সুপারিশও।
এসব করে ব্যর্থ হয়ে শরীফ উদ্দিন এখন দম্ভ প্রকাশ করছেন যে, লেখালেখি যতই করুক তার কিছুই হবে না। তিনি বলছেন, আমি যা কিছুই করি, উর্ধ্বতন স্যারদের ম্যানেজ করেই করি। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ছাত্রলীগ করেই আমি এখানে এসেছি। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু আমার এলাকার লোক, আমার আত্নীয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বহু সচিব-যুগ্ম সচিব আমার আত্নীয়। চাইলেও কেউ আমার কিছুই করতে পারবে না।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে গত মঙ্গলবার সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের এসিওএস শরীফ উদ্দিন বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। সচিব-যুগ্ম সচিব, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি অনেকেই আমার আত্নীয় স্বজন থাকতেই পারে। আর আমি ম্যানেজ করেই সব করি সেটা বলিনি। বলেছি সমন্বয় করেই করি। এছাড়া আর কিছু বলতে অনীহা প্রকাশ করেন তিনি। এমনকি অফিসের কাজে বাইরে বেরোনোর কথা বলে সটকে পড়েন তিনি।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সিসিএস দপ্তরের শীর্ষ এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ঠিক আছে, এ বিষয়ে আমি আপনাকে এখন কিছুই বলতে পারছি না। তার সাথে কথা বলে আমি আপনাকে জানাব। কিন্তু তিনিও পরে কিছুই বলেননি। আরেক কর্মকর্তা বলেন, সব কিছু তিনি ম্যানেজ করেই করেন, এ কথা ঠিক বলেনি। এভাবে বলা উচিত হয়নি। এ কথা বলে তিনি নিজের পাপ সবার ওপর চড়াতে চাচ্ছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের স¤পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, রেলে কোন ভাল মানুষ নাই। রেলের বর্তমান ডিজি পূর্বাঞ্চলে কর্মরত থাকাকালে কোন এক সময় এ কথা বলেছিলেন। সেটা এ পর্যন্ত আমরা দেখেছিও। কারণ রেলে দূর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কঠোর পদক্ষেপ না নিলে রেলের দূর্নীতি বন্ধ হবে এমনটা আশা করা যায় না।
(বি: দ্র : দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এসিওএস শরীফ উদ্দিনের অনিয়ম ও দূর্নীতির ধারাবাহিক ৬ষ্ঠ পর্ব প্রতিবেদন শিগগীর প্রকাশিত হবে। নতুন নতুন তথ্য হাতে আসায় প্রতিবেদন সংখ্যা আরও দুটি বেড়ে দাড়াল ৯ এ। পাঠকরা চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে।)
এ সংক্রান্ত আরও :