মোহাম্মদ আবুল কালাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ন পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন চট্টগ্রামে। স্ত্রী শামীমা নাজনীনও যুগ্ন পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন একই কর্মস্থলে। স্বামী-স্ত্রী দু‘জনেই ডুবে আছেন নানা দূর্নীতিতে। জমিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। কিনেছেন গাড়ি, সারি সারি জমি, প্লট, ফ্ল্যাট। গড়ে তোলেছেন বহুতল ভবন। অদৃশ্য রয়ে গেছে এমন আরও কত সম্পদ।
সবমিলিয়ে মহাসুখে দিনযাপন করছিলেন তারা। কিন্তু একটা জায়গায় অশান্তি ভুগতে শুরু করেন এই কর্মকর্তা দম্পতি। সেটা হলো তাদের কোন সন্তান নেই। এ নিয়ে চরম হতাশায় ছিলেন স্ত্রী শামীমা নাজনীন। হতাশ ছিলেন আবুল কালামও। হতাশা মিটাতে তারা করেন ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা। তারই অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে করেন এক নবজাতক চুরি।
মৃদুল বড়ুয়া নামে তারই এক সহকর্মীর শ্যালীকা নার্সের সহযোগীতায় মোটা অংকের টাকায় ২০০৪ সালে ঘটানো হয় এই শিশু চুরির ঘটনা। এ ঘটনায় কোন এক মায়ের কোল খালি হলেও এই ব্যাংক কর্মকর্তা দম্পতির পরিবারে ফিরে আসে আনন্দের বন্যা। সামিন বিন কালাম নামে ওই সন্তান বর্তমানে চট্টগ্রামের কোন এক সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী।
আর অত্যন্ত সুকৌশলে এই সন্তানের জন্মদাতা পিতা সেজে দুর্নীতিতে স্বিদ্ধহস্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল কালাম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শিক্ষা ভাতা-মেডিকেল ভাতা ও ব্যাংক কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধিসহ নানা সুবিধার আওতায় আত্নসাৎ করেন লাখ লাখ টাকা। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বিধি বহির্ভুত। প্রশ্ন উঠেছে স্ত্রী শামীমা নাজনীনের চাকরিতে নিয়োগে দূর্নীতি নিয়েও। এমনটাই দাবি করেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
যদিও বিধি মোতাবেক সব সুবিধা নেওয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ন পরিচালক মো. আবুল কালাম। তিনি বলেন, ব্যাংকের বিধিতে পোষ্য সন্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ভাতা গ্রহণের বৈধতা রয়েছে। সেখানে বলা হয়নি সন্তান জন্মসূত্র ছাড়া হতে পারবে না। এমনটা উল্লেখ নেই।
তিনি বলেন, সন্তান লালিত-পালিত হলেও সে সন্তান। আল্লাহ আমারে জন্মসূত্রে সন্তান দেয়নি। সে জন্য আমি সন্তান লালন করেছি। তবে ওই সস্তান চুরির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, সন্তান আমি দত্তক নিয়েছি। এছাড়া কোন রকম দূর্নীতির সাথে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন। তবে জমি কেনার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ওই জমি নিয়ে বিরোধের কারণেই এসব তথ্য দিয়ে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে।
প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়া এক্সেস রোডে বলাকা আবাসিক এলাকায় তিন কাঠা জমির উপর ৮ তলা ভবন নির্মাণের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওই ভবনের কাজ এখন বন্ধ রয়েছে। অপর প্রশ্নের জবাবে প্রিমিও কার কেনার কথাও স্বীকার করেন তিনি।
স্ত্রী শামীমা নাজনীনকে অনৈতিকভাবে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে চাকরি প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন, হ্যাঁ তিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি হিসেবে চাকরি পেলেও পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে যুগ্ন পরিচালক হয়েছেন। যেভাবে আমিও পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ন পরিচালক পদে কর্মরত আছি। এতে কোন দূর্নীতি নেই।
কিন্তু চাকরির বিধি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মো. আবুল কালাম মূদ্রানোট পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী শামীমা নাজনীন নিয়োগ পেয়েছেন টেলিফোন অপারেটর হিসেবে। যেখানে ঘুষ হিসেবে লেনদেন হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। আবার অতি অল্প সময়ে শামীমা নাজনীনের যুগ্ন পরিচালক পদে পদোন্নতি পাওয়াও বিস্ময়কর।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ন পরিচালক মো. আবুল কালাম বিধি মোতাবেক ২০২৫ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করবেন। চাকরিতে যোগদানের পর থেকে তিনি অনৈতিক নানা দূর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছেন। এভাবে তিনি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়েছেন। কিনেছেন গাড়ি, সারি সারি জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, গড়েছেন বহুতল ভবন। এমন অদৃশ্য আরও বহু সম্পদ রয়েছে তার।
দূর্নীতির টাকায় গড়া এসব সম্পদ মানুষের নজর থেকে আড়াল করতে তিনি নিজে বসবাস করছেন ব্যাংক কলোনীতে। ক্রয়করা একাধিক ফ্ল্যাট তিনি ভাড়ায় দিয়েছেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে তার রয়েছে কোটি কোটি টাকা। দূনীতির অংশ হিসেবে স্ত্রী শামীমা নাজনীনকে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে দিয়েছেন চাকরি।
অভিযোগ রয়েছে, শামীমা নাজনীন নিয়োগ পান টেলিফোন অপারেটর হিসেবে। যেখান থেকে তিনি রাতারাতি যুগ্ন পরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়ে যান। এভাবে দূর্নীতির টাকায় তাদের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে চলছিল। কিন্তু স্ত্রী শামীমা নাজনীনের গর্ভে কোন সন্তান না আসায় হতাশায় ডুবছিল এই দম্পতি।
এক পর্যায়ে সন্তানের অভাব ঘুচাতে এই দম্পতি করেন ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা। যেখানে টাকার লোভে যুক্ত হন তারই সহকর্মী মৃদুল বড়ুয়া। ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর মৃদুল বড়ুয়ার শ্যালীকা এক নার্সের সহযোগীতায় মোটা অঙ্কের বিনিময়ে চমেক হাসপাতাল থেকে চুরি করা এক নবজাতক তুলে দেন আবুল কালাম ও শামীমা দম্পতির কোলে। যার নাম রাখা হয়েছে সামিন বিন কালাম।
আর এই সন্তান বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোন এক সরকারি কলেজে অনার্স পড়ছেন। আর এই সন্তানের শিক্ষা ও মেডিকেল ভাতা তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করেন আবুল কালাম। যেখানে ওই সন্তান তিনি জন্মগ্রহণের পরিবর্তে লাভ করিয়াছেন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু ঘুষের বিনিময়ে বিষয়টি তেমন আমলে না নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এসব ভাতা অনুমোদন করেন।
ফলে গত ১২ বছরে সন্তানের শিক্ষাভাতা হিসেবে তিনি ৭২ হাজার টাকা এবং মেডিকেল ভাতা হিসেবে তুলেছেন অন্তত ১০ লাখ টাকা। তুলেছেন অন্যান্য ভাতাও। সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংক কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবেও। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বিধি বহির্ভুত। এ অবস্থায় তিনি অবসর গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার আগে চলতি মাসের নভেম্বরের মধ্যে তিনি আরও একটি পদোন্নতির জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দৌড়ঝাপ করছেন। তার এই দূর্নীতির তদন্ত হলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান এর অফিসিয়াল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি।