বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের এসিওএস মো. শরীফ উদ্দিনের বেপরোয়া দূর্নীতিতে অবশেষে টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। জনপ্রিয় দৈনিক ঈশানের প্রিন্ট ও ছাপা ভার্সনে ধারাবাহিক পাঁচ পর্ব প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁর বদলির প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, প্রকাশিত প্রতিবদেনগুলোর ভিত্তিতে তার অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্তের ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমন তথ্য জানিয়েছেন রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ও রেলপথ পরিদর্শক মো. ফরিদ উদ্দিন এবং এ বিভাগের বিভাগীয় ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোলার মো. আনোয়ার হোসেন।
গত বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) এক প্রশ্নের জবাবে মো. আনোয়ার হোসেন দৈনিক ঈশানকে বলেন, এসিওএস শরীফের বিরুদ্ধে দৈনিক ঈশানে যেভাবে একের পর এক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, তা আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি এখন তদন্ত করার মতো পর্যায়ে চলে গেছে। প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে তার অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়গুলো তদন্ত করা হবে।
রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ও রেলপথ পরিদর্শক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, দৈনিক ঈশানে তার বিরুদ্ধে যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ হয়েছে, তাতে তিনি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে কাজ করার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাই তাকে বদলি করার জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। তার বদলির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, রেলের সরঞ্জাম ক্রয়ে ফাইভ পারসেন্ট কমিশনে কন্টাক্ট সই, স্বজনদের নামে করা লাইসেন্স দিয়ে সাপ্লাই কাজ হাতিয়ে নেওয়া, ভুয়া লাইসেন্সে বিল তুলে সরকারি অর্থ আত্নসাৎ, কাজের টোপ দিয়ে ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারদের নিয়ে সিন্ডিকেট করা, তাদের দিয়ে স্ক্র্যাপ চুরি ও চাঁদা আদায়সহ সবরকম অপকর্মের মূল হোতা মো. শরীফ উদ্দিন।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ছাত্রলীগের ক্যাডার, মাননীয় রাষ্ট্রপতি সাহাব উদ্দিন চুপ্পুর আত্নীয় পরিচয়ে তিনি অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে এসব অনিয়ম ও দূর্নীতি করে চলেছেন। এ নিয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ঈশানের অনলাইন ও ছাপা ভার্সনে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এ নিয়ে রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি, ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ার, যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী দূর্বৃত্ত ও কতিপয় পোষ্য সংবাদকর্মী তার পক্ষে নানা সাফাই ও সুপারিশ, অনৈতিক অফার, এমনকি হুমকি-ধমকিও শুরু করেন। এমনকি নানা কায়দায় ফাঁদে ফেলে বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টাও করেন। যা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনগুলো সহজে পড়ার জন্য নিম্নে কোড করে দেওয়া হয়েছে। দূর্নীতিবাজ এই শরীফ উদ্দিন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তর থেকে বদলি হয়ে দেশের যে প্রান্তেই দায়িত্ব পালন করুক না কেন, দৈনিক ঈশান তাকে নজরে রাখবে এবং ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ অব্যাহত রাখবে। পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে দৈনিক ঈশান এই দায়িত্ব পালন করবে।
শরীফের দূর্নীতি নিয়ে দৈনিক ঈশানে সর্বশেষ পঞ্চম পর্ব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ইং, তারিখে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘উর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করেই সব করেন রেলের সিসিস দপ্তরের শরীফ’ প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর মূলত টনক নড়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। এর আগে চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তেমন কোন ব্যবস্থা নেননি।
ফলে তিনি অনিয়ম দূর্নীতিতে চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেন। এমনকি দম্ভ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, আমি যা করি উর্ধ্বতন স্যারদের ম্যানেজ করেই করি। সুতরাং আমার বিরুদ্ধে যতই লেখালেখি করুক, কিছুই হবে না। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ছাত্রলীগ করেই আমি এখানে এসেছি। রাষ্ট্রপতি আমার এলাকার লোক, আমার আত্নীয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বহু সচিব-যুগ্ম সচিব আমার আত্নীয়। কেউ আমার কিছুই করতে পারবে না।
প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা জানান, এসিওএস শরীফ উদ্দিনের নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে দৈনিক ঈশানে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশের পর তিনি কন্টাক্ট সইয়ে কমিশনের হার আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকের ফাইল আটকে রেখে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছেন। ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের আগে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের ক্ষেপিয়েছেন। এরপর বিএনপি যুবদল-ছাত্রদলের নেতাদেরও উস্কানি দিয়েছেন।
ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা জানান, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে যোগদানের পর থেকে শরীফ উদ্দিন প্রতিসপ্তাহে রবিবার দুপুরে অফিসে আসতেন, বুধবার দুপুরের পর ঢাকায় চলে যেতেন। গত দুর্গাপুজার বন্ধের দিন থেকে পরবর্তি দুই সপ্তাহে তিনি অফিস করেছেন মাত্র দুদিন। এ নিয়ে সিসিএস দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে ভয়ে কিছুই বলেন না।
সিসিএস দপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসিওএস শরীফ উদ্দিন প্রায় সময় সিসিএস দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি দেন, তার অফিস করা নিয়ে কিছু বললে তিনি সিসিএস দপ্তরে চাকরি করবেন না। সিসিএস দপ্তরে অফিসার সংকটের সুযোগ নিয়ে তিনি এই হুমকি দেন।
তিনি বলেন, এসিওএস শরীফ উদ্দিনকে দেখতে বা আচরণ শুনলে মনেই হবে না, তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। ছাত্রলীগের ক্যাডারের মতো তার আচরণ ও হাবভাব। একই কথা বলেছেন একই দপ্তরের আরেকজন কর্মকর্তাও। তিনি বলেন, দুঃখের কথা আর কী বলব, তার ব্যবহার খুবই খারাপ।
এমনভাবে কথা বলেন, যেন তিনি এদেশের প্রেসিডেন্ট। এরপরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এই দপ্তরে অফিসার সংকট। দপ্তরের সরঞ্জাম কেনাকাটায় অফিসাররা একে অন্যের সাথে সংযুক্ত। একজন অফিসারের স্বাক্ষর না হলেও সরঞ্জাম কেনাকাটা অচল হয়ে পড়বে। এই সুযোগ নিয়ে এসিওএস শরীফ উদ্দিন যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছেন।
সূত্র মতে, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কমিশন ছাড়া কোন কাজের ফাইল নড়ে না। তম্মধ্যে এসিওএস শরীফ উদ্দিন যে লেবেলের কর্মকর্তা, সেই লেবেলে ১% থেকে ২% কমিশন পাওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ছাত্রলীগের ক্যাডার পরিচয়ে বিগত সময়ে ৫% কমিশন আদায় করেন তিনি।
৫% কমিশন আদায়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ পরিচয়ে কতিপয় বখাটে যুবক-কিশোর দিয়ে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলেন। যাদের ভয়ে ৫% কমিশন দিতে বাধ্য হয়েছেন ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা। সম্প্রতি এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েও তিনি ফ্ইালে সই করেননি। আরও এক ঠিকাদারের ২৮ লাখ টাকার কাজের ফাইল তিনি আটকে রেখেছেন।
এতে সরঞ্জাম কেনাকাটায় জড়িত ঠিকাদাররা একদিকে ভাল মানের পণ্য কিনতে পারছেন না, অন্যদিকে নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিপরীতে ঘুষের টাকায় এসিওএস শরীফ উদ্দিন গড়েছেন অঢেল স¤পদ। দেশের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে করেছেন বহুতল বাড়ি। কিনেছেন জমি। ঢাকায় কিনেছেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট। বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে জমিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা।
ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা আরও জানান, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে এসিওএস শরীফ উদ্দিন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে পাহাড়তলি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারদের অনৈতিক সুবিধা দিতেন। তাদের নিয়ে তিনি তিনস্তরে চোরচক্র গড়ে তোলেন। তাদের ভয়ে সিসিএস দপ্তরের প্রকৃত ঠিকাদার-সাপ্লাইয়াররা আতঙ্কিত সময় পার করছেন। এমনকি সিসিএস নিয়ন্ত্রক দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারাও তাদের ভয়ে তটস্থ। তাদের কারও কথা কোন সময় মানতেন না শরীফ উদ্দিন।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে রেলওয়ে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের এসিওএস শরীফ উদ্দিনের মুঠোফোনে গত তিন ধরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হুয়্যাটস অ্যাপে মেসেজ দিয়ে মতামত জানতে চাইলেও তিনি কোন মতামত ব্যক্ত করেননি।
(বি: দ্র : দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এসিওএস শরীফ উদ্দিনের অনিয়ম ও দূর্নীতির ধারাবাহিক ৬ষ্ঠ পর্ব প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। ৭ম পর্বও প্রকাশিত হবে শীগগীরই। নতুন তথ্য হাতে আসায় প্রতিবেদনের সংখ্যা এখন বেড়ে দাড়াল ৯ এ। পাঠকরা চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে।)
এ সংক্রান্ত আরও :
- মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে এসিওএস শরীফের ঘুষ বাণিজ্য
- চট্টগ্রামে রেলের সরঞ্জাম চোর চক্রের গডফাদার এসিওএস শরীফ!
- রেলের দূর্নীতির নিউজ ঠেকাতে অনৈতিক অফার, পরে শরীফ চক্রের হুমকি
- রাষ্ট্রপতির আত্নীয় পরিচয়ে রেলওয়েতে শরীফের লুটপাট
- উর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করেই সব করেন রেলের সিসিএস দপ্তরের শরীফ!